শহীদ বুদ্ধিজীবী আনোয়ার পাশার মহান মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে রচিত প্রথম উপন্যাস ‘রাইফেল, রোটি, আওরাত’; যা বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের এক অনন্য দলিল। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ বিভীষিকাময় রাত থেকে শুরু হয়ে ২৮ মার্চ সন্ধ্যা পর্যন্ত উপন্যাসের কাহিনি বিস্তৃত। মাত্র তিন দিন ও তিন রাতের পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও এদেশীয় দোসরদের ঢাকার নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর অতর্কিত তাণ্ডবলীলার মধ্যে দুটি পরিবারের বেঁচে থাকার গল্প ‘রাইফেল, রোটি, আওরাত’।
সুদীপ্ত শাহীন উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক। স্ত্রী আমিনাসহ তিন বাচ্চা নিয়ে থাকতেন বিশ্ববিদ্যালয়ের টিচার্স কোয়ার্টারের ২৩ নম্বর বিল্ডিংয়ে। ২৫ মার্চ কালরাতে হানাদার বাহিনীর আক্রমণে ২৩ নম্বর বিল্ডিংয়ের সবাই মারা গেলেও বেঁচে যান তিনি ও তাঁর পরিবার। চারপাশে লাশের স্তূপ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রখ্যাত অধ্যাপকেরা নিহত হয়েছেন সপরিবার। রাতের আঁধারে ইয়াহিয়া খানের লেলিয়ে দেওয়া পশুরা মেরে ফেলেছে তাঁর সহকর্মীদের। গণহত্যার বলী হয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। রেহাই পায়নি শহরের সাধারণ জনগণ। শিক্ষক হিসেবে নিজের সন্তানতুল্য ছাত্রদের রক্ষা করতে না পারার আক্ষেপ, সহকর্মীদের মধ্যে ব্যতিক্রমী হয়ে নিজে জীবিত থাকার যে অপরাধবোধ—এসবই কুরে কুরে খাচ্ছিল সুদীপ্তকে। মরে গিয়ে তাঁরা বেঁচে গিয়েছেন। লেখক যেন সুদীপ্ত শাহিনের মধ্যে সে সময়ের হতাশা এবং আক্ষেপ প্রকাশ করেছেন।
উপন্যাসের সময়কাল ক্ষণস্থায়ী। মাত্র তিন মাসের গল্প। কিন্তু তা যেন এক যুগ। এই গল্প লেখা শুরু হয় একাত্তরের এপ্রিল মাসে, আর শেষ হয় জুনে। এই ক্ষণকালে চিত্রিত হয়েছে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বর্বরতার প্রতিরূপ। ইতিহাসের অন্যতম নিকৃষ্ট গণহত্যার চাক্ষুষ বিবরণ। বর্ণিত হয়েছে সাতচল্লিশ সাল থেকে একাত্তর পর্যন্ত চলে আসা শোষণ এবং সেই শোষণের প্রতিবাদে বাঙালির ওপরে নেমে আসা পাকিস্তানি অপশাসন। ’৬৯-এ অধ্যাপক শামসুজ্জোহার আত্মোৎসর্গ, অতঃপর বাংলার উত্তাল অবস্থা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের হৃদয়জাগানিয়া ৭ মার্চের ভাষণসহ ইয়াহিয়ার বিশ্বাসঘাতকতা, আলোচনার নামে কালক্ষেপণ বিষয়গুলো নিখুঁতভাবে বর্ণনা করেছেন। কালরাতে হাজার হাজার মানুষের লাশের মাধ্যমে বাঙালির প্রতিশোধ নেওয়ার মানসিকতা; অর্থাৎ যুদ্ধের প্রস্তুতি বাস্তবিকভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন।
লেখক আনোয়ার পাশা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার সুবাদে অসংখ্য অধ্যাপকের মৃত্যু নিজে প্রত্যক্ষ করেছেন। অধ্যাপক মনিরুজ্জামান, অধ্যাপক গোবিন্দ চন্দ্র দেব, অধ্যাপক ড. জ্যোতির্ময় গুহঠাকুর, অধ্যাপক ড. ফজলুর রহমান— তাঁদের বেশির ভাগই নিহত হয়েছেন সপরিবার। সেসব বর্ণনাও দেওয়া আছে উপন্যাসে। বর্ণনা শুনলে যেকোনো সুস্থ মনের ব্যক্তির গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যাবে। কেঁদে উঠবে মন।
‘রাইফেল, রোটি, আওরাত’-এর শেষ কথাগুলো আজও ভাবায় আমাদের, স্বপ্ন দেখায় দৃঢ় চিত্তের। ‘নতুন মানুষ, নতুন পরিচয় এবং নতুন একটি প্রভা। সে আর কত দূর। বেশি দূর হতে পারে না। মাত্র এই রাতটুকু তো। মা ভৈঃ। কেটে যাবে।’
শুধু কি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক! কোলের বাচ্চা, বৃদ্ধ, নারী, শিশু—কেউই রেহাই পায়নি হানাদারদের কবল থেকে। রক্ষা পায়নি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি হলও। কামানের গোলা, কিংবা মর্টারের গুলি দিয়ে লন্ডভন্ড করে দেওয়া হয়েছে প্রতিটি হল। রাইফেলে ঝাঁঝরা করে দেওয়া হয়েছে নিরীহ নিরস্ত্র ছাত্রদের বুক। ছাত্রীদের ধরে নিয়ে যাওয়া হয় যৌনদাসী হিসেবে ব্যবহার করার জন্য। যাঁরাই বাধা দিয়েছেন, তাঁদের হত্যা করা হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিখ্যাত মধুদাকেও মেরে ফেলে তারা।
সুদীপ্তের বন্ধু ফিরোজ। ছাত্রাবস্থায় পড়াশোনা ও কাব্যচর্চা করে সময় পার করলেও পরে যোগ দিয়েছেন রাজনীতিতে। বুঝেছেন বাঙালির মুক্তির জন্য শুধু পড়াশোনা করে লাভ নেই। করতে হবে প্রতিবাদ। সরব রাজনীতিতে অংশ নিয়ে যেতে হবে ক্ষমতায়। তবেই না দীর্ঘ ২৩ বছরের যে বৈষম্য, যে দৈন্য, তা ঘুচবে। কিন্তু ইয়াহিয়া আর তা হতে দিল কই? সাধারণ নির্বাচন দেবে না তো দেবেই না। আর যখন দিল, তখন বাংলার জনগণ ভোট দিল আওয়ামী লীগকে। বাঙালিকে কি ক্ষমতা দেওয়া যায় নাকি? তারা হলো প্রজার জাতি, শোষিত হওয়ার জন্যই তাদের জন্ম। ক্ষমতায় যেতে দিলে সেটা আর কীভাবে হবে? তাই ইয়াহিয়া বন্ধ করে দিল সাধারণ অধিবেশন। এরপর আলোচনার নাম করে এল এ দেশে। হুট করে মাঝরাতে পালিয়ে চলে গেল পাকিস্তানে, আর লেলিয়ে দিয়ে গেল তার পোষা সেনাবাহিনীকে।
এই সেনাবাহিনী বুঝে শুধু তিনটি জিনিস। রাইফেল, রোটি আর আওরাত! সারা দিন রাইফেল নিয়ে মানুষ মারো। হতে পারে শিশু, যুবক, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা। কেবল যুবতী; অর্থাৎ আওরাত পেলেই তাকে ধরে নিয়ে যায়। ক্ষুধা লাগলেই রোটি পেটে চালান করে। আর রাতভর আওরাত নিয়ে ফুর্তি! ‘রাইফেল, রোটি, আওরাত’ উপন্যাসের এই নামকরণ মূলত পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর স্থূল মানসিকতাকে নির্দেশ করতেই করা হয়েছে।
উপন্যাসের অন্যতম কাল্পনিক চরিত্র শিল্পী আমান। পঁচিশ মার্চ রাতে যিনি হারিয়েছেন তাঁর সন্তানকে। আর স্ত্রীকে হানাদাররা ধরে নিয়ে গেছে তাদের নির্মিত যৌনপল্লিতে। অসমাপ্ত ছবি আঁকতেই চলে গিয়েছিলেন নিজ বাসায়। এরই মধ্যে শুরু হলো মাতাল হাওয়া। পাকিস্তানের হানাদারদের তাণ্ডবলীলা। পরদিন এসে দেখেন, তাঁর দুই সন্তানের রক্তাক্ত দেহ পড়ে আছে মেঝেতে। এই দুঃখ সইতে না পেরে উন্মাদ হয়ে যান তিনি। সুদীপ্তের সঙ্গে তাঁর দেখা হয় নীলক্ষেত মোড়ে। মিলিটারি দেখে চিৎকার করে বলছিলেন, ‘হাম গোলি করেগা। গোলি খায়েগা।’
অর্থাৎ, ‘আমার ছেলে-মেয়েকে গুলি করেছ, আমিও তোমাদের গুলি করব, আমার ছেলে মেয়েরা গুলি খেয়েছে, আমিও গুলি খাব। আমাকেও তোমরা গুলি করো। মিলিটারি আর বসেই থাকবে বা কেন? ছুড়ল গুলি। তাতে সুদীপ্তের প্রাণও যেত। কিন্তু ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলেন শিল্পী আমন নিজেই। কেন? হয়তো তাঁর নিজ পুত্র-কন্যাকে বাঁচাতে না পারার আক্ষেপের কিছুটা হলেও মিটিয়ে নিলেন মনে মনে। বিনিময়ে গুলি খেয়ে লুটিয়ে পড়লেন রক্তাক্ত দেহ নিয়ে।
যারা বর্ণে বাঙালি, কিন্তু বর্ণচোরা। গিরগিটির মতো রং পাল্টানো যাদের স্বভাব। তাদের চরিত্রও চিত্রিত হয়েছে উপন্যাসে। এমনই চরিত্র ড. খালেক। ফিরোজ রাজনীতি করেন, তাই তিনি বোঝেন, এরাই বাংলার সবচেয়ে বড় শত্রু। এরাই বাংলাদেশকে অধঃপাতে নিয়ে যাচ্ছে। একই রকম আরেকটি চরিত্র হচ্ছে ফিরোজের দূরসম্পর্কের চাচা গাজী সাহেব। ভুট্টোর আমলে করেছেন জামায়াতে ইসলাম। পরে তাঁর পতন হলে ঘেঁষতে চেয়েছেন আওয়ামী লীগের দিকে। ২৫ মার্চের পর আবার পুরোনো গোঁফেই তা দেওয়া। ভাগ্যক্রমে ফিরোজ তাঁর নিজ পরিবার, সুদীপ্ত শাহিনের পরিবার নিয়ে আশ্রয় নিতে যান গাজী সাহেবের বাসায়। সেখানেই ছিল রাজারবাগ পুলিশ লাইনে পাকিস্তানি আর্মির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা কিছু পুলিশ। তিনি তাঁদের ভুলিয়ে ভালিয়ে রেখে দিয়েছিলেন এত দিন। ফিরোজদের সামনেই কজন পাকিস্তানি আর্মি ডেকে এনে আলবাত ধরিয়ে দিয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তুললেন!
পরে জানা যায়, তাঁর কাছে নির্দেশ এসেছে ফিরোজকেও আয়ত্ত করার। তিনি আওয়ামী লীগের বড় নেতা। তিনি যদি দেশবাসীর উদ্দেশে পাকিস্তানের এহেন কৃতকর্মের সাফাই গেয়ে কিছু বলেন, তাহলে দেশবাসী কিছুটা আশ্বস্ত হবেন এবং বহির্বিশ্বের নাক গলানো একটু কমবে। ফিরোজের আদর্শ তো আর এত সস্তা নয় যে চাইলেই কিনে নেওয়া যায়। তীব্র ঘৃণা আর প্রতিশোধ নেওয়ার আগুন বুকে নিয়ে ফিরোজ সবাইকে নিয়ে ফিরে চললেন। সে আগুনের উত্তাপ কিছুটা লেগেছে সুদীপ্তের মতো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের বুকেও!
‘রাইফেল, রোটি, আওরাত’-এর শেষ কথাগুলো আজও ভাবায় আমাদের, স্বপ্ন দেখায় দৃঢ় চিত্তের। ‘নতুন মানুষ, নতুন পরিচয় এবং নতুন একটি প্রভা। সে আর কত দূর। বেশি দূর হতে পারে না। মাত্র এই রাতটুকু তো। মা ভৈঃ। কেটে যাবে।’
একনজরে
বই: ‘রাইফেল, রোটি, আওরাত’
লেখক: আনোয়ার পাশা
ধরন: উপন্যাস
প্রকাশক: স্টুডেন্ট ওয়েজ
প্রকাশকাল: ১৯৭৩
প্রচ্ছদ ও অলংকার: কাইয়ূম চৌধুরী
মুদ্রণ: মৌমিতা প্রেস
পৃষ্ঠা: ১৮০
মূল্য: ২৫০ টাকা
সহসভাপতি, ময়মনসিংহ বন্ধুসভা