সাকিব আল হাসান: আমাদের শৈশবের প্রথম হিরো

সাকিব আল হাসান, বাংলাদেশের পক্ষে দ্রুততম সেঞ্চুরির রেকর্ড গড়ার পর। ২০০৯ সালে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ৬৩ বলে সেঞ্চুরি করেছিলেন তিনি। ৬০ বলে সেঞ্চুরি করে রেকর্ডটি এখন মুশফিকুর রহিমের দখলেফাইল ছবি

ছোটবেলায় বাড়ির উঠানে ব্যাট-বল হাতে নিয়ে নিজেকে সাকিব আল হাসান দাবি করা প্রথম প্রজন্মের মানুষের মধ্যে আমিও একজন। স্বভাবসুলভ ব্যাটিং-বোলিং করতাম ডান হাতে; কিন্তু নিজেকে সাকিব আল হাসান দাবি করতে বাম হাতেই ব্যাটিং-বোলিং করার চেষ্টা করতাম। পাড়ার মাঠে প্রতিযোগিতা থাকত, কে কতটা সাকিব আল হাসানের বোলিং স্টাইল নকল করতে পারে।

২০০৭ সালের কথা। চলছে ক্রিকেট বিশ্বকাপ। ক্লাস ওয়ানে পড়তাম। চারদিকে বিশ্বকাপের আমেজে একটু একটু করে ক্রিকেট বুঝতে শুরু করি। পরিচিত হই সাকিব আল হাসান নামটার সঙ্গে। যদিও আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সাকিব আল হাসানের অভিষেক ঘটে ২০০৬ সালের আগস্টে। ২০০৮, ২০০৯, ২০১০ একেকটা বছর শেষ হতে হতে এ নামটার সঙ্গে আরও পরিচিত হতে থাকলাম। তাঁর নেতৃত্বে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও নিউজিল্যান্ডের মতো শক্তিশালী দলকে প্রথমবারের মতো হোয়াইটওয়াশ করে বাংলাদেশ। ছোটবেলার এ স্মৃতি এখনো চোখে ভাসে। ধারাভাষ্যকার আতহার আলি খানের মুখে শোনা বাংলাওয়াশ শব্দটা এখনো কানে বাজে। সেবারই তিনি বাংলাওয়াশ শব্দটা প্রথম বলেছিলেন।

বিশ্ব মানচিত্রের ছোট্ট একটি দেশ ডমিনিকায় একজনের নাম সাকিব আল হাসান। শুনতে অবাক লাগলেও এটি সত্যি।

২০১১ সালে ঘরের মাঠে বিশ্বকাপ। মায়ের কাছে বায়না ধরে সেবার প্রথম কেনা হয় লাল-সবুজের বিশ্বকাপের জার্সি। জার্সির পেছনে মোটা কালো রঙের মার্কার দিয়ে নিজের নামের সঙ্গে লিখি নম্বর সেভেন্টি ফাইভ! ২০১২ সালের এশিয়া কাপে সাকিবের ব্যাটিং-বোলিংয়ে অনবদ্য পারফরম্যান্সে টুর্নামেন্ট সেরা খেলোয়াড় হলেও ফাইনালে পাকিস্তানের কাছে দুই রানের হারে সাকিবদের সঙ্গে কেঁদেছি আমিও। কেঁদেছে গোটা দেশ।

একটা সময় আইপিএল দেখতাম শুধু সাকিব আল হাসানের জন্য। টিভির সামনে বসে অপেক্ষায় থাকতাম কখন ব্যাটিংয়ে আসবে সাকিব, কখন গৌতম গম্ভীর সাকিবের হাতে বল তুলে দিবে। খেলা দেখছি হঠাৎ লোডশেডিং! সেই সময়ে তো বাসার কারও স্মার্টফোন ছিল না। তখন আর বসে থাকে কে; সাইকেল নিয়ে ছুটতাম অন্য পাড়াতে। যেখানে বিদ্যুৎ আছে।

একটু একটু করে যখন বড় হতে লাগলাম। সাকিবও তখন একের পর এক অর্জনে বিশ্ব জয় করতে থাকল। এ সাকিব শুধু আমার প্রিয় ক্রিকেটার না, গোটা প্রজন্মেরই প্রিয়। আরও জানলাম আমার মতো এ সাকিবের ভক্ত পুরো বিশ্বেই ছড়িয়ে আছে। এ সাকিব যে বিশ্বসেরা।

সাকিব আল হাসান
এএফপি

বিশ্ব মানচিত্রের ছোট্ট একটি দেশ ডমিনিকায় একজনের নাম সাকিব আল হাসান। শুনতে অবাক লাগলেও এটি সত্যি। সাকিব ডমিনিকায় খেলতে গিয়েছিল ২০০৯ সালে, তখন এক ছেলের জন্ম হয় দেশটায়। সাকিবের খেলা দেখে এক ভদ্রলোকের এতটাই ভালো লেগে গিয়েছিল যে তিনি তাঁর ছেলের নাম রেখেছেন সাকিব আল হাসান।

সাকিব নিজেই পুরোনো এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, পরিচিত একজন একবার কাশ্মীর যায়। কাশ্মীরের প্রত্যন্ত অঞ্চলে একজনের ঘরে ঝোলানো ছিল সাকিবের ছবি।

কিছুদিন আগে একটি গবেষণার কাজে আমি যাই ছোট্ট দ্বীপ নিঝুম দ্বীপে। সেখানে দেখা পাই ১৩ বছরের ছোট্ট এক বালক আরাফাতের সঙ্গে। নিঝুম দ্বীপে সে চা বিক্রি করে। চা খেতে খেতে তার সঙ্গে গল্প করতে শুরু করলাম। ছেলেটা জানাল তার মন খারাপ। কারণ জানতে চাইলে বলে, বিপিএলে সাকিবের দল হেরেছে। তাই মন খারাপ। পরে আরও জানতে পারলাম, এ প্রত্যন্ত অঞ্চলের এ বালকটি সাকিবের কত বড় ভক্ত। তার সংগ্রহে আছে সাকিবের অনেকগুলো পোস্টার।

সাকিবের অর্জনের কথা এ লেখায় আনলে তা শেষ করা যাবে না। তাঁর অর্জন কারও অজানা নয়। জনপ্রিয় ধারাভাষ্যকার মার্ক নিকোলাস একবার বলেছিলেন, ‘ইংল্যান্ডের হয়ে খেললে সাকিব এতদিনে নাইটহুড উপাধি পেয়ে যেতেন।’ যুক্তরাজ্যের রানির দেওয়া অন্যতম সর্বোচ্চ সম্মানজনক উপাধি হলো ‘নাইটহুড’।

জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ তাঁর ফাউন্টেনপেন বইটি সাকিব আল হাসানকে উৎসর্গ করে বলেন, ‘সাধারণ বলপয়েন্ট কলমের কালি শেষ হয়ে গেলে আর লেখা যায় না। কিন্তু ফাউন্টেনপেন কালি শেষ হলে আবার কালি ভরে লেখা যায়। সাকিব হচ্ছে আমাদের ফাউন্টেনপেন। সবাই থেমে গেলেও সাকিব থেমে যায় না। ছেলেটা অদম্য, অফুরন্ত।’ হুমায়ূন আহমেদ আজ বেঁচে থাকলে দেখে যেতে পারতেন তাঁর কথাটা যে কতখানি সত্য ছিল।

সাকিবকে কেউ থামাতে না পারলেও বয়সটা যে থেমে থাকছে না। আজ ২৪ মার্চ, সাকিব আল হাসান পদার্পণ করল সাঁইত্রিশে। সাকিব ব্যাট হাতে প্রতিপক্ষকে চোখ রাঙিয়ে জবাব দিচ্ছে, বল হাতে ভাঙছে প্রতিপক্ষের একের পর এক দূর্গ। এ দৃশ্য বাংলার ক্রিকেট আকাশে খুব বেশি দিন হয়তো দেখা মিলবে না।

বাংলার ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় নক্ষত্র হয়তো বড়জোর আরও দুই–তিন বছর ব্যাট-বল হাতে লড়বেন সবুজ গালিচায়। প্রতিপক্ষকে খুব বেশি দিন সাজাতে হবে না বাংলার ক্রিকেটের নবাবের জন্য নতুন নতুন রণকৌশল।

সাকিব তর্কাতীতভাবে বাংলাদেশের ইতিহাসের সেরা ক্রিকেটার, সেরা অ্যাথলেট। সর্বকালের সেরা অলরাউন্ডার বললেও কি ভুল হবে?

শুভ জন্মদিন আমার মতো অনেকের শৈশব কৈশোর রাঙানো সাকিব আল হাসান। শুভ জন্মদিন দ্য গ্রেট সাকিব আল হাসান।

সভাপতি, নোয়াখালী বন্ধুসভা