ছোট্ট অভিমানের অব্যক্ত কথা

ছবি: এআই/বন্ধুসভা

এক.
রাতে টিউশন শেষে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে বাসায় ফিরতে দেরি হয়েছে। বাড়ির সবাই নৈশভোজ সেরে ডাইনিংয়ে গল্প করছে আমার অপেক্ষায়। আমি বাসায় ফিরে কলিং বেল চাপলে কেউ দরজা খুলছিল না প্রথমে। বিরক্তি নিয়ে একাধিকবার চাপলাম। সবাই উপস্থিত থেকেও দরজা খুলছে না দেখে রাগে ফুলতে থাকি। দেরিতে ফেরার শাস্তি দিল বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখে। এর জেরে মায়ের মুখ অনর্গল চলতে শুরু করে, সঙ্গে বাবাও যোগ করলেন কিছু। অনার্স ফাইনাল ইয়ারে দুটি কোর্সে ফেল থেকে চাকরি না পাওয়ার খোঁচা দেওয়া পর্যন্ত গড়াল ঘ্যানঘ্যানানি। আমিও মা–বাবার মুখে মুখে তর্কাতর্কি করে হনহনিয়ে রুমে ঢুকে দড়াম করে হুক লাগিয়ে শুয়ে পড়লাম। মাথাভর্তি টেনশন ও খিদের চাপ নিয়ে ফ্যানের দিকে চেয়ে আছি দীর্ঘক্ষণ। ভাবনার অতল গহ্বরে তলিয়ে ভাবতে লাগলাম বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মা–বাবার আচরণের এতটাই পরিবর্তন! কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না।

সহস্রাব্দ স্মৃতি হাজির হয়ে আমার করুণ অবস্থাকে আরও বিমর্ষ করে দিল। মনে পড়তে লাগল শৈশব আর বাল্যকালের কথা। এখনো বাবার কাঁধে–পিঠে চড়ার অনুভব হচ্ছে। হাত চিত করে তালু দেখলাম একবার, মনে হচ্ছে যেন সর্ব অবয়বে বাবার স্পর্শ লেগে আছে।

ইদানীং বাবার হার্টের সমস্যাটা আরও প্রকট হয়েছে। তিনি সময়ে–অসময়ে রাগে তেতে ওঠেন। খুবই বিস্ময়ভরা মন নিয়ে এসব গভীরভাবে ভাবতে লাগলাম। শিক্ষকতা পেশা থেকে অবসরে যাওয়ার পর বয়সের সঙ্গে সঙ্গে রোগও বেড়েছে। অথচ এই সংসারে বাবা ছিলেন খুবই অনুমোদনশীল। আমরা মায়ের অনুশাসন আর চোখরাঙানিতে বড় হলেও বাবা ছিলেন মাটির ছাঁচে তৈরি মানুষ। তাঁকে ইচ্ছেমতো রূপ দিতেন মা, যেমনটা কাদামাটি দিয়ে শিশুরা একবার পুতুল বানিয়ে মনের মতো না হলে ভেঙে নতুন রূপ দেয়, ঠিক সে রকমই। মায়ের এমন নিয়মনীতি ভালো না লাগলেও অভ্যস্ত হয়ে গেছি সবাই। মায়ের বকুনি শুনতে শুনতে আমার চামড়া থেঁতলে প্রায়। কিন্তু বাবার ছোটখাটো বিষয়ও মেনে নিতে কষ্ট হয়। হঠাৎ বাবার আমূল পরিবর্তনে আমি খাপ খাইয়ে নিতে পারছি না। এ নিয়ে ভাবতে ভাবতে পুরো রাত শেষ হয়ে গেছে, তবু আমার চোখজোড়া বন্ধ হয়নি।

দুই.
রাতে আমার অপেক্ষায় বসে থাকলেও কথা বলার সুযোগ হয়নি তাঁদের। অসুস্থতা আগের তুলনায় বেড়ে যাওয়ায় বাবার চিকিৎসার বিষয়ে কথা বলতে চেয়েছিলেন আমার সঙ্গে। প্রথমবার হার্টে রিং পরানোর পর ডাক্তার টেনশন করতে বারণ করেন। কিন্তু অবসরে যাওয়ার পর থেকে বাবার চেহারা কেমন যেন মলিন। আমার পিঠাপিঠি দুই বোন সারাক্ষণ বাবাকে সময় দেওয়ার চেষ্টা করে, কিন্তু আমি বড় ছেলে হয়ে লজ্জায় বাবার পাশেও ঘেঁষতে পারি না। একদিকে উপযুক্ত বয়সে চাকরি না পাওয়ার লজ্জা, অপর দিকে ফাইনাল ইয়ারে খারাপ হওয়ার সংকোচ। তবু প্রাণপণ চেষ্টা করছি নিজের জায়গা থেকে। মানুষের বাড়িতে দরজায় দরজায় কলিং বেল চেপে ছেলে পড়িয়ে আর কত টাকাই–বা আসে। উপযুক্ত দুটি বোনের খরচ আর সংসারের টানাপোড়েনের চিন্তায় বাবার রোগটাও বেড়ে চলছে দিনকে দিন।

পরদিন সকালে আমি ঘুম থেকে ওঠার আগেই বাড়ির সবাই কোথায় যেন চলে গেছে। ছোট বোন হৃদিকে ফোন দিয়ে জানতে চাইলাম। সে বলল, ‘ভাইয়া, আমরা বাবাকে নিয়ে হাসপাতালে আসছি।’ আমিও তড়িঘড়ি করে হাসপাতালে যাই। ততক্ষণে সবকিছু ব্যবস্থা করে অপারেশন থিয়েটারে নেওয়া হয়েছে বাবাকে। বাইরে আমরা যে যার মতো মুখ কালো করে নীরবে দাঁড়িয়ে রইলাম। মা আমার ওপর তখনো রেগে আছেন, কথা বলছেন না। আমি বিশেষ প্রয়োজনে কথা বললেও হ্যাঁ–হু উত্তর দিচ্ছেন কেবল। আরও ঘণ্টা দুয়েক পর নার্সরা একজনকে ভেতরে ঢোকার অনুমতি দিলে আমি ঢুকতে চাইলাম। মা নিষেধ করেছেন, না ঢুকতে। ওনার চোখের আগুনের হল্কায় আমি এইটুকু হয়ে যাই। মা দেখে আসলেন বাবার হার্টবিট অস্বাভাবিকভাবে চলছে, জ্ঞান ফেরেনি এখনো। আমরা অপেক্ষা করতে লাগলাম চুপচাপ।

তিন.
ওয়েটিং রুমে ও বারান্দায় বেশ কিছুক্ষণ পায়চারি করছি ক্ষীণ পা চালিয়ে। বাবার হার্টবিট স্বাভাবিক হতে সময় নিচ্ছে কেন? অবস্থা আশঙ্কাজনক কি না, এসব বিষয়ে ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করছি। উনি মুচকি হেসে আশ্বস্ত করেছেন। আমি মিথ্যা আশ্বাসের জোরে নিজেকে সান্ত্বনা দেওয়ার বৃথা চেষ্টা করলাম। অপারেশন থিয়েটার থেকে স্ট্রেচারে বাবাকে তড়িঘড়ি করে ঢোকানো হলো ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে। দরজায় বড় বড় করে লেখা ‘জনসাধারণের প্রবেশ নিষিদ্ধ’। অসহায়ের মতো এক পাশে দাঁড়িয়ে রইলাম। নার্সরা নিরলস সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু বাবার অবস্থার বিশেষ উন্নতি হচ্ছে না। সকাল থেকে রাত গড়িয়ে যাচ্ছে, এইটুকু হলেই আলো ফুটবে।

রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছি বিষণ্ন হৃদয়ে। ইট–পাথরের নির্দয় শহরের আকাশচুম্বী অট্টালিকা গভীর রাতে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। কোথাও স্বস্তির দেখা মিলছে না। আকাশে তারা নেই; নেই কোনো উজ্জ্বলতার ছিটেফোঁটা। আকাশও বুঝি আজ আমার সঙ্গে সমব্যথী হয়ে অন্ধকার ছড়িয়েছে। তবু সুবিশাল আকাশের দিকে অপলক তাকিয়ে আছি জড়ো হয়ে। শেষ রাতে সার্জারি বিভাগের রোগীদের চিৎকার ও চেঁচামেচি কমে এসেছে। নার্সরাও ঝিমিয়ে পড়েছেন সারা দিনের ক্লান্তিতে। এমন সময় নিঃশব্দের পর্দা ভেদ করে দৃঢ় পদক্ষেপে দায়িত্বরত দুজন ডাক্তার কানাকানি করে ঢুকছেন আইসিইউ কক্ষে। মিনিট দশেক পর সশব্দে দরজা খুললে আমি এগিয়ে এসে বাবার অবস্থা জানতে চাইলাম। ডাক্তার গম্ভীরমুখে বললেন, ‘সরি!’ মৃদুভাবে পা চালিয়ে পাশ কেটে চলে গেলেন চেম্বারে।

রুমে ঢুকে দেখি নার্সরা বাবার হাত থেকে খুলে ফেলতে শুরু করেছেন স্যালাইনের ক্যানুলা। আমি বাবার নিস্পৃহ চেহারার দিকে তাকিয়ে অন্ধের মতো হয়ে পড়ি। দুঃখের ত্রিশূল বুক এফোঁড়–ওফোঁড় ঝাঁঝরা করে বেরিয়ে গেছে। বেহুঁশ হয়ে পড়ে রইলাম বাবার নিথর দেহের শিথানে। মাথার ভেতর ঘুরপাক খেতে থাকে কেবল একটাই শব্দ ‘সরি’।

ডাক্তার আমাকে শিগগির সরি বলতে পারলেও বাবাকে আমি সরি বলতে পারিনি। শেষ যাত্রায় বাবাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে যদি বলতে পারতাম, ‘তোমাকে বড্ড ভালোবাসি’। ছোট্ট অভিমানের অব্যক্ত কথা আর কিছু আফসোস বয়ে বেড়াব জীবনভর।

বন্ধু, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধুসভা