হৃদয়ের গহিনে তুমি বাংলাদেশ

লেখাটি ২০২৪ সালের জুনে প্রকাশিত বন্ধুসভা জাতীয় পরিচালনা পর্ষদের ‘তারুণ্য’ ম্যাগাজিনের দশম সংখ্যা থেকে নেওয়া।

বাংলাদেশের পতাকাছবি: সংগৃহীত

১৯৯০-৯১ সালে যখন চট্টগ্রাম নিউমার্কেটের ভেতর দিয়ে মিউনিসিপ্যাল মডেল হাইস্কুলে যেতাম, নিউমার্কেটকে তখন আমরা বলতাম বিপণিবিতান। একটা বইয়ের দোকানে সাজানো অনেক ম্যাগাজিনের মধ্যে কলকাতার নামকরা দু-একটা ম্যাগাজিন দেখতে পেতাম। বইয়ের দোকানে দাঁড়িয়ে বই, ম্যাগাজিন উল্টেপাল্টে দেখা ছোটবেলা থেকেই অভ্যাস। সেই পাতা উল্টে দেখতে গিয়েই সম্পাদকীয় দপ্তরের ঠিকানা দেখেছি কলকাতা। মার্কেটের বাইরে ফুটপাতে হকারের কাছেও কলকাতার পূজাসংখ্যা চোখে পড়েছে। কিন্তু উদ্বাস্তু হয়ে পশ্চিমবঙ্গে চলে আসার পর কলকাতা বইমেলা ছাড়া বাংলাদেশের কোনো ম্যাগাজিন আমি কলকাতার রাস্তাঘাটে দেখতে পাইনি।

ময়দানে যখন কলকাতা বইমেলা বসত, তখনো সুসজ্জিত বাংলাদেশ প্যাভিলিয়ন থাকত। পকেটে বই কেনার টাকা থাকত না। বাংলাদেশের বইপত্র, ম্যাগাজিন উল্টেপাল্টে দেখে প্রাণে তখন বেশ আরাম পেতাম। একবার বিচিত্রা নামের একটা ম্যাগাজিনের একুশে ফেব্রুয়ারি সংখ্যা কিনেছিলাম। সেই ম্যাগাজিন পড়ে সম্পাদকের কাছে চিঠি লিখে পাঠিয়েছি। অবাক হয়ে গিয়েছিলাম, বিচিত্রাতে প্রকাশিত আমার চিঠি পড়ে চট্টগ্রামে আশু মেডিকেল হলের মুন্না নামের এক পাঠক আমার ভাড়া বাসার ঠিকানায় আবেগমথিত একটা সুন্দর চিঠি পাঠিয়েছিলেন। আমার হারিয়ে ফেলা দেশের অজানা, অচেনা বন্ধুর কাছ থেকে চিঠি পেয়ে সেদিন আনন্দে চোখে জল চলে এসেছিল। কিন্তু কলকাতার ম্যাগাজিনের ভিড়ে কেন যে বাংলাদেশের ম্যাগাজিন সাজানো থাকে না, তা ভেবে আজও কষ্ট লাগে।

এখন আমার আর বইমেলায় যাওয়া হয় না। কলকাতার উৎসব-অনুষ্ঠানেও যাওয়া হয় না। বামপন্থী সরকারের আমলে কবিতা উৎসবে গিয়ে শামসুর রাহমান, বেলাল চৌধুরী, রেজাউদ্দিন স্টালিনদের কণ্ঠে কবিতা শুনেছি। কলকাতার একটি সংবাদপত্রের এক কবি ও সাংবাদিক সরকারি কবিতা উৎসব নিয়ে লিখেছিলেন। বাংলাদেশের নির্দিষ্ট কিছু কবির সঙ্গে কলকাতার নির্দিষ্ট কিছু কবির ভাব রয়েছে। প্রতিবার বাংলাদেশের একই কবিরা কলকাতায় সরকারি কবিতা উৎসবে আমন্ত্রণ পেতেন এবং পশ্চিমবঙ্গের নির্দিষ্ট কবিরা বাংলাদেশ যেতেন। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শঙ্খ ঘোষ, শামসুর রাহমান, হুমায়ূন আহমেদ দুই বাংলার অভিভাবকপ্রতিম হয়ে উঠেছিলেন। দুই বাংলার অসংখ্য বইয়ের সম্পাদনার নামের তালিকায় এই অভিভাবকদের নাম দেখে আনন্দ পেতাম। একই সঙ্গে আরও বেশিসংখ্যক বাংলাদেশের কবি-লেখক কেন কলকাতায় আমন্ত্রণ পেতেন না, তা ভেবে দুঃখ হতো। ক্রমে দেখলাম, বাংলাদেশের যেসব কবি, লেখক, চিত্রপরিচালক নিয়মিত কলকাতায় যাতায়াত করেন, এখানকার বিশিষ্টজনদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন, তাঁরাই একমাত্র পশ্চিমবঙ্গে বেশ পরিচিতি লাভ করেন।

ছোটবেলায় চট্টগ্রামে শহরে ভিসিআরে হিন্দি সিনেমা দেখে অমিতাভ বচ্চন, মিঠুন চক্রবর্তী, হেমা মালিনী, শ্রীদেবী অনেককে চিনতে শিখে গেছি। চট্টগ্রামে একটি সিনেমা হলে (নামটা ভুলে গেছি ) সেই নব্বইয়ের দশকে এক দাদার সঙ্গে গিয়ে হিন্দি সিনেমা দেখেছিলাম। কলকাতার উত্তম-সুচিত্রা থেকে শুরু করে প্রসেনজিৎ, দেবশ্রী রায়, ভিক্টর ব্যানার্জিদের কত সিনেমা সেই অল্প বয়সে দেখেছি।

কলকাতায় আসার পর দেখলাম, বাংলাদেশের শাবানা, কবরী, ইলিয়াস কাঞ্চন, আলমগীরদের নাম পর্যন্ত কলকাতার সাধারণ মানুষেরা কোনো দিন শোনেননি। যাঁরা চলচ্চিত্রের খবরাখবর রাখেন, বড়জোর রাজ্জাককে চিনতেন। সত্যজিৎ রায়ের মৃত্যুর খবর শুনে আমাদের স্কুল তাড়াতাড়ি ছুটি হয়ে গিয়েছিল। বাসায় ফিরে বাংলাদেশ টেলিভিশনে পথের পাঁচালী দেখেছি। আলমগীর কবীর বা তারেক মাসুদের মৃত্যুর পর কলকাতার টেলিভিশন কিন্তু তাঁদের চলচ্চিত্র দেখায়নি। মাঝেমধ্যে নন্দনে শুধু বাংলাদেশের চলচ্চিত্র আসত।

কলকাতার একশ্রেণির দর্শকের মধ্যে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র সম্পর্কে একটা ভুল ধারণা, হীনম্মন্যতা কাজ করত। গৌতম ঘোষের মতো পরিচালক দুই বাংলার যৌথ উদ্যোগে পদ্মা নদীর মাঝি বানিয়েছেন। পরবর্তী সময়ে দুই বাংলার মিলিত প্রয়াসে আরও অনেক চলচ্চিত্র হয়েছে, তাতেও বাংলাদেশ সম্পর্কে সম্পূর্ণ ধারণা অনেকেই পাননি। অথচ বেদের মেয়ে জোৎস্না দেখে অঞ্জু ঘোষের অনেক অনুরাগী পশ্চিমবঙ্গের গ্রামবাংলায় তৈরি হয়ে গেছে। শুধু প্রচারের অভাবে এবং চলচ্চিত্র প্রদর্শনে আইনি জটিলতায় বাংলাদেশের চলচ্চিত্রশিল্পীরা কলকাতায় প্রচার পাননি। এখন অবস্থা অনেকটা পাল্টেছে। ফেরদৌস, চঞ্চল চৌধুরী, জয়া আহসানরা দুই বাংলা দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। গত বছর কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবে বাংলাদেশের বেশ কিছু চলচ্চিত্র এসেছিল। কুড়া পক্ষীর শূন্যে উড়া শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেছে। এ বছরও বাংলাদেশে অনেক ভালো ভালো চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। শুধু একটি চলচ্চিত্র কেন কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবে এল, জানি না। তবে বাংলাদেশ উপদূতাবাসের উদ্যোগে এখন প্রতিবছর কলকাতায় বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উৎসব হয়, বাংলাদেশ বইমেলা আয়োজিত হয়। দুই বাংলার সংস্কৃতির আদান-প্রদানে এগুলো ইতিবাচক বিষয়।

গোটা পশ্চিমবঙ্গে দেশ ছেড়ে আসা উদ্বাস্তুরা বাংলাদেশকে তো এমনিতেই হৃদয়ে ধরে রেখেছেন। যশোর রোড, বাঘাযতীন কলোনি, চট্টেশ্বরী মন্দির, ঢাকেশ্বরী বস্ত্রালয়, মাস্টারদা সূর্য সেন স্কুল, শেখ মুজিব সড়ক—কতভাবে যে শিকড়ের টান ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। আনন্দবাজার পত্রিকা গোষ্ঠীর মতো বড় বড় প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা বাংলাদেশের মানুষ। দেশ ছেড়ে আসা উদ্বাস্তুরা জীবনের সঙ্গে লড়তে লড়তে কেউ কেউ একসময় নিজেকে দাঁড় করিয়ে বড় বটবৃক্ষ হয়ে ওঠেন। অনেককে ছায়া দেন। আবার কেউ জীবনের কাছে হেরে যান।

আমার চোখের সামনেও অনেক দেশ ছেড়ে আসা মানুষকে প্রতিদিন কঠিন লড়াই করে টিকে থাকতে দেখেছি। বর্তমানে যে বিয়ারিং সংস্থায় চাকরি করি, আমার বাবার বয়সী একজন মানুষ এখানে মাল ডেলিভারি দেওয়ার চাকরি করতে এসেছিলেন। আমি অরূপ কাকা বলে ডাকতাম। অরূপ কাকার কাছে শুনেছি, মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি বাংলাদেশ ছেড়ে এসেছেন। উদ্বাস্তু কলোনিতে কাকিমার সঙ্গে প্রেম হয়। দুজনের মেলামেশাতে বিয়ের আগেই কাকিমার গর্ভে সন্তান চলে আসে। এরপর দুজনে সংসার পাতেন। কখনো এই সংস্থা, কখনো ওই সংস্থা—এভাবে চাকরি করে অরূপ কাকা জীবিকা নির্বাহ করতেন। আমাদের সংস্থায় চাকরি করার সময় একদিন দুপুরে বিয়ারিং গুছিয়ে আমার থেকে যাতায়াত খরচের টাকা নিয়ে বেরিয়েছিলেন। কিছুক্ষণ পর ট্রাফিক পুলিশের ফোন আসে। অরূপ কাকা রাস্তায় হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছেন।

লড়াই করে যে উদ্বাস্তুরা প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠতে পারেন, তাঁদের কথা শুধু সবাই জানতে পারেন। অরূপ কাকার মতো উদ্বাস্তুরা অনেক বয়সেও জীবনের সঙ্গে লড়াই করতে করতে হঠাৎ হারিয়ে যান। পশ্চিমবঙ্গের বাতাসে এভাবেও বাংলাদেশের মানুষের শ্বাসপ্রশ্বাসের ইতিহাস মিলিয়ে যায়।

হাওড়া, কলকাতা, ভারত