২০ মিনিট ধরে একা বসে আছি কোচিংয়ে, এখনো কারও দেখা নেই। স্যারও আসি বলে কোথায় যে চলে গেল বুঝতে পারছি না। একা বসে থাকতে থাকতে অনেকটা বিরক্তবোধ করতে লাগলাম।
ছয় মাস ধরে একাই থাকছি। একটা নির্জীব ফ্ল্যাটের মধ্যে একা থাকাটা খুবই বিরক্তকর এবং পানশে একটা ব্যাপার। সব কাজ নিজের করতে হয়। কাজের মহিলার হাতের রান্নাও খুবই জঘন্য, মাঝেমধ্যে তো মুখেই তোলা যায় না। এ ছাড়া যে আর কিছুই করার নেই।
ব্যবসার জন্য বছরের বেশির ভাগ সময় বাবাকে দেশের বাইরে থাকতে হয়। আম্মু একজন ব্যাংকার হওয়ায় চাকরির নিয়ম রক্ষার্থে যেখানে পোস্টিং হয়, সেখানেই চলে যেতে হয়। গত বছর আম্মুর পোস্টিং হয় কিশোরগঞ্জের নিকলীতে। তাই আমার বাধ্য হয়ে মামাদের সঙ্গে ভৈরবে থাকতে হয়। মাতৃসূত্রে আমার নানাবাড়ি ভৈরবেই। মামাদের সঙ্গে যখন থাকতাম, তখন এতটা বিরক্তিবোধ হতো না। সারা দিন ছোট দুই মামাতো ভাইয়ের সঙ্গে হেসেখেলে কাটিয়ে দিতাম। মামিও খুবই মিশুক প্রকৃতির, অত্যন্ত ভালো মানুষ। চার বছর ধরে তাদের সঙ্গে থাকছি। খাতির–যত্নের কোনো কমতি রাখেনি।
আমি হয়তো দরজা খুলে আম্মুকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ব। অশ্রুমাখা কম্পিত সুরে বলব, এতক্ষণ লাগে আসতে!
ছয় মাস আগে মামা একটি সরকারি চাকরি পায়, পোস্টিং হয় বাগেরহাটে। চাকরির দায়ে মামাকে সপরিবার চলে যেতে হয় বাগেরহাটে। মামারা চলে যাওয়ার সময় আম্মু বলেছিল ওনার সঙ্গে আম্মুর অফিসের কোয়ার্টারে চলে যেতে। কিন্তু পারিনি। এই শহরের প্রতি, মানুষের প্রতি যেই মায়া জন্মেছে, ছেড়ে কীভাবে যাব! তার ওপর আর মাত্র এক বছর পর আমার এইচএসসি পরীক্ষা। এখন তো কলেজও বদলানো যাবে না। এত দূর থেকে যাতায়াত করে কলেজে আসা-যাওয়াও করা যাবে না। তাই ঠিক করি, মামাদের ফ্ল্যাটেই থেকে যাব, যত দিন না পরীক্ষা শেষ হচ্ছে। অন্য কোনো উপায় না পেয়ে সবাই আমার সিদ্ধান্ত মেনে নেয়। এ জন্য মামাও এক বছরের বাড়িভাড়া অগ্রিম দিয়ে যায় বাড়িওয়ালাকে। মামারা যাওয়ার সময় বেশ কিছু ফার্নিচার এবং অন্যান্য দৈনিক জীবনে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র রেখে যায় আমার জন্য। এভাবেই কাটিয়ে দিই ছয়টা মাস।
কোচিং রুমের বাইরে থেকে পায়ের আওয়াজ পেলাম। প্রথমে ভেবেছিলাম বন্ধু ওয়াসিফ হবে; কিন্তু রুমে যখন স্যার ঢুকল, তখন আমার ভুল ভাঙল।
‘সরি, তোমাকে অনেকক্ষণ ধরে বসিয়ে রেখেছি।’
‘না স্যার, সমস্যা নেই।’
‘তোমার সঙ্গের সাঙ্গপাঙ্গরা কোথায়, আজকে কি আসবে না?’
‘কি জানি স্যার, আমার সঙ্গে কথা হয়নি।’
‘আসলে আমারই ভুল, এই রমজান মাসে কোচিংয়ের সময় দিলাম ভরদুপুরে। পোলাপান এই গরমে আসতে চায় না।’
‘জি স্যার, তাই হবে হয়তো।’
‘এক কাজ করো, তুমি আজকে চলে যাও, কালকে এসো।’
‘আচ্ছা স্যার।’
কোচিং থেকে বের হয়ে সোজা হাঁটা দিলাম বাড়ির পথে, আর ভাবতে লাগলাম আম্মুকে নিয়ে। সেই চার মাস আগে যে একবার এসেছিল, এর মধ্যে আর আসেনি। গত মাসে আমার জম্মদিনেও বলেছিল আসবে, অনেক আগ্রহ নিয়ে বসেছিলাম আম্মুর আসার পথ চেয়ে; সন্ধ্যার একটু আগে ফোন দিয়ে বলেছিল আসবে না। ওই দিন অনেক মন খারাপ হয়েছিল। একপর্যায়ে নিজের অজান্তেই কেঁদেছিলাম। সেদিন আম্মু কথা দিয়েছিল যে আজকে আসবেই। অবশ্য এই কথা আম্মু তিন মাস ধরেই বলে আসছে, কিন্তু কথা রাখতে পারছে না। প্রতিবারই বিকেল হলে আম্মু আসবে বলে পথ চেয়ে থাকি। আর আম্মু সন্ধ্যায় ফোন দিয়ে বলে কাজের জন্য আসতে পারিনি।
তবে আজ তা হতে দেব না। আম্মু নিজেই বলেছে আজকে যেভাবেই হোক আসবে। কদিন বাদেই ঈদ। ঈদের কেনাকাটা এখনো বাকি। কিছু টাকাও জমা করে রেখেছি, আম্মুকে কিছু একটা কিনে দেব বলে। বড় রাস্তার মোড়ে এসে, খুব দেখেশুনে রাস্তাটা পার হলাম। খুবই ব্যস্ত রাস্তা। প্রতিদিনই কোনো না কোনো দুর্ঘটনা ঘটছেই। রাস্তা পার হয়ে ঢুকে পড়লাম বাসার গলিতে। মনে মনে ভাবতে লাগলাম, আজকে যখন সন্ধ্যায় আম্মু আসবে, তখন হয়তো সঙ্গে করে আমার প্রিয় জাম-মিষ্টি নিয়ে আসবে, কিংবা নিকলীর সেই পাঁচতলী মোড়ের বিখ্যাত দই। আম্মু বাসার দরজায় এসে কলিংবেল চেপে হয়তো দরজার বাইরে থেকেই মাতৃস্নেহ ভরা মায়াবী সুরে ডাকবে, আমার কালোমানিকটা কই! মায়ের ওপর অভিমান করে কি আজ মাকে ঘরে ঢুকতে দেবে না। আর আমি হয়তো দরজা খুলে আম্মুকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ব। অশ্রুমাখা কম্পিত সুরে বলব, এতক্ষণ লাগে আসতে! আমি সেই কখন থেকে তোমার জন্য অপেক্ষা করছি।
এসব কথা ভাবতে ভাবতেই চলে এলাম বিল্ডিংয়ের নিচে। আসতেই দারোয়ান চাচা বলল—
‘কি হে কালাচাঁন, নিচে তাকিয়ে এত কী ভাবছ?’
‘কিছু না চাচা।’
হঠাৎ অনুভব করলাম আমার চোখে পানি এসে গেছে। হাত দিয়ে চোখের পানি মুছে ফ্ল্যাটে চলে গেলাম। তারপর প্রয়োজনীয় কাজগুলো সেরে নিলাম।
দুপুরে গোসল করে বই পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, উঠে দেখি বিকেল ৫টা ২৭ বাজে। তাড়াতাড়ি চোখেমুখে পানি দিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিলাম। কোচিং থেকে আসার সময় কিছু বড়া, বেগুনি নিয়ে এসেছিলাম, সেগুলোই একটু গরম করে ইফতারের আয়োজন করলাম, সঙ্গে শরবতও বানালাম। আজকে শরবত পরিমাণে বেশি বানালাম। আম্মু এসে অবশ্যই শরবত খেতে চাইবে। আমার হাতে বানানো শরবত আম্মুর অনেক প্রিয়।
ইফতার ড্রয়িং টেবিলে সাজিয়ে রেখে এক গ্লাস শরবত হাতে নিয়ে চলে এলাম বারান্দায়। আম্মু আসছে কি না দেখার জন্য। এটা আমি প্রতিবারই করি। বিকেল থেকে সন্ধ্যা অব্দি বুক ভরা আনন্দ আর উচ্ছ্বাস নিয়ে বসে থাকি আম্মু আসবে এই আশায়। আজকেও ব্যতিক্রম হলো না। এক হাতে বারান্দার রেলিং, আরেক হাতে মোবাইল ধরে দাঁড়িয়ে রইলাম, একটু পরপর মোবাইলে সময় দেখছি আর নিচে তাকাচ্ছি।
পৃথিবীকে শাসন করা সূর্য তখন পশ্চিম আকাশে ডুবে যাচ্ছে। আকাশজুড়ে লাল আভা ছড়িয়ে গেল। কত শত গাড়ি, রিকশা যাচ্ছে রাস্তা দিয়ে; কিন্তু কোনো রিকশা থেকেই আম্মুর নামার দৃশ্য দেখছি না। অপেক্ষা করতে করতে মাগরিবের আজান দিয়ে দিল, আম্মুর আসার নামগন্ধ পর্যন্ত নেই। অনেকবার কলও দিয়েছি; প্রতিবারই রিং হয়ে যায়, কিন্তু আম্মু কল ধরে না। এ রকম তো তিনি আগে কখনো করেননি। সময় কাটাতে কাটাতে সন্ধ্যার আবছা অন্ধকার থেকে রাতের গভীর অন্ধকারে পরিণত হলো। একটার পর একটা কল দিয়েই যাচ্ছি, আম্মু কল ধরছে না। ইফতারের জন্য যে শরবত সঙ্গে করে বারান্দায় এনেছিলাম, সেটা বারান্দার মেঝেতে পড়ে রইল। আমি যে রোজা রেখেছি, সেই কথা মনে নেই। একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলাম রাস্তার দিকে। ভেতরটা ফেটে যাচ্ছে, চোখ থেকে অশ্রু ঝরছে। কেবল একটিবার আম্মুকে জড়িয়ে ধরার জন্য, কোলে মাথা রেখে চিৎকার করে বলার জন্য, আম্মু তোমাকে ছাড়া আমার একটুও ভাল্লাগে না, আমি তোমাকে অনেক বেশি ভালোবাসি।
অপেক্ষা করতে অনেক রাত হয়ে গেল, আম্মুর কোনো খোঁজ নেই। তখনো এক বিন্দু জায়গা না নড়ে এক হাতে বারান্দার রেলিং ধরে রাস্তার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। কখন যে আম্মু আসবে, কখন যে অপেক্ষার প্রহর শেষ হবে, কখন যে আম্মু আমাকে বুকে জড়িয়ে কালোমানিক বলে ডাকবে…।
বন্ধু, ভৈরব বন্ধুসভা