সাধক কবি চণ্ডীদাসের জীবন দিয়ে প্রমাণ করা কাব্য চারণ ‘শুনহ হে মানুষ ভাই/ সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই’ এই চলচ্চিত্রেরও মূলভাষ্য হয়ে ওঠে। শুরুতেই আমরা দেখি, নিদারুণ অভিশপ্ত এক সামাজিক প্রথার প্রতিফলন। মৃত স্বামীর সঙ্গে জোর করে সহমরণে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে একরত্তি এক বালিকা বধূকে। পুরোহিত নিদান দিচ্ছেন—সহমরণে সে স্বর্গে যাবে। কোনোভাবে তাদের নিরস্ত্র করতে না পেরে, আপনজন কেঁদে ভাসিয়ে আহাজারি করছে, ‘জীবন্ত কন্যাকে পুড়িয়ে মেরে স্বর্গে নিয়ে যাবে?’ এ কোন সভ্যতা! এ কোন সমাজ!
ভয়ে জড়সড় জীবন্ত কন্যা ঈশ্বরের কাছে অভিযোগ জানানোরও সময় পাচ্ছে না। হাপুস নয়নে কাঁদছে আর তার আর্তনাদকে ঢেকে দিচ্ছে শ্মশানযাত্রীর খোল–করতালের বাদ্য। আর ঠিক এ সময়ে এক বালক নেতার আবির্ভাব। ভূতের ছানাপোনা সেজে বালকের দল শ্মশানে পুরোহিতদের শায়েস্তা করে। সেই দৃশ্যের চিত্রায়ণে তাদের গানটিও মুগ্ধ করে। তারাই এই অকাল বিধবা কন্যাকে জীবন্ত পুড়ে মরা থেকে বাঁচায়। বলাবাহুল্য যে বালক নেতা এই কাজ করেছেন, পরবর্তী সময়ে তিনি হয়ে ওঠেন বাঙালির হৃদয়জয়ী কবি চণ্ডীদাস। আর যে মেয়েটিকে বাঁচানো হয়েছে, সে হয়ে ওঠে সাধক কবির সাধনসঙ্গিনী, জন্মজন্মান্তরের প্রণয়ের সাথি রজকিনী। ১৯৮৭ সালে নির্মিত অমর প্রেমকাহিনি চণ্ডীদাস রজকিনী চলচ্চিত্রে শিল্পায়িত করে রেখেছেন পরিচালক রফিকুল বারি চৌধুরী। চিরন্তন প্রেমগাথার গল্পকে রূপরেখা দিয়েছেন লেখক বরুণ শঙ্কর।
রাধা ও কৃষ্ণ বাংলা ভাষার চিরকালের কাব্যের চরিত্র। তাঁদের অমর প্রেমকাহিনি বাস্তবের রক্ত-মাংসের শরীরে জন্ম নিয়ে যেন অমৃত রূপ দিয়ে গেছেন চণ্ডীদাস আর রজকিনী।
প্রবল ভক্তিবাদ, পরম প্রেম, লৌকিক–অলৌকিক সত্তার চিরকালীন গাথা এবং চরম বিদ্রোহ—সবকিছুকে চলচ্চিত্রে অনবদ্য রূপদান করেছেন পরিচালক। চণ্ডীদাস ও রজকিনীর প্রেমিক সত্তা এবং বিদ্রোহী সত্তা—একই সঙ্গে মহিমান্বিত করা হয়েছে। এ এক সমগ্র বাঙালি জাতির পরম গৌরবের ইতিহাস। গল্পের ছায়াপটজুড়ে হিন্দু দেবী বাসুলীর উপাসনা ও মহিমা বিস্তারিত হয়েছে। কারণ, কবি ছিলেন ‘বাসুলী সেবক চণ্ডীদাস’। সমগ্র বাংলা সাহিত্যের আদি পর্বে এমনই দেব-দেবীনির্ভর কাব্যসাহিত্য রচিত হয়েছে। কবিদের জীবনচরিতে মানুষের লড়াই-সংগ্রাম, প্রেম, মানবিক গুণাবলিও প্রকাশিত হয়েছে। ঠিক এ কারণেই বাংলাদেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে জহির রায়হানের মতো পরিচালক যেমন বেহুলা চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে পারেন, রফিকুল বারি চৌধুরী নির্মাণ করতে পারেন অমর মানবিক প্রেমের এই বিজয়গাথা। ধর্ম এবং ধর্মীয় ছায়া এখানে মুখ্য নয়। নজরুল যেভাবে একই সঙ্গে শ্যামাসংগীত এবং ঈদের গান রচনা করতে পারেন, আমাদের কবি-শিল্পীরা চিরকাল জাত–ধর্মের উর্ধ্বে উঠে মানবতাবাদের প্রচার করে গেছেন।
ধোপানি রজকিনী এখানে পরম প্রেমে ভক্তিভরা চিত্তে তার পরম আরাধ্য শ্যামসুন্দর চণ্ডীদাসের জন্য বিনি সুতার মালা গেঁথে জলে ভাসিয়ে দেয়। ভাসতে ভাসতে ওপারে গিয়ে তা কবির পরানে ঠাঁই পায়। দিন দিন এপার-ওপারের প্রেম প্রতিদিনের আকুলিবিকুলিতে এভাবেই পূর্ণতার দিকে এগোয়। ১২ বছর ধরে ঘাটে এসে মাছ ধরতে বসা চণ্ডীর বড়শিতে মাছ এসে ঠোকর দেয়। প্রেমযমুনায় ডুবে ডুবে জল খাওয়া রজকিনী, তার উপাস্য প্রেমিকের জন্য খাবারের ডালি সাজিয়ে এপারে ডুব দিয়ে ওপারে পৌঁছে যায়। গ্রামের মাতবরেরা যখন হাতেনাতে এই রঙ্গলীলা ধরতে আসেন, মাছের ঝুড়ির ভেতরে রাখা খাবার আবার মাছ হয়ে সবার চোখে ধরা দেয়। প্রেমিক চণ্ডী যেমন জাতপাতের প্রবল বিরোধী, তাঁর উপাস্য দেবী বাসুলীও পদে পদে তাঁকে বিদ্রোহী থাকতে সাহায্য করে যান। জমিদারবাড়িতে তার জন্য গাছে গাছে ফুল ফোটে। তার সাজিয়ে দেওয়া নৈবেদ্য দেবী সাক্ষাৎ এসে খেয়ে যান। অন্য কেউ পূজা করতে এলে দেবী মুখ ঘুরিয়ে নেন।
চণ্ডীদাস চলে গেলে গ্রামে মড়ক লাগে, অনাবৃষ্টিতে মাঠ ফেটে যায়। গ্রামের অতি শাস্ত্রজ্ঞানী পণ্ডিত আর জমিদারের নায়েবের ষড়যন্ত্রে চণ্ডীদাসকে বারবার হেনস্থার শিকার হতে হয়। রজকিনীর জীবনেও বারবার অন্ধকার নেমে আসে। প্রেমের মধু, প্রেমের জাদু আর প্রেমের বিষপান ধরা থাকে পরতে পরতে। কবি চণ্ডীদাসের জীবন, প্রেম ও বিদ্রোহ নিয়ে এই চলচ্চিত্র; কিন্তু এই কবির পদরচনা বা কবিতা লেখার মুহূর্তগুলো চলচ্চিত্রে আসে না। মুহূর্তগুলোর কিছু অংশ চিত্রায়িত করতে পারলে ষোলোকলায় পূর্ণ হতো এই সৃষ্টি তরির যাত্রা। শেষের দিকে এসে একমাত্র মানবদরদি নবাবের চোখে তিনি মহামান্য কবি হিসেবে ধরা দেন। নবাব যে এই মহামান্য কবির সাক্ষাতের প্রতীক্ষায় ছিলেন আজীবন।
রজকিনীকে ভালোবাসার অপরাধে সমাজ চণ্ডীকে বারবার পতিত ও একঘরে করে। রজকিনী বলে, ‘তবে আমাকে ত্যাগ করে তুমি জাতে ওঠো ঠাকুর…’। কিন্তু চণ্ডী অটল–অনড়, কিছুতেই সমাজের এই গোঁড়ামির কাছে মাথা নত করবেন না। শত যন্ত্রণার মধ্যে কবিসুলভ শান্ত মেজাজও কখনো হারায় না। আর আমরা দেখি, তত দিনে চণ্ডী আর রজকিনী একই অন্তরাত্মায় ভিন্ন দুটি শরীরী খোলসে রয়েছেন মাত্র। একজনের শরীরের সব ব্যথা, সব প্রদাহ অন্যের শরীরেও ফুটে ওঠে। একজনের শরীরের দহন যন্ত্রণা সাক্ষাৎ অন্যজনের শরীরকেও আহত করে। এভাবেই শরীর আর মনের তীব্র যন্ত্রণা তিলে তিলে ভোগ করতে করতেও দুজনে মিলে অমৃত বিলিয়ে যান। পৃথিবীর মাটিতে মানুষে মানুষে সব ব্যবধান ঘুচিয়ে প্রেমের জয়গান করতেই যে দুজনের আগমন। মাটির মানুষের সব গরল ও বিষ শুষে নিয়ে দুজনই একসঙ্গে অমৃতলোকে চলে যান।
চলচ্চিত্রের প্রতিটি গান হৃদয় ছুঁয়ে যায়। গ্রামবাংলার চিরাচরিত মাটি, মানুষের সুর হৃদয়কে সিক্ত করে। সংগীত পরিচালনা করেছেন আলাউদ্দিন আলী। গাজী মাজহারুল আনোয়ারের লেখা গান আছে। কণ্ঠ দিয়েছেন সৈয়দ আবদুল হাদী, সাবিনা ইয়াসমিনসহ অনেকে। রজকিনী চরিত্রে ববিতাকে ভোলা যাবে না। ববিতা একাই একটি গোটা বাংলাদেশের প্রতীক। চণ্ডীদাস চরিত্রে সুব্রত বড়ুয়া প্রকৃতই সাধকশিল্পী হয়ে উঠেছেন। পূর্ণিমা চরিত্রে সুন্দরী দিতির অভিনয়ে সৌন্দর্যের প্রতিফলন ঘটেছে। জমিদারের লাঠিয়াল চরিত্রে আনোয়ার হোসেন অনবদ্য। এমন চরিত্রে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে তাঁকে বারবার দেখা গেছে। এই লাঠি শুধু প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের ভাষা নয়, শিরদাঁড়া শক্ত করে চলার একটি প্রতীকও বটে। এ ছাড়া অভিনয় করেছেন শওকত আকবর, অনুপ, অমিতা বসু, নারায়ণ চক্রবর্তী, আরিফুল হক, তোফা হোসাইন, আবুল খায়ের, খালেদা আক্তার কল্পনা, হাবিবুর রহমান, মনির, সিদ্দিক জামান নান্টু, নিশাত, ওয়াহিদা রহমান ও রানু।
রাধা ও কৃষ্ণ বাংলা ভাষার চিরকালের কাব্যের চরিত্র। তাঁদের অমর প্রেমকাহিনি বাস্তবের রক্ত-মাংসের শরীরে জন্ম নিয়ে যেন অমৃত রূপ দিয়ে গেছেন চণ্ডীদাস আর রজকিনী।
হাওড়া, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত