যে কারণে হলান্ডের হাতেই ওঠা উচিত ব্যালন ডি’অর

ম্যানচেস্টার সিটি স্ট্রাইকার আর্লিং হলান্ড এ বছর ব্যালন ডি’অরের বড় দাবিদারছবি : রয়টার্স

লিওনেল মেসি ও ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো—ইউরোপিয়ান তথা বিশ্ব ফুটবলে প্রায় দুই দশকের মতো রাজত্ব করা দুই মহিরুহ। তাঁরা দুজনই চলতি বছর ইউরোপ ছেড়ে পৃথিবীর দুই প্রান্তে চলে গেছেন। একজন গেছেন যুক্তরাষ্ট্রে, অন্যজন মরুর দেশ সৌদি আরবে। ইউরোপে তাঁরা তাঁদের রাজত্বের বাটন নির্দিষ্টভাবে কাউকে দিয়ে না গেলেও সেই বাটন নিজের হাতে নেওয়ার জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত আর্লিং হলান্ড। পিছিয়ে নেই কিলিয়ান এমবাপ্পেও। তবে এ বছর ব্যালন ডি’অর পাওয়ার দৌড়ে বেশ ভালোভাবেই এগিয়ে আছেন ২৩ বছর বয়সী হলান্ড।

আগামী ৩০ অক্টোবর ঘোষণা করা হবে ফুটবলের সর্বোচ্চ মর্যাদাপূর্ণ ব্যক্তিগত পুরস্কার ব্যালন ডি’অর–জয়ীর নাম। ফ্রান্স ফুটবল ম্যাগাজিন কর্তৃক দেওয়া এই স্বীকৃতি যদি এ বছর হলান্ড ছাড়া আর কেউ জিততে পারেন, তাহলে সেটা লিওনেল মেসি। কারণটা গত বছর কাতার বিশ্বকাপে তাঁর অবিশ্বাস্য পারফরম্যান্স ও বিশ্ব চ্যাম্পিয়নের মুকুট জয়। তবে পুরো বছরের পারফরম্যান্স বিবেচনা করলে এটা নরওয়েজিয়ান স্ট্রাইকারেরই পাওয়া উচিত। চলুন এই দাবির পক্ষে আরও কারণ জেনে নিই।

উয়েফা বর্ষসেরার পুরস্কার হাতে বাঁ থেকে) দাঁড়ানো আর্লিং হলান্ড (বর্ষসেরা পুরুষ খেলোয়াড়), অ্যাইতেন বোনমাতি (বর্ষসেরা নারী খেলোয়াড়), আলেক্সান্দার সেফারিন (উয়েফা সভাপতি), সারিনা ভাইগমান (বর্ষসেরা নারী কোচ) ও

অন্য ফুটবলারদের মতো নন
২০২২ সালের জুলাইয়ে আর্লিং হলান্ড যখন বুরুশিয়া ডর্টমুন্ড থেকে ৫২ মিলিয়ন ইউরোর (৬৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার) বিনিময়ে ম্যানচেস্টার সিটির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হন, তখন অনেকেই বলেছেন প্রিমিয়ার লিগে অত বেশি আলো ছড়াতে পারবেন না এই ফরোয়ার্ড। কারণ হিসেবে বলা হয়েছিল, প্রিমিয়ার লিগের তীব্র প্রতিযোগিতা। যেটির সঙ্গে বুন্দেসলিগায় গোলের পর গোল করে যাওয়া হলান্ড হয়তো টিকতে পারবেন না! কিন্তু তরুণ এই তুর্কি মৌসুমের প্রথম পাঁচ ম্যাচ খেলেই বুঝিয়ে দিলেন তিনি অন্য ধাতুতে গড়া। প্রথম ৫ ম্যাচে গোল করলেন ৯টি। এর মধ্যে পরপর দুই ম্যাচে দুটি হ্যাটট্রিকও রয়েছে! তবে ইংলিশ ফুটবলে শুরুতে এমন ফর্ম দেখিয়ে পরবর্তী সময়ে হারিয়ে যাওয়ারও অসংখ্য উদাহরণ আছে। হলান্ড সেটিকেও ভুল প্রমাণ করলেন। দিন যত গড়িয়েছে, পারফরম্যান্সের ধাপ তত বাড়িয়েছেন। গড়েছেন একের পর এক রেকর্ড।

২০২২-২৩ মৌসুমের প্রথম তিন মাসের মধ্যেই প্রিমিয়ার লিগের ইতিহাসে সবচেয়ে দ্রুততম সময়ে তিনটি হ্যাটট্রিক করার নজির সৃষ্টি করেন। তা–ও মাত্র ৮ ম্যাচ খেলে! পুরোনো রেকর্ড ছিল লিভারপুলের মাইকেল ওয়েনের দখলে (৪৮ ম্যাচে)। আর চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি শেষ হওয়ার আগেই ২৭টি গোল করে প্রিমিয়ার লিগের এক মৌসুমে সিটির হয়ে সর্বোচ্চ গোলের রেকর্ড নিজের করে নেন হলান্ড। আগের রেকর্ডটি ছিল ক্লাব কিংবদন্তি আর্জেন্টাইন ফরোয়ার্ড সের্হিও আগুয়েরোর। এ ছাড়া ২৮ বছর ধরে অক্ষত থাকা প্রিমিয়ার লিগের এক মৌসুমের সর্বোচ্চ গোলের রেকর্ডও নিজের করে নেন নরওয়েজিয়ান তারকা। ৩৪ গোল করে আগের রেকর্ডটি ছিল অ্যালান শিয়ারার ও অ্যান্ডি কোলের দখলে। হলান্ড লিগে ৩৫ ম্যাচে ৩৬ গোল করে লিগ মৌসুম শেষ করেন। এর মধ্যে আবার মাত্র ৩২ ম্যাচে শুরুর একাদশে ছিলেন। গড়ে প্রতি ৭৭ মিনিটে একটি করে গোল!

গত মৌসুমে ওয়েস্ট হাম ম্যাচ শেষে গার্ড অব অনার পান আর্লিং হলান্ড
রয়টার্স

দলের সঙ্গে দ্রুত মানিয়ে নেওয়া
সের্হিও আগুয়েরো চলে যাওয়ার পর ম্যানচেস্টার সিটিতে পরিপূর্ণ কোনো স্ট্রাইকার ছিল না। তবু টানা দুই বছর প্রিমিয়ার লিগের শিরোপা জিততে তাদের কোনো অসুবিধা হয়নি। জ্যাক গ্রিলিশ, কেভিন ডি ব্রুইনা ও বার্নান্দো সিলভাদের দিয়ে আক্রমণভাগ সাজাতেন পেপ গার্দিওয়ালা। অনেক গোল না হলেও দল জয় পেয়ে যেত অনায়াসে। তারপরও একজন পরিপূর্ণ স্ট্রাইকারের খোঁজে ছিলেন সিটি বস পেপ। কারণ, চ্যাম্পিয়নস লিগ জিততে হলে যে কোনো বিভাগই অপূর্ণ রাখা যাবে না। তাই ডর্টমুন্ড থেকে হলান্ডকে নিয়ে আসেন তিনি।

শুরুতে প্রশ্ন উঠেছিল, দলটির সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারবেন তো এই তারকা? স্ট্রাইকার না থাকায় আগের মৌসুমে সিটির সর্বোচ্চ গোলদাতা কেভিন ডি ব্রুইনাই বা কীভাবে তাঁকে গ্রহণ করবেন? পেপ গার্দিওয়ালার অধীনে সফল হতে পারবেন তো হলান্ড? কারণ, হলান্ডের অন্যতম আদর্শ জ্লাতান ইব্রাহিমোভিচের পেপের অধীনে ভালো রেকর্ড নেই। তবে এসব শঙ্কা দূর করতে খুব বেশি সময় নেয়নি পেপ কিংবা সিটির অন্য খেলোয়াড়েরা। তারা হলান্ডকে বেশ সাদরে গ্রহণ করে নেয়। এর প্রমাণ তো লিগে হলান্ডের গোলের ১৩টিতে অবদান কেভিন ডি ব্রুইনার। অন্যদিকে কোচ পেপ গার্দিওয়ালাও হলান্ডকে কেন্দ্রে রেখে আক্রমণভাগ নতুনভাবে সাজিয়েছেন।

চ্যাম্পিয়নস লিগের ট্রফি হাতে আর্লিং হলান্ড
সিটি টুইটার

ম্যানচেস্টার সিটির অপূর্ণতাকে পূর্ণতা দেওয়া
আর্লিং হলান্ড আসার আগে কাতারি মালিকানাধীন ক্লাবটির অপূর্ণতা কী ছিল? উত্তর, চ্যাম্পিয়নস লিগ জিততে না পারা। পেপ গার্দিওয়ালাকেও কোচ করে আনা হয়েছিল এই অপূর্ণতা ঘোচাতে। কিন্তু এই সেনাপতির অধীনে পাঁচটি প্রিমিয়ার লিগ শিরোপা জিতলেও কোনোভাবেই মূল লক্ষ্য অর্জন হচ্ছিল না। এ জন্য দরকার ছিল একজন দক্ষ সৈনিকের; যে কিনা সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতে পারবে। হলান্ডকে সেই সৈনিক হিসেবেই নিয়ে আসা হয়। বাকি ইতিহাস এখন সবারই জানা। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের পর দ্বিতীয় ইংলিশ ক্লাব হিসেবে ট্রেবল জিতেছে ম্যানচেস্টার সিটি। চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতে দীর্ঘদিনের অপূর্ণতাও ঘুচেছে। আর এই অর্জনে হলান্ডের অবদান নিশ্চিতভাবেই সবচেয়ে বেশি।

চ্যাম্পিয়নস লিগের গত মৌসুমে তিনি সর্বাধিক ১২ গোল করে জিতেছেন গোল্ডেন বুট। সেমিফাইনাল ও ফাইনালে গোল করতে না পারলেও দলের জয়ে তাঁর অবদান অস্বীকার করার উপায় নেই। কারণ, প্রতিপক্ষের ডিফেন্ডাররা তাঁকে আটকে রাখায় ব্যস্ত ছিল বলেই অন্যরা গোল করার সুযোগ পেয়েছেন। তাই তো এরই মধ্যে ২০২২-২৩ মৌসুমের উয়েফা বর্ষসেরা ও পিএফএ বর্ষসেরা ফুটবলারের স্বীকৃতি পেয়েছেন। এ ছাড়া এফএ কাপে ৩টি এবং কারাবো কাপে ১টি গোল করেন। সব মিলিয়ে সব ধরনের প্রতিযোগিতায় পুরো মৌসুমে ৫৩ ম্যাচ খেলে ৫২ গোল করেন হলান্ড।

পিএসজিতে ব্যর্থ লিওনেল মেসি
ছবি: রয়টার্স

মৌসুমজুড়ে দুর্দান্ত খেলা, যেখানে মেসি ব্যর্থ
ধরুন, গত মৌসুমে বিশ্বকাপ ফুটবল অনুষ্ঠিত হয়নি। তাহলে পুরো মৌসুমের সেরা ফুটবলার কে? সবাই একবাক্যে আর্লিং হলান্ডের নামই বলবে। এ বছরের ব্যালন ডি’অর জয়ের দাবিদার হিসেবে মেসির নাম আলোচনায় থাকার কারণ, বিশ্বকাপে তাঁর পারফরম্যান্স। এর বাইরে পিএসজির হয়ে ক্লাব পারফরম্যান্স খুব একটা ভালো কাটেনি। কোপা দে ফ্রান্স ও চ্যাম্পিয়নস লিগের শেষ ষোলো থেকে বাদ। কেবল জিতেছেন লিগ ওয়ানের শিরোপা। মৌসুম শেষে সব ধরনের প্রতিযোগিতা মিলিয়ে মেসির নামের পাশে ৪১ ম্যাচে ২১ গোল ও ২০ অ্যাসিস্ট। ৩৬ বছর বয়সী একজন ফুটবলারের জন্য যা অবিশ্বাস্য পারফরম্যান্স হলেও তা কোনোভাবেই হলান্ডের পারফরম্যান্সের সমান নয়।

এবার প্রশ্ন উঠতে পারে, হলান্ড কেন বিশ্বকাপ খেলেননি? তাহলে অন্তত সেরা খেলোয়াড় বাছাই করতে এত প্রশ্ন উঠত না! এটা সত্য। তার চেয়ে বড় সত্য হলো, নরওয়েতে ফুটবল প্রধান খেলা নয়। তাই দেশটির ফুটবল কাঠামো এতটা শক্তিশালী নয়। এ কারণে শক্তিশালী দল গঠনও হয় না, যারা কিনা বিশ্ব ফুটবলের পরাশক্তিদের বিপক্ষে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারে। সর্বশেষ ১৯৯৮ সালের বিশ্বকাপে খেলেছে নরওয়ে। এর পর থেকে আর কোনো বিশ্বকাপে কোয়ালিফাই করতে পারেনি। ২০২২ সালেও সেই ধারাবাহিকতা বজায় থাকে। হলান্ডেরও তাই বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় এই টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণের সুযোগ হয়নি।

সময় এখন নতুনের জয়গান গাওয়ার। মেসির নামের পাশে এরই মধ্যে সর্বাধিক সাতটি ব্যালন ডি’অর রয়েছে। নিকট ভবিষ্যতে তাঁকে আর কোনো ফুটবলার ছুঁতে পারবেন কি না, সন্দেহ। তাই কেবল বিশ্বকাপের পারফরম্যান্স বিবেচনায় নিয়ে তাঁর হাতে আরও একটি ব্যালন ডি’অর তুলে দেওয়াটা উচিত হবে না। এতে যে হলান্ডের প্রতি অবিচার হবে। মাত্র ২৩ বছর বয়সে বিশ্বের সবচেয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ লিগে তিনি যে রকম প্রদর্শনী দেখিয়েছেন, তা অবিশ্বাস্য। তাঁর হাতেই ওঠা উচিত এবারের ব্যালন ডি’অর।