ক্লাস ফোরে পড়ার সময় চোখে প্রথম চশমা উঠল। স্কুলে ব্ল্যাকবোর্ডের সব লেখা ঝাপসা দেখতে শুরু করেছি বলার পর, বাবা আমাকে চট্টগ্রামের জামালখানে বিলেতফেরত চক্ষু বিশেষজ্ঞ তরুণ প্রকাশ বিশ্বাসের কাছে নিয়ে গেলেন। প্রকাশ ডাক্তার বাবার স্নেহের পাত্র এবং পূর্বপরিচিত। পারিবারিক কোনো সম্পর্ক ছিল কি না, মনে নেই। তবে ডাক্তারের নামটা আজও ভুলিনি। তিনি বেশ যত্নসহকারে আমার প্রথম চোখ পরীক্ষা করেছিলেন। আমাকে চকলেট আর বাবাকে চা খেতে দিলেন। সেই ১৯৮৮-৮৯ সালেও ওনার প্রাইভেট চেম্বারে অত্যাধুনিক চক্ষু পরীক্ষার যন্ত্র, যাকে আজ আমরা সাধারণ ধারণায় বলি কম্পিউটারে চোখ পরীক্ষা; তা ছিল। শৈশবে প্রথম চক্ষু পরীক্ষা করাতে গিয়েই যন্ত্রের এক দিকে আমি চোখ রেখেছি, উল্টো দিকে তরুণ ডাক্তার দাদা। চোখের সামনে আকাশের তারার মতো কিছু একটা অদৃশ্য, দুটি চোখে ক্রমে দৃশ্যমান হয়।
সেই প্রথম চোখে চশমা উঠল। বছর তিনেক পরেও আবার চোখ পরীক্ষা করাতে গিয়েছিলাম। সেটাই ছিল প্রকাশ ডাক্তারের কাছে শেষ যাওয়া।
তখন আমার ঘন ঘন চশমা ভাঙত। পাথরঘাটার বাসাতে বিল্ডিংয়ের আবাসিক সমবয়সী সব বন্ধুরা মিলে নিচে ফুটবল খেলতাম। গির্জার মাঠে খেলতে যেতাম। ফুটবল নিয়ে কেউ খেলছে দেখলে স্থির থাকতে পারতাম না। খেলার সময় কখনো কখনো ভুলেই যেতাম চোখে চশমা রয়েছে। আবার চশমা খুলে খেলতে নেমে দূরের প্রতিপক্ষকে ঝাপসা দেখতাম। চোখ খচখচ করত। বেশিক্ষণ ওভাবে থাকতে ভালো লাগত না।
ফুটবল, ব্যাডমিন্টন খেলতে গিয়ে বেশ কয়েকবার চশমা ভেঙেছে। চশমা ভাঙলে প্রতিবার বাবার কাছে বকুনি ছিল অবধারিত। বারবার চশমার কাচ পাল্টাতে টাকা যেমন খরচ হয়, দোকানে গিয়ে দিয়ে আসা, নিয়ে আসা—এসবও মধ্যবিত্ত ব্যস্ত কর্মজীবী পরিবারের কাছে বেশ ঝামেলার বিষয়। তার ওপর আবার আমার নিজেরও সপ্তাহখানেক আংশিক অন্ধদশা কাটাতে হবে।
সবকিছু বুঝেশুনে-দেখে এবার একটু সতর্ক হতে শুরু করলাম। ক্লাস সেভেনে পড়ার সময় নতুন যে চশমাটা এল, জীবনের অবস্থান পরিবর্তন, গতিপথের বাঁকবদলের ফলে সেই চশমাটা নিয়ে আমার প্রায় পনেরো বছর কেটে গেল।
বাবা দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার পর শহরের বাসা, স্কুল ছেড়ে কিছুদিন গ্রামের বাড়িতে গিয়ে ছিলাম। সেখানে স্কুলে ভর্তি হয়েছি। চট্টগ্রাম শহর থেকে রাউজান উত্তরগুজরা গ্রামে আমাদের দেশের বাড়িতে যেতে হলে মদেরমহল নামের একটা জায়গায় গিয়ে বাস থেকে নামতে হয়। মদেরমহলে একজন চক্ষু চিকিৎসক বিনা মূল্যে চোখ দেখতেন। উত্তরগুজরা বিশ্বাস হাইস্কুলে কিছুদিন পড়ার সময় চোখে সমস্যা হওয়ায় সেই ডাক্তারবাবুকে একদিন দেখাতে গিয়েছিলাম। কিন্তু প্রকাশ ডাক্তারকে দেখানোর আমার সেই পুরোনো চোখের পাওয়ারের কার্ড দেখে ডাক্তারবাবু ফিরিয়ে দিলেন। অনুরোধ করা সত্ত্বেও চোখ দেখলেন না। বললেন, যাঁকে আগে দেখিয়েছ তাঁকে গিয়ে দেখাও।
লোকাল ট্রেনে গাদাগাদি, ভিড়ের মধ্যে যাতায়াত করতে হয়। ট্রেন থেকে নামার সময় একবার কারও হাতের ঝাপটানি খেয়ে, চোখ থেকে চশমা ছিটকে গিয়ে কাচ ভেঙে গেল।
সেবারই প্রথম বুঝলাম, অবস্থান আর পাত্রবিশেষে একজনের কথা অন্যজনের কাছে বলতে নেই। এই ডাক্তারবাবু গ্রামে বিনা মূল্যে চিকিৎসা পরিষেবা দেন, আর আমি একজন শহুরে ডাক্তারের কার্ড দেখানোতে ওনার ভেতরে কোথাও হয়তো লেগে গিয়েছিল। বিষয়টা আগে যদি বুঝতাম, তাহলে পুরোনো কাগজ দেখাতাম না।
জীবনের বাঁকবদল দুর্ভাগ্য আমাকে শহর থেকে গ্রামে এনে ফেলেছে। পুনরায় প্রকাশ ডাক্তারের কাছে গিয়ে দেখাব, সেই সামর্থ্য তখন আর নেই। চোখে সেই পুরোনো চশমা নিয়ে একসময় আমরা দেশ ছেড়ে চলে এলাম। জীবনে নেমে এল আরও চরম অন্ধকার, দারিদ্র্যতা। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে চোখের পাওয়ার বাড়তে থাকবে তা শুধু নয়, বয়সের সঙ্গে মুখের গঠনও পাল্টে যাবে। কৈশোরের চশমা যৌবনের মুখে এঁটে বসবে না, খাপ খাবে না। কিন্তু চাল আনতে পান্তা ফুরানো জীবনে চোখ দেখিয়ে নতুন চশমা নেওয়ার মতো ক্ষমতাও নেই। চশমার ডাঁটি ভেঙে গেল, তা-ও সেটি পরেছি। বহু বছর পর কলকাতায় ক্যানিং স্ট্রিটে একটি চশমার দোকানে প্রকাশ ডাক্তারের চেম্বারে দেখানো যন্ত্রে আবার চোখ দেখিয়ে নতুন করে চশমা নিলাম।
অল্প বয়স থেকেই কলকাতায় নানা ধরনের কাজকর্ম করে, টিউশন করে নিজের পড়াশোনার খরচ চালাতাম। অল্প সময়ের মধ্যে সংসারের হালও ধরতে হলো। লোকাল ট্রেনে গাদাগাদি, ভিড়ের মধ্যে যাতায়াত করতে হয়। ট্রেন থেকে নামার সময় একবার কারও হাতের ঝাপটানি খেয়ে, চোখ থেকে চশমা ছিটকে গিয়ে কাচ ভেঙে গেল। আরও দু-একবার নানা কারণে চশমার কাচ ভেঙেছে। প্রতিবার অন্ধের মতো ঝাপসা চোখে রাস্তাঘাটে চলাফেরা করতে হয়েছে। দোকানে গিয়ে চশমা বানাতে দিয়ে এসেছি, নিয়ে এসেছি। নিজের টাকাতে এখন চশমা বানাই। বাবার বকুনি খেতে হয় না। কিন্তু দাঁত থাকতে যেমন আমরা দাঁতের মর্যাদা বুঝি না, হঠাৎ চশমা না থাকলে বুঝতে পারি জীবন কতটা অসহায় হয়ে পড়ে।
৩০ বছর বয়সে এসে রক্তে সুগার এসে গেল। চোখের জ্যোতি ক্রমেই কমতে লাগল। পাওয়ার বাড়তে লাগল। বছর দুয়েক পরপর ডাক্তার দেখিয়ে চশমা পাল্টাতে হয়। আবার কোনো কারণে হঠাৎ একবার চশমার কাচ ভাঙলে মনে হয়, আরও একটা চশমা বানিয়ে রাখাটা এই কর্মব্যস্ত জীবনে খুবই জরুরি। মধ্যবিত্তের সামর্থ্যে যে কুলিয়ে ওঠে না। বছর তিনেক আগে তবু একসঙ্গে দুটো চশমা বানিয়ে রাখলাম।
সম্প্রতি আবার চোখে ঝাপসা দেখাতে ডাক্তারের কাছে গেলাম। এখন সুগারের জন্য এই ৪৩ বছর বয়সে রোজ রাতে পেটে ইনসুলিন নিই। সুগার রোগীদের চোখে ছানি চলে আসার সম্ভাবনা খুব বেশি। একেবারে অন্ধও হয়ে যেতে পারি। এই দুটো চোখ দিয়ে অনেকটা দেশ কাল সময় সাগর নদী পেরিয়ে এসেছি। দৃষ্টিপথজুড়ে অনেক ইতিহাস আর স্মৃতি। চোখ দুটোকে আরও কিছুটা সময় ভালো রাখা দরকার নতুন অনেক কিছু দেখার, পড়ার আর লেখালেখি করার জন্য।
ডাক্তার দেখে পাওয়ার পাল্টে দিলেন। চশমার দোকানদার বললেন, ফাইবার লাগিয়ে নিন। এখন আর কাচ কেউ লাগায় না। দামও খুব বেশি হেরফের নয়। ফাইবার বেশি চলে বলে কাচেরও দাম বাড়িয়ে রেখে দিয়েছে। আমি বললাম, ঠিক আছে তাই বানিয়ে দিন।
ফাইবার লাগানো দুটো চশমা হাতে চলে এল এখন। চোখ ক্রমেই নষ্ট হচ্ছে, সেই দুঃখের থেকেও মনে মনে এই ভেবে আনন্দ পেলাম, এখন তো আর চশমা ভাঙার কোনো উপায় নেই। ভিড় ট্রেনে নামা-ওঠার মুখে চোখ থেকে ছিটকে গেলেও ফাইবার তো আর কাচের মতো টুকুস করে ভেঙে যাবে না। তা-ও যদি একটা ভাঙে, দ্বিতীয়টা দিয়ে নিজেকে রক্ষা করে নেব।
হায়রে আমার হারানো দিন। তখন যদি এই রক্ষাকবচ থাকত!
হাওড়া, কলকাতা, ভারত