অন্যায়ের বিরুদ্ধে নারীর প্রতিবাদ ‘কুন্তীর বস্ত্রহরণ’

হরিশংকর জলদাসের ‘কুন্তীর বস্ত্রহরণ’ছবি: সংগৃহীত
জীবনের প্রয়োজনে নারীরা এই বিশ্বে জন্ম নিলেও, মৃত্যুর আগপর্যন্ত তাদের জীবনের মোকাবিলা শেষ হয় না। নানা ঘটনায়, নানা ইতিহাসেও নারীদের গল্প কিংবা মর্মকথা লিখিত হয়, কিন্তু মূল্যায়ন পায় না।

পুরুষশাসিত এই সমাজে নারীরা লাঞ্ছিত হয়ে এসেছে বহু বছর ধরে। অতীত থেকে বর্তমান হলেও চিত্রটা খুব একটা পরিবর্তন হয়নি, উল্টো ধরন বদলে সেটা আরও ভয়ংকর হয়েছে ক্ষেত্রবিশেষে। তবু জীবজগতের ভারসাম্য রক্ষার্থে নারী-পুরুষ উভয়েরই গুরুত্ব আছে বলেই হয়তো নারী এখনো এই সমাজে জন্ম নেয়। প্রয়োজন কিংবা গুরুত্বের অবদানে তারা বড় হয় আর সমাজের মূলস্রোতে প্রবেশ করে বেঁচে থাকে। এ জগতে বেঁচে থাকা প্রতিটা মানুষের জন্য চ্যালেঞ্জিং হলেও নারীদের জন্য সেটা আরও বেশ ভয়ংকর রূপে অবতীর্ণ হয়ে আসছে যুগের পর যুগ ধরে।

জীবনের প্রয়োজনে নারীরা এই বিশ্বে জন্ম নিলেও, মৃত্যুর আগপর্যন্ত তাদের জীবনের মোকাবিলা শেষ হয় না। নানা ঘটনায়, নানা ইতিহাসেও নারীদের গল্প কিংবা মর্মকথা লিখিত হয়, কিন্তু মূল্যায়ন পায় না। মূল্য নেই কিংবা থাকলেও দিতে আগ্রহী না। তবে গুরুত্বপূর্ণ এবং লাগবেই, এমন একটি বস্তুতে পরিণত করতে পারলেই যেন স্বস্তি ফিরে সমাজে ক্ষমতাবলে অধিকার পাওয়া মানুষদের জন্য।

হরিশংকর জলদাসের ‘কুন্তীর বস্ত্রহরণ’ও তেমনি একটি নারীকেন্দ্রিক চরিত্রের উপস্থাপনের উপন্যাস। যেখানে বহুল জনপ্রিয় গ্রন্থ মহাভারতের ‘দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ’-এর মতো এই সমাজের ক্ষমতাধরেরা ক্ষমতাবলে প্রতিবাদী ও সাহসী কুন্তীর বস্ত্রহরণ করতে চেয়েছিল। কিন্তু দ্রৌপদীর ডাকে সাড়া দেওয়া তার সখা কৃষ্ণের মতো প্রকৃতির আশ্রয়ে গিয়ে কুন্তী নিজেকে রক্ষা করেছিল।

এই বইয়ে তুলে ধরা হয়েছে সমাজের নিচু স্তরে বসবাস করা কুমোর ও মালোদের ওপরও কীভাবে ক্ষমতাসীনেরা দখলদারত্ব করে থাকে। উঠে এসেছে বাংলাদেশের আরেক রূপ, যখন স্বাধীনতাবিরোধীরা ক্ষমতা পেয়ে সমাজের সব স্তরে গিয়ে নিজের প্রতিনিধিত্ব দিয়ে পুরো সমাজব্যবস্থাকে নিজের কবজায় নিয়ে নেয়। এ ছাড়া এ দেশের গ্রামের চিরাচরিত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট খুব স্বল্প পরিসরে হলেও সত্যিকার রূপলেখায় লেখক তুলে ধরেছেন।

ডাকাতিয়া, গোমতির পর কাঁকড়ি নদীকে নির্ভর করে গড়ে ওঠা বহু বছরের কুমোর আর কৈবর্তপাড়ার বাসিন্দারা দেশের অনেক ইতিহাসকে সাক্ষী রেখে তাদের জীবন চলমান রেখেছেন। কথিত ভদ্রসমাজ থেকে দূরে বসবাসকারী এই সম্প্রদায়ের মানুষের জীবন তেমন উন্নত কখনো না হলেও তারা তাদের মতো দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে সুখেই দিন কাটায়। তবু তাদের জীবনে প্রভাব ফেলতে চায় সমাজের লোভী ও হিংস্র ক্ষমতাসীনেরা।

মুক্তিযুদ্ধের আগে ও পরে অনেক হিন্দু পরিবারের মতো বিমলেন্দু রায়চৌধুরী দেশ ছেড়ে চলে গেলেও ওনার ছোট ভাই রামচন্দ্রপুরের জমিদার কমলেন্দু রায়চৌধুরী থেকে যান। তবে ইয়াছিন মোল্লা আর লাঠিয়াল এমদাদ নামক বিশ্বস্ত লোকের ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে তাকেও সর্বস্বান্ত হয়ে পরিবার নিয়ে দেশত্যাগ করতে হয়। তারপর তাদের জমিদারি দখল করে আজীবন ভোগ করে ইয়াছিন মোল্লার মতো লোকেরা। এ চিত্র ইতিহাসে সে সময়কার দেশের সর্বত্র অবস্থার রূপ তুলে ধরে।

দেশ স্বাধীন হলে আর নানা সময়ে রাজনীতিতে দল বদলালেও ইয়াছিন মোল্লার মতো উত্তরসূরিরা থেকে যায়। রাজনৈতিক কৌশলের আশ্রয় নিয়ে যে সময় যে দল ক্ষমতায় থাকে, সে সময় সে দলের লোক হয়ে যায় তথাকথিত লোকদেখানো সমাজসেবকেরা। যারা স্বল্পশিক্ষিত বখাটে জব্বারের মতো মিথ্যা প্রচার, ডাকাতি, অর্থলুট আর দেহবলের ক্ষমতা প্রদর্শনের মাধ্যমে প্রশাসনকে হাত করে বিপিন গুহ শিক্ষকদের মতো লোকদের জীবন নরকে পরিণত করে দেয়। যাদেরকে একসময় এই শিক্ষকেরাই শিক্ষা দিয়েছিলেন। আর সময়ের সুযোগে মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজাকার হওয়া সত্ত্বেও আবুল কাশেমের মতো লোকেরা জোরজবরদস্তি করে মেম্বার, চেয়ারম্যান হয়ে যায়। প্রশাসন হাত করে দখল, লুটপাট আর অন্যায় চালিয়ে যায় স্বাধীনভাবে।

এত অশান্তি আর অন্যায়ের মধ্যেও দিন শেষে কুমোরপাড়ার অজয় জেঠার উঠোনে মহাভারত শোনার মধ্য দিয়ে কষ্টে জর্জরিত থাকা ব্যক্তিরা শান্তি খুঁজে পায়। কিন্তু সেখানে যখন শ্মশানঘাট দখলের অশান্তির ছায়া দেয় ক্ষমতাসীনেরা, তখন কুন্তীর মতো মধ্যবয়সের নারীরাও প্রতিবাদী হয়ে ওঠে মহাভারতের দ্রৌপদীসহ ইতিহাসের পাতায় লেখা বিভিন্ন সাহসী নারীদের ছায়া হয়ে।

একসময় হয়তো তাদের আর প্রতিবাদ করার শেষ সম্বলটুকু থাকে না, তখন তাদের নিজের জীবন দিতে হয়। তবু তারা অন্যায় মেনে নেয় না। ফিরে আসে অন্যরূপে এ সমাজে অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে। শান্তনুর মতো শুদ্ধ উচ্চারণে মহাভারত পড়া সাহসী তরুণ আর কুন্তীর মতো মধ্যবয়স্ক প্রতিবাদী নারীরা হারিয়ে যায় না। সমাজের পরিচিত নিচু জাতের হলেও তারা অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে যুগে যুগে জন্ম নেয়। তেমনি আবুল কাশেম, ইয়াসিন মোল্লা, এমদাদ আর জব্বারের মতো লোকেরাও সমাজের নানা স্থানে ঘাপটি মেরে থাকে আর সময়–সুযোগ পেয়ে মানুষের ওপর অত্যাচার করে। সমাজে এই ধারা চলতেই থাকে আর সমাজ নতুন নতুন ইতিহাসের শুভসূচনা করে।

হাজীপুর, নরসিংদী