রংহীন সিঁদুর

ফুল আর সিঁদুরপ্রতীকী ছবি

মাধবীলতার রঙিন সিঁথি আজ মলিন ও বিবর্ণ। কে জানত চপলা মাধু একদিন নীরব-নিস্তব্ধ সত্তা বয়ে বেড়াবে? কল্পনাতীত ছিল এহেন বাক্‌হীন ও স্পন্দনহীন অন্তরের পরিস্থিতি। সময় ও পরিস্থিতি ধীরে ধীরে তাকে টেনে এনে এই বাঁকে এসে ভেড়াবে, এ–ও কি সে জানত? চোখজুড়ে স্বপ্ন ঝিকিমিকি করত একসময়। অন্তরে সাতসাগরের জলসম ভালোবাসা পুষত। হৃদয়চক্ষুতে এক আকাশ পিপাসা নিয়ে খুঁজত সে ভালোবাসার আঁধার। যদি এমন আঁধার কখনো ধরা দেয় তার পিপাসার্ত জীবনে, তবে সে হৃদয়ে সঞ্চিত ভালোবাসার পুরোটাই ঢেলে দেবে।

রোগ-শোক, সুখ-দুঃখের পাহাড় ডিঙিয়ে একদিন তার জীবনে ধরা দিল কিম্ভূতকিমাকার সময়। সিঁদুরবিহীন তার সিঁথি যখন চৈত্রের প্রখরতা, গ্রীষ্মের তাপপ্রবাহে বিদগ্ধ, তখন সে মরিয়া হয়ে খুঁজছে একফোঁটা তৃষ্ণার বারি। তাকে একটু জল দিয়ে কেউ গলা ভেজাবে, এ বুঝি স্বপ্নই রয়ে যাবে। সিঁদুর মোছার যন্ত্রণা, প্রিয় সন্তানের বিয়োগব্যথা যখন তার অন্তরকে খুবলে খেতে শুরু করেছে, তখন চারপাশ থেকে যোগ হয়েছে হিংসা ও লোকনিন্দার করালগ্রাস। মাধুর মানসিক অবস্থা বেমালুম টালমাটাল। চোখ দুটি কোটরাগত; দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসছে। এলোকেশে ধূসর বর্ণের আধিক্য। নিদ্রাহীন রাত্রি, দুশ্চিন্তার পাহাড় তার হৃদয় ধারণকৃত বক্ষে পাথর চাপা দিয়ে রাখে অহর্নিশ। চোখে শর্ষে ফুল দেখতে দেখতে একদিন দেবুদার দেখা পেয়ে হর্ষে মেতে উঠল মন। এই বুঝি তার স্বপ্নের রাজকুমার।

দেবুদাই কি তাকে সাতসাগর-তেরো নদী পার হয়ে এসে রাক্ষসদের পাতালপুরী থেকে উদ্ধার করে নিয়ে যাবে নিজ ভুবনে? নাকি মাধুর জীবন আবার কোনো নতুন বিভীষিকায় নিমজ্জিত হবে? মনে হাজারো প্রশ্ন রাতদিন ঘুরপাক খায়। এদিকে দেবদাস মাধুকে জানায় তার মনের কথা। বহুদিন থেকে দেবদাস এমন মাধুকেই খুঁজছে, যাকে তার অনেক বেশি প্রয়োজন। মাধুর বান্ধবী রিতা ও তার বরের সহযোগিতায় চারহাত এক হলো। দুজন দুজনকে পেয়ে যেন স্বর্গসুখ পেল।

দেবু প্রায়ই বলত, ‘মাধু, তোমাকে পেয়ে আমি সত্যিই আজ ধন্য। এমন সুখময় সুখ কোনো দিন পাব, এ আমি কল্পনাই করতে পারিনি। তোমাকে প্রথম দেখাতেই অনেক ভালো লাগে। তবু আমার মনে একটু সন্দেহ থেকে যায়, তুমি সম্পূর্ণ আমার মনের মতো হবে কি না। কিন্তু আজ তোমাকে নিজের করে পেয়ে বলছি, তুমি ঠিক তা, যা মনেপ্রাণে চেয়েছিলাম; বরং তার চাইতেও বেশি কিছু।’

লজ্জায় রাঙা হয়ে মাধু বলে, ‘অমন করে বলো নাগো। বিধাতা হয়তো তোমার জন্যই আমায় রেখেছেন। আমারও যে মনতৃষ্ণা তুমিই পূরণ করছ। দেবু, আমার সঞ্চিত ভালোবাসার সবটুকু নিংড়ে তোমাতে সমর্পণ করতে পেরে আমিও ধন্য। কথা দাও, এ মায়াময় বন্ধন তুমি অমলিন রাখবে।’

বেশ কিছু সময় সুখের সাগরে ভাসতে ভাসতে অবশেষে বাস্তব সুতোয় টান পড়ে। দেবু তার পূর্ববাস্তবতা গ্যাঁড়াকলে ধীরে ধীরে আটকা পড়তে থাকে। যে বাস্তবতা তাকে একদিন যাযাবর বানিয়েছিল, যে বাস্তবতাকে একদিন সে দুমড়ে-মুচড়ে ভেঙে নতুন করে নিজের জন্য একটু প্রশান্তি খুঁজেছিল, তাই আজ আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। দেবু ফেঁসে গেল অবাঞ্ছিত গ্যাঁড়াকলে। এদিকে মাধু দেবুর পথ চেয়ে চেয়ে দৃষ্টি ঝাপসা করছে। তার হৃদয় আকাশের উজ্জ্বল দিবালোকে আবার তমসার ঘনঘটা। একমাত্র ভরসার জায়গায় হতাশার উলঙ্গ নৃত্য। দেবু তার কাছ হতে দূরে! বহু দূরে! তাকে ছুঁতে গিয়ে বারবার আছড়ে পড়ছে মাধু; নাগাল পাচ্ছে না। তার রক্তিম সিঁথি ক্রমে মলিন হয়ে পড়ছে। এখন তার সিঁথিতে সিঁদুর থাকলেও তা বিবর্ণ ও ধূসর।

দালাল বাজার, লক্ষ্মীপুর