কবিতায় করি তর্পণ
মা আসছে, মা আসছে—রব উঠেছে চারিদিকে
আমার মা তো আর আসবে না কোনো দিন
মা আমার মাটির দুর্গা
একবুক রক্তের নদী পেরিয়ে
সূর্য, চন্দ্র, পোড়া ধ্বংসস্তূপ পেরিয়ে
পায়ে পায়ে লতানো লতা, রক্ত–মাংসের সম্পর্কের শিকড়
তৃতীয় নয়নে ফোটা বাংলা ভাষা নামের দেশের ফুল
গর্ভজাত ছোট ছোট ছেলেমেয়ের বুকে–পিঠে, হাতে ধরে নিয়ে
পালিয়ে আসছে, পালিয়ে আসছে
তুলসীতলায় প্রদীপ নিভে গিয়েছে তাঁর
সোনার সংসার ভেঙে তছনছ হয়ে গিয়েছে
পালিয়ে আসছে, দুধভাত না হোক, সন্তানের মুখে দু-চার গ্রাস নুন-ভাত তুলে দেবে বলে
নিজের পেটে তাঁর আজন্মকালের খিদে উপবাসের নামে সহ্য করতে শিখে গিয়েছে
কাঁটাবিছানো রক্তাক্ত পথে পথে, তবু দেখো প্রতিটি চরণের ছাপে কেমন ফুল ফুটিয়ে দিয়ে আসে
কচুরিপানার মতো ভেসে ভেসে, তবু দেখো ময়ূরপালকের মতো কেমন ফুল ফুটিয়ে রেখে আসে
অজানা–অচেনা এই সব ফুলের কথা কেউ জানতে পারে না কোনো দিন
কাঁটাতারে শাড়ির আঁচল বাঁধা পড়ে যায়
বুক ডুকরে উঠে বলে, ‘যেয়ো না মাগো, যেয়ো না...’
যেতে কি আর তার মন চায়?
কান্নাভেজা চোখে মাটি হারানোর যন্ত্রণায় বুক ফেটে যায়
কিন্তু সন্তানদের বাঁচানোর জন্য তাঁকে যে যেতেই হবে
সময় কখনো কখনো বড় নির্দয়, নিরুপায়
শূন্য থেকে শ্মশানে আবার গড়ে তুলতে হবে মায়ার সংসার
হ্যাঁ, আমিই সেই পোড়াকপালি মায়ের সন্তান
আমারও পায়ে পায়ে ফুটেছে কাঁটা
দুবেলা দুমুঠো জোটেনি ভাত
চোখের সামনে দেখেছি মায়ের কান্না আর হাহাকার
ধীরে ধীরে উদ্বাস্তু থেকে তিলে তিলে ক্ষয়ে ক্ষয়ে উন্মাদ হয়ে ওঠা একটি মানুষের কঠিন দিন–রাত
একটি মাটির আস্তানা তবু গড়ে দিয়ে গিয়েছে
দশ হাতে লতা–পাতা–ফুলের আবার সাজিয়ে দিয়ে গিয়েছে গরিবের সংসার
নিজের ক্ষুধার্ত পেটের ওপর ধারণ করেছে পৃথিবী
নিজের ছিন্ন বস্ত্রে সন্তানের শীত ঢেকেছে
মা আসছে, মা আসছে—আজ রব উঠেছে চারিদিকে
কিন্তু আমার মা তো আর আসবে না
বানভাসি জলে আর কাদায়, রোগে-শোকে-তীব্র বিষাদে আমরণ
লড়াই করে আসা মাকে শুইয়ে দিয়ে এসেছি শ্মশানের যন্ত্রণা পোড়ানো বিছানায়
ঈশ্বর মানি না আমি, তর্পণ মানি না
জীবনের হাজারো যন্ত্রণায় ক্ষতবিক্ষত হতে হতে
যে ঈশ্বর আমাদের রক্ষা করতে পারেনি
তেমন অলৌকিক শক্তিতে বিশ্বাস রাখব কেন?
মা, তোমাতেই শুধু বিশ্বাস রাখি
তুমি জন্ম দিয়েছ মাটি, নদী, আকাশ, বাতাস, লতা, পাতা, ফুল, পক্ষী, সাক্ষী সন্তানের
আজ তাই কবিতায় করি তর্পণ
তোমার দান করে যাওয়া দুটি চোখে আলো পেয়েছে যেমন অন্ধ
আমাদের অন্ধকার বিছানো পথে পথে চিরকাল আলো জ্বালিয়ে রেখো
বঙ্গজননী, তুমি আমার মা, মাটির দুর্গা।