মোনালিসা

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
দ্রুত হাঁটার চেষ্টা করছি। কিন্তু কেন জানি মনে হচ্ছে, সরল রাস্তাটার ওপর এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছি এখনো। যতই হাঁটছি পথ শেষ হচ্ছে না!

অনেক দিন পর গ্রামে ফিরলাম। একটি মফস্‌সল শহরে থেকে চাকরি করি।

নেত্রকোনা জেলার কাশীপুর গ্রামে আমার জন্ম। শৈশবের একটা অংশ কাটার পর ভৈরবে চলে আসা। বিএ পাস করার পর এখন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছি। মধ্যে বেশ কিছুদিন গ্রামে থাকতে হয়েছিল। জমি নিয়ে ঝামেলা চলছিল। বাবা আমাকে সঙ্গে নিয়ে যান।

যাক সে কথা। দরকারি কাজে এসেছি। দুই-তিন দিন থাকতে হবে। ভাবলাম, এই দিনগুলোতে নিজেদের পরিত্যক্তপ্রায় বাড়িটাতেই রাত কাটাব। বিদ্যুৎ না থাকলেও তেমন অসুবিধা হবে না। বাবার ছোটবেলার বন্ধু আছেন একজন। কেরামত আলী, বয়স ষাটের অধিক হলেও বেশ শক্ত-সামর্থ্য। তিনি খাতিরযত্ন করবেন। এর আগেও যে কয়েকবার আসা হয়েছিল, তিনিই দেখভাল করেছেন। অত্যন্ত খুশিমনেই সব করেছেন।

এবার যেতেই তিনি আবদার করলেন, যেন এই কয়েকটা দিন তাঁর বাসায় থেকে যাই। বললাম, এ বাড়িতে কত দিন ধরে পা ফেলি না। বাবার স্মৃতি লেগে আছে।
বাবা মারা গেছেন এক বছর হতে চলেছে। কেরামত চাচা আর পীড়াপীড়ি করলেন না। সকালে আর রাতে খাবার নিয়ে আসেন। দুপুরে নিজের কাজে বাইরে থাকি। হোটেলে খাওয়াদাওয়া হয়।

কোনো সমস্যা হচ্ছিল না। তৃতীয় দিন বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত সাড়ে এগারোটা বেজে গেল। গ্রামে রাত সাড়ে এগারোটা মানে মধ্যরাত। মূল রাস্তা থেকে নেমে কাঁচা রাস্তাটা ধরে হাঁটতে লাগলাম। আকাশে মেঘ জমে আছে। দক্ষিণ-আকাশে কিছুক্ষণ পরপর বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। আবার ফাঁকে ফাঁকে তারা দেখা যাচ্ছে। মুগ্ধ হয়ে দেখার মতো আকাশ। সাধারণত চাঁদ ছাড়া আকাশ এত সুন্দর দেখায় না।

মাটির রাস্তা কিছুটা প্রশস্ত হলেও হাঁটতে অসুবিধা হচ্ছিল। হাতে থাকা টর্চ অন করলাম। গ্রামে ঢুকতে অনেকটা পথ। গ্রামের মুখে কয়েকটি দোকান, তার আগে কয়েকটি বাড়ি একসঙ্গে; রাস্তার পাশেই। দোকানগুলো পেরিয়ে এক মিনিট হাঁটলে খালপাড়। এই খালপাড় নিয়ে আশপাশের দশ গ্রামের মানুষের মনে বিশেষ ভীতি কাজ করে।

দোকানগুলোর সামনে চলে এসেছি। এখন আর ওনাকে দেখা যাচ্ছে না। কিছু দূর গেলেই খালপাড়। খালে পানি আছে। সাঁকো দিয়ে পার হতে হবে।

খালপাড় পেরিয়ে জঙ্গলের ভেতরে পথ। সেই পথ দিয়ে যেতে হবে আমাদের বাড়িতে। জঙ্গলটা পার হলেই বাড়ি। রাস্তায় মানুষের যাতায়াত একেবারেই নেই। ঝিঁঝি পোকার ডাক কানে আসছে। রাস্তার দুই পাশে ফসলি খেত। ওপরে আকাশ, নিচে আমি একা হাঁটছি।
দ্রুত হাঁটার চেষ্টা করছি। কিন্তু কেন জানি মনে হচ্ছে, সরল রাস্তাটার ওপর এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছি এখনো। যতই হাঁটছি পথ শেষ হচ্ছে না! কিছুক্ষণ পর বাড়িগুলো চোখে পড়ল। মাটির রাস্তাটা হেঁটে পার হলে ১০ থেকে ১৫ মিনিট সময় লাগে। বারবার ঘড়িতে সময় দেখছি। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে থেকে একবার হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলাম। হাত থেকে পড়ে গেল টর্চটাও। ভাগ্য ভালো, টর্চটা বন্ধ হয়নি। তাহলে হয়তো আর খুঁজে পেতাম না।
বাড়িগুলোর খুব কাছাকাছি চলে এসেছি। দ্রুত হাঁটার কারণে শরীর গরম হয়ে গেল। গলাও গেল শুকিয়ে।

রাস্তার ডান পাশে বাড়ি। সেখানে যেতেই ‘গড়গড়’ অদ্ভুত আওয়াজ কানে আসতে লাগল। এ আবার কী! কাশির শব্দ শুনতে পেলাম। খুক খুক শব্দে দুবার কাশি দিল কেউ একজন। এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখলাম টর্চ ফেলে। চোখে কিছুই ভাসল না। হঠাৎ একজন বলল, ‘ক্যালা, অত রাইতে বাড়িত যা?’
কিছুটা বিভ্রান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। কথা শুনছি, কিন্তু দেখতে পাচ্ছি না!
‘ডাইনে চায়া দেহ।’
এবার টর্চটা ডান দিকে ফেলে দেখলাম, কলাপাতার দেয়ালের ফাঁকে এক বৃদ্ধ লোক দাঁড়িয়ে, অস্পষ্ট। আড়াল থেকে সামনে আসার পর দেখতে পেলাম তার ডান হাতে হুঁকাটি। তাহলে এতক্ষণ হুঁকার শব্দ পাচ্ছিলাম। ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম প্রায়।
বাঁ হাতে রাখা হারিকেনের আলো বাড়িয়ে সেটাকে উঁচু করে ধরে আমাকে দেখে বললেন, ‘তুমি হাছান মিয়ার পুত শরিফ না?’
আমি বললাম, ‘জি, চাচা।’
‘আমারে চিনছ? ওই যে তোমার লগে ছেরিডারে লইয়া আদমপুর হাসপাতাল গেছিলাম?’
‘জি, মনে আছে।’
‘অত রাইতে বাড়িত আইলা?’
‘কাজ শেষ করে আসতে একটু দেরি হয়ে গেল।’
বৃদ্ধ লোকটি বললেন, ‘আইচ্ছা যাও। দিনের বেলা আইও কিন্তু। একলা একলা যাইতে পারবা? আগাইয়া দিতাম?’
খুশি হওয়ার মতো করে বললাম, ‘না, চাচা। আমি যেতে পারব।’
‘আইচ্ছা সাবধানে যাইয়ো।’

লোকটি মোনালিসার বাবা। কয়েক কদম হাঁটার পর পেছনে ফিরে দেখলাম, তিনি হারিকেনটা উঁচু করে ধরে দাঁড়িয়ে আছেন আমাকে সাহস দেওয়ার জন্য। হারিকেনের হলুদ আলো পড়েছে তাঁর চেহারায়। বয়সের ভারে কুঁচকে যাওয়া ভ্রু জোড়াতে যেন অন্ধকার রাত এসে আশ্রয় নিয়েছে। আর চোখ দুটিতে পুরোনো একটা মায়ার চাদর জড়িয়ে আছে। সেটা কৃতজ্ঞতা কিংবা অভিযোগের বিশাল রাজত্ব ঘিরে। আমি তা আজও টের পাই। সন্ধ্যার আকাশে সোনালি ডানা মেলে গন্তব্যের উদ্দেশে উড়ে যাওয়া পাখিটি গন্তব্যে পৌঁছায়। কিন্তু আমি জানি, আমাকে সাহস জোগানো ব্যক্তিটির সেই সোনালি ডানা ভেঙে গেছে বিনা কারণে আকস্মিক ঝড়ে।

দোকানগুলোর সামনে চলে এসেছি। এখন আর ওনাকে দেখা যাচ্ছে না। কিছু দূর গেলেই খালপাড়। খালে পানি আছে। সাঁকো দিয়ে পার হতে হবে। জায়গাটা অনেক অন্ধকার। এপাড়-ওপাড় দুই পাড়েই ঝোপঝাড় আর বিরাট গাছ। তারপর দুই-তিন মিনিট লাগবে জঙ্গল পেরিয়ে বাড়ি পৌঁছাতে। তবে ভয়ের বিষয় হচ্ছে এই দুই-তিন মিনিটের পথ। জায়গাটা জঙ্গলে পরিপূর্ণ। দিনের বেলাতেও নীরব থাকে। অনেকটা বোবা মানুষের মতো। নির্বাক, নিস্তব্ধ আর থমথমে পরিবেশ। আমি মোটেও অশরীরীকে ভয় করছি না। ভয় হচ্ছে ডাকাতের। দিনের বেলাতেও মাঝেমধ্যে খুন হয় শুনি। প্রস্তুত হয়ে আছি ডাকাত সামনে পড়লেই মোবাইল, মানিব্যাগ সব দিয়ে দেব।

মেয়েটি আমার দিকে অপলক তাকিয়ে আছে। টর্চটা ওর দিকেই ধরে রাখলাম। আবার জিজ্ঞেস করলাম, ‘কে তুমি? কথা বলছ না কেন?’

টর্চ ফেলে এগোচ্ছি। সাঁকোর কাছাকাছি যেতেই টর্চের আলো কমে আসতে লাগল। বুঝলাম, চার্জ শেষ হতে চলেছে। বাতাস বইতে শুরু করে হঠাৎ। চেষ্টা করলাম দ্রুত চলে যেতে। টর্চের আলোর ওপর অনেক কিছু নির্ভর করছে। চার্জ পুরোপুরি শেষ হয়ে গেলে সব শেষ। আগেও যেতে পারব না, পিছেও নয়। হবে কী তখন? ভাবতেই ভয়ে গা শিউরে উঠছে।
সাঁকোর ওপরে পা রাখতেই সাঁকোটা নড়েচড়ে উঠল। মাত্র দুটি বাঁশ দিয়ে বানানো এ সাঁকো। একটি বাঁশ পায়ের নিচে, অন্যটি হাতে ধরে ধরে যাওয়ার জন্য। এমনিতে ভেঙে পড়ার আশঙ্কা নেই অবশ্য।
যখন মাঝপথ অতিক্রম করলাম দেখলাম, পাড়ে একটি মেয়ে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বয়স ১৭ কিংবা ১৮ হবে। টর্চের আলোয় শাড়িতে লাগানো পুঁতিগুলো ঝলমল করছে। তার গোলাকার সুশ্রী চেহারা থেকে চোখ ফেরানো দায়! দেবীর মতো টানা টানা চোখ যেন নিশীথে ফোটা শাপলার মতোই। গা ভর্তি গয়না। সাধারণত কেউ একা এত রাতে নির্জন পথে এভাবে বধূ বেশে বের হবে না।

ভয়ে শরীরে কাঁপুনি ধরে এল। গলা এতক্ষণ শুকিয়ে গিয়েছিল। এখন কাঠ হয়ে গেছে। নিচে পানি ছুটে চলেছে মৃদু গতিতে। মনে মনে ভাবছি, যদি নিচে পড়ে পানিতে ডুবতে হয়, তখন বাঁচাবে কে? পা তো নড়ছেই না। একবার ভাবলাম, পেছনে ফিরে যাই। আবার ভাবলাম, সামনের দিকেই এগিয়ে যাই। কিন্তু পাড়ে ওই মেয়েটিকে দেখে ভীষণ ঘাবড়ে গেছি। নিজেকে এই বলে সান্ত্বনা দিচ্ছি যে মানুষের মতো দেখতে যে সে তো মানুষই হবে।
জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুমি কে?’
মেয়েটি আমার দিকে অপলক তাকিয়ে আছে। টর্চটা ওর দিকেই ধরে রাখলাম। আবার জিজ্ঞেস করলাম, ‘কে তুমি? কথা বলছ না কেন?’
এবারও কোনো কথা বলল না। ইতিমধ্যে প্রবল বেগে বাতাস বইতে শুরু হলো। গাছের শাখা-প্রশাখাগুলো ভয়ানকভাবে দুলতে শুরু করেছে। শুকনা পাতা ঝরে পড়ছে আর দক্ষিণের আকাশে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে আগের মতোই। অথচ মেয়েটি এখনো সেভাবেই দাঁড়িয়ে আছে। এবার সত্যিই বুকটা দুরু দুরু কাঁপতে লাগল। যেখানে মেয়েরা তেলাপোকা দেখলে চিৎকার করে, সেখানে এত বড় ঝড় বইতে শুরু করার পরও স্থির দাঁড়িয়ে! যেন পাথরের মূর্তি।

সাঁকো থেকে পড়ে যাওয়ার শঙ্কায় বাঁশের খুঁটিতে শক্ত করে ধরে দাঁড়িয়ে রইলাম। সাঁকোটা দুলতে শুরু করেছে। চেয়ে দেখলাম, মেয়েটি ধীরভাবে হেঁটে আসছে। আমার দিকে তার অপলক দৃষ্টি। এক পা সাঁকোতে ফেলল। এগিয়ে আসতে লাগল আমার দিকেই। সে কেবল পায়ের নিচের বাঁশটি ব্যবহার করে অনায়াসে এবং স্বাচ্ছন্দ্যে হেঁটে আসছে। পেছনে দৌড় দেব কি না, ভাবছি। সাঁকোটা এমনভাবে দুলছে যে এই বুঝি পড়ে যাই পানিতে। কোথায় যেন শুনেছিলাম, এমন পরিস্থিতিতে পানিতে পড়লে সর্বনাশ! চুবিয়ে মেরে একেবারে পুঁতে রাখবে।
হাতের টর্চটা পকেটে রেখে দুই হাতে বাঁশের খুঁটি চেপে ধরলাম। আর যা-ই হোক পড়ে যাওয়া চলবে না।

কোনো রকম আলো না থাকায় মেয়েটিকে অন্ধকারে এতটা স্পষ্ট দেখার কথা নয়। তবু দেখতে পাচ্ছি। সে ধীরে ধীরে আমার কাছে চলে এসেছে। দুজনের দূরত্ব কেবল এক হাত পরিমাণ হবে। ইচ্ছে করলেই সে আমার গলা চেপে ধরতে পারে কিংবা ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে পানিতে চুবিয়ে মারতে পারে। বাক্‌রুদ্ধ রোগীর মতো শুধু হাঁ করে চেয়ে দেখছি। কিছুই বলতে পারছি না।
‘চিনতে পেরেছ আমায়? আমি মোনালিসা।’
মেয়েটির কথা শুনে আর গলাটা চিনতে পেরে মনে হচ্ছিল, এখনই অজ্ঞান হয়ে যাব। জোরে একটা চিৎকার দেব ভাবছিলাম। গলায় কোনো জোর পাচ্ছি না। মাছ যেমন পানির ওপরের স্তরে ওঠে এসে পানি থেকে দুটি ঠোঁট বের করে অক্সিজেন নিতে থাকে, আমি ঠিক তেমনটাই করছি। ঠোঁট নড়ছে, কিন্তু কোনো আওয়াজ বের হচ্ছে না। চিৎকার করার যত চেষ্টা করছি, ততই কষ্ট হচ্ছে। শরীর ঘেমে একাকার হয়ে গেছে আমার। মোনালিসাকে চিনতে পেরেছি ঠিকই। চিনতে পেরেছি বলেই এবার ভয় হচ্ছে আরও বেশি।
মোনালিসা ডান হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে চোখের ইশারায় ওর হাতটা ধরতে বলল। ধরছি না বলে ভ্রু নেড়ে প্রশ্ন করল। যার অর্থ হচ্ছে, ধরছ না কেন?
ভয়ে ভয়ে ওর হাতটা ধরলাম। নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে সে আমার হাতটাকে চেপে ধরল। কিছুতেই অতিপ্রাকৃত বলে মনে হলো না। এই স্পর্শ চিরকালই আমার কাছে অকৃত্রিম ছিল।
তারপর মোনালিসা হাঁটতে শুরু করল পাড়ের দিকে। এদিকে বাতাস বয়েই চলেছে। আমার মুখ দিয়ে অস্পষ্ট স্বরে উচ্চারিত হলো ‘মোনালিসা’। ঠিক তখনই সে পেছনে ফিরে ইশারায় কোনো প্রকার কথা বলতে নিষেধ করে দিল। আমি চুপ হয়ে রইলাম। যেন সে আমাকে আসন্ন বিপদ থেকে দক্ষ এবং চতুরতার সঙ্গে নিরাপদে নিয়ে যেতে এসেছে।

সেই রাতে একমুহূর্তও ঘুমাতে পারিনি। চোখের পাতা এক হতেই কেবল অন্ধকার রাতের অনাকাঙ্ক্ষিত সেই সব দৃশ্য ভেসে ওঠে।

ধীরে ধীরে সাঁকো পার হলাম। মোনালিসা দাঁড়াল না। আমাকে নিয়ে বাড়ির কাছাকাছি চলে এল। এখানে এসে দেখলাম, বাতাস বলতে কিছু নেই। এমনকি বাতাস এলে গাছের শুকনা পাতা যে ঝরে পড়ে, তারও কোনো প্রমাণ পাওয়া গেল না।
ভয়ে অস্থির ছিলাম। এখন বাড়ির কাছাকাছি আছি বলে ভয় কমে গেছে। অদ্ভুত ব্যাপার হলো, মোনালিসাও আমার পাশে দাঁড়িয়ে আছে এবং হাতটাকে ধরেই দাঁড়িয়ে আছে। ওর হাতটা এখন অসম্ভব রকমের হালকা লাগছে। কী বলব বা কী করব এখন, তা বুঝে উঠতে পারছি না। শুধু ওর চোখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। স্বপ্ন দেখছি না, এ কথা যেমন সত্য, তার চেয়ে বেশি সত্য হলো, এটা কখনোই সম্ভব হতে পারে না।
মোনালিসা কোমল স্বরে বলল, ‘ঘরে নেবে আমায়?’
আমি বললাম, ‘তুমি সত্যিই মোনালিসা?’
‘হ্যাঁ।’
‘কিন্তু তুমি তো...।’
সে হাসতে শুরু করল। তার হাসিটা সুশ্রী আর ঝনঝনে। এই হাসির অর্থ তখন বুঝতে অসুবিধা হয়েছিল ঠিকই; কিন্তু আজ তার সেই হাসির অর্থ একেক সময় একেকভাবে অনুধাবন করি। সবটাই অর্থহীন আবার সবটাই অমূল্য যেন।
হাসি থামিয়ে বলল, ‘খালপাড়ে ভয় পেয়েছিলে? ঝড় আমি তুলিনি। তোমায় বাঁচিয়ে দিয়ে গেলাম। আর কখনো এত রাতে একা এ পথ দিয়ে যাবে না। যাও, ঘরে গিয়ে বিশ্রাম করো।’
আমি মাথা নাড়ালাম। মোনালিসা হাতটা ছেড়ে দিয়ে বলল, ‘আমি তাহলে যাই।’ বলেই সে চলে যেতে লাগল। আমি বললাম, ‘আমার ঘরে আসবে না তুমি?’

মোনালিসা পেছনে ফিরে দেখল। সামান্য হেসেছে দেখতে পেলাম। তারপর জঙ্গলের সেই পথ দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেল। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম সেখানে। ইচ্ছে হচ্ছিল আবার ছুটে যাই ওর কাছে। কিন্তু ওকে এখন পাব কোথায়? রাত অনেক হয়েছে।

আজ আমার এই গল্প অবিশ্বাস্য বটে! কিন্তু মোনালিসা ছিল। সে আমাকে অশুভ কিছুর হাত থেকে প্রাণে বাঁচিয়েছে। তাকে বিশ্বাস করিনি প্রথমে। চিনতেই পারিনি। অথচ সে আমাকে ভুলে যায়নি এত সহজে। আমি বড় অকৃতজ্ঞ।

কেরামত চাচা হারিকেন হাতে নিয়ে এদিকে আসছেন দেখতে পেলাম। অন্য হাতে ওটা নিশ্চয়ই টিফিন ক্যারিয়ার। কাছে এসে বললেন, ‘আইজ এত রাইত কইরা বাসায় আইলা যে?’
আমি বললাম, ‘সব কাজ শেষ করে এসেছি। আগামীকাল চলে যাব।’
‘ভালা কথা। যাওনের আগে তোমার চাচিরে দেইখ্যা যাইয়ো।’
আমি মাথা নাড়লাম। তারপর ঘরে গিয়ে মোমবাতি জ্বালিয়ে দিলাম। গ্রামে বিদ্যুৎ এসেছে। আমাদের ঘরটা সব সময় খালি পড়ে থাকে, তাই বিদ্যুৎ-সংযোগ দেওয়া হয়নি।
চাচাকে বললাম খাবার নিয়ে যেতে। একটা রেস্টুরেন্টে রাতের খাবার খেয়ে এসেছি। আমার খাওয়া হয়ে গেছে শুনে চাচার চোখেমুখে একটা আহত ভাবের উদয় হলো যেন। সত্যিই তো, গ্রামে রাত ১২টা মানে অনেক রাত। আর চাচা কিনা এতটা রাত জেগে ছিলেন আমারই জন্য! খাবারটা রেখে দেওয়ার কথা ভাবলাম।

সেই রাতে একমুহূর্তও ঘুমাতে পারিনি। চোখের পাতা এক হতেই কেবল অন্ধকার রাতের অনাকাঙ্ক্ষিত সেই সব দৃশ্য ভেসে ওঠে। একজন সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে না গেলেই নয়।
সকালে ভীষণ জ্বরে গা পুড়ে যেতে লাগল। জ্বর নিয়ে আর ফেরা হলো না। দুদিন অতিরিক্ত ছুটি নিতে হয়েছে। তারপর কিছুটা সুস্থ হতেই আর সেখানে পড়ে থাকতে ইচ্ছে হলো না। ভৈরবের উদ্দেশে রওনা হলাম।

একটা প্রশ্ন মাথায় থেকে গিয়েছে, যে মেয়েটির কবরে আমি নিজে মাটি ঢেলেছি, সেই মেয়ে আমার সামনে এল, প্রাণ বাঁচাল! আজও সে কথা ভাবলে শিউরে উঠি। দুঃখ হয় মোনালিসার জন্য। যেদিন ওর বিয়ে হচ্ছিল, সেদিন গ্রামেই ছিলাম। ওর সঙ্গে যে আমার প্রেম হয়েছিল, সে কথা দুয়েকজন হয়তো জেনেছিল। আর জানত ওর চাচাতো বোন মিলি। সে-ই আমাকে সবার অগোচরে ডেকে বলেছিল, হঠাৎ অন্যত্র বিয়ে হওয়াটাকে কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না মোনালিসা। তাই মধ্যরাতে নাকি আমার কাছেই ছুটে আসছিল। কিন্তু সে যে পৌঁছাতে পারবে না, সে কথা কে জানত!

ওই সাঁকোর পাড়ে ক্ষত-বিক্ষত অবস্থায় পড়েছিল মোনালিসার নিষ্কলুষ দেহ। সে কি ডাকাতের কবলে পড়েছিল, নাকি তাকে সেই ভয়াল রাতের কোনো নির্জীব পাষণ্ডের বিষম শক্তির বলি হতে হয়েছিল, তা আজও সবার অজানা।

বন্ধু, ভৈরব বন্ধুসভা