সমরজিৎ বাবু স্তম্ভিত। তার এ কবিতা এখনো কোথাও প্রকাশিত হয়নি। এমনকি ফেসবুকেও শেয়ার করেনি। লোকটি কী করে জানল? মাথাব্যথা, গরম সব মিলিয়ে কোনো ঘোরের মধ্যে আছি; নাকি লোকটি কালো জাদু জানে।
খটখট ধরনের একটা আওয়াজ ভেসে আসছে রান্নাঘর থেকে। সুনন্দা অফিসে। সমরজিৎ বাবুর মন খারাপ। চুপচাপ বসে আছে। আওয়াজটা কিসের, জানার কৌতূহল হলেও পা এগোচ্ছে না। মন খারাপ থাকলে এমন হয়। ইদানীং কারণে–অকারণে মন খারাপ হচ্ছে। সকাল থেকে মন খারাপ করার মতো দুটো ঘটনা ঘটেছে।
সমরজিৎ বাবু, লেখক। লিখে অর্থ উপার্জন করে। অনেকের ধারণা, লিখে অর্থ উপার্জন করা যায় না। এ ধারণা ভাঙতেই একটি ব্যাংকের সহকারী পরিচালকের মতো আকাঙ্ক্ষিত চাকরি ছেড়ে লেখায় মনোনিবেশ করেছিল। কেবল অর্থের জন্য বললে ভুল বলা হবে; লেখা তার স্বপ্ন, সাধনা জীবনের চিরকাঙ্ক্ষিত বিষয়। বিশ্ববিদ্যালয়জীবন থেকে লিখছে। অগণিত পুরস্কারও পেয়েছে। কয়েক বছর ধরে একটি সম্মানজনক পুরস্কারে তার নাম উচ্চারিত হলেও আশ্চর্যজনকভাবে পুরস্কারটি কর্তৃপক্ষ তাকে দেয়নি। স্ত্রী সুনন্দার এ নিয়ে খারাপ লাগা থাকলেও সমরজিৎ বাবু পুরস্কার নিয়ে ভাবে না।
বয়সও বেশি হয়নি। ৩৭ বছর। লেখালেখির বয়স ১৭ বছর। অজস্র লেখা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। বই বেরিয়েছে। তারপরও অভ্যাসটা যায়নি। লেখা প্রকাশ হলে খুব আনন্দ পায়। চোখের জল নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে না। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে। যতক্ষণ না লেখাটা সুনন্দা পড়ে শোনাচ্ছে, ততক্ষণ থামে না। মা বেঁচে থাকতে সে পড়ে শোনাত। মায়ের মৃত্যুর পর এ ভার পড়েছে সুনন্দার ওপর। সুনন্দা আনন্দের সঙ্গে কাজটি করে। সাহিত্য সাময়িকীর লেখা হলে সমস্যা হয় না। সমরজিৎ বাবু যে দু-তিনটি পত্রিকায় লেখে, সেগুলোর সাহিত্য সাময়িকী শুক্র-শনিবার বের হয়। সুনন্দার অফিস ছুটি থাকে, এক বসাতেই পড়ে শোনায়। কিন্তু আজ মঙ্গলবার, অফিস ডে। একটি জাতীয় দৈনিকের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর ক্রোড়পত্রের বিশেষ লেখা। মনে মনে পড়ার চেয়ে শব্দ করে পড়তে বেশি সময় লাগে। অফিস ডে হলেও আপত্তি করে না সুনন্দা। নাশতা তৈরি করতে যাওয়ার আগে চা খেতে খেতে পড়তে শুরু করে। কিন্তু লোডশেডিং হওয়ায় পড়ায় বাধা পড়লে সমরজিৎ বাবু চার্জার লাইট জ্বালিয়ে পড়তে বলে। বিরক্ত লাগলেও সুনন্দা বিরক্তি প্রকাশ করে না। চার্জার লাইট আনতে ভেতরের ঘরের দিকে পা বাড়ায়। তৎক্ষণাৎ সেলফোন বেজে ওঠে। বড় ননদের ফোন। কথা বলতে বলতে, ‘একটা বাচ্চা নাও। পাঁচ বছর তো হলো বিয়ের, আর কত দেরি করবা?’ ননদ এ কথা বললে উত্তরে কিছু না বললেও বুকের ভেতর তোলপাড় করে ওঠে সুনন্দার। কথা শেষ করে মোবাইলটা টেবিলের ওপর রেখে চার্জার লাইট না নিয়েই বসার ঘরে আসে। সমরজিৎ বাবু ‘চার্জার কই?’ জিজ্ঞেস করলে উত্তর না দিয়ে যা মুখে আসে বলতে শুরু করে।
সমরজিৎ বাবু শান্ত স্বভাবের মানুষ। কথার ওপর কথা না বসিয়ে ব্যলকনিতে গিয়ে বসে। দ্বিতীয় কারণ যতটা না মন খারাপের তারও বেশি দুশ্চিন্তার। একজন লোক বসার ঘরে ৩০ মিনিটের বেশি সময় ধরে বসে আছে। তার পরনে সাদা পাঞ্জাবি-পাজামা। চুল আধা কাঁচা-আধা পাকা। বয়স ষাটের একটু কম বা বেশি। সমরজিৎ বাবু কয়েকবার জিজ্ঞেস করেছে, আপনার নাম কী, কেন এসেছেন? ভদ্রলোক কোনো উত্তর তো দেয়নি, উপরন্তু মুহুর্মুহু চোখের জল ফেলছে।
সুনন্দার সকালের ব্যবহারে খারাপ লাগা থাকলেও বিরূপ পরিস্থিতিতে প্রিয়জনের কথা মনে পড়ে। সমরজিৎ বাবু সুনন্দাকে মিস করছে।
সুনন্দা বাড়ি থাকলে সব সামলে নিত। তার কঠিন হৃদয়। পৃথিবীতে চলতে গেলে হৃদয় একটু শক্ত না হলে চলে না। সৃষ্টিকর্তা হয়তো ওইভাবেই জুড়ি মিলিয়ে দেন। সমরজিৎ বাবু সৌভাগ্যবান। সুনন্দা জীবনে আছে। কোনো ঝুটঝামেলার মধ্যে যেতে হয় না তাকে। ঘর-বাহির সব সে সামলায়। সকালের নাশতা, রাতের ভাত, বাজার সব সামলে ব্যাংকের চাকরি। কখনো কখনো সমরজিৎ বাবুর মায়া হয়, খারাপ লাগে।
‘লেখালেখি থেকে সামান্য টাকা আসে। তা দিয়ে সংসার সামলাতে তোমার কষ্ট হয়ে যায়। তা ছাড়া লেখকদের আগের মতো সম্মান কি আছে! কী করেন জিজ্ঞেস করলে, যখন লেখার কথা বলি, তখন অত পাত্তা দেয় না। বাঁকা চোখে তাকায়, পাল্টা জিজ্ঞেস করে পেশা কী? আর কোরামটোরাম করলে কিছুটা হয়। কিন্তু জানো তো, ওসব আমার ধাতে সয় না। আমি তেলবাজি করতে পারি না। জমানো টাকা দিয়ে একটা না হয় ব্যবসা শুরু করি। অবসর সময়ে লিখব। লেখা এখন অবসর যাপনেরই বিষয়।’ কিছুদিন আগে সুনন্দাকে মেসেঞ্জারে কথাগুলো লিখেছিল সমরজিৎ বাবু। কিন্তু সুনন্দা রাজি হয়নি। তার এককথা, তুমি লিখবে, লেখা ছাড়বে না। এটিই তোমার কাজ, তুমি লেখক। লেখাই তোমার পেশা। আর কিছু করার দরকার নেই।
সুনন্দার সকালের ব্যবহারে খারাপ লাগা থাকলেও বিরূপ পরিস্থিতিতে প্রিয়জনের কথা মনে পড়ে। সমরজিৎ বাবু সুনন্দাকে মিস করছে। একবার ভাবল, ফোনে সবটা জানাবে। কিন্তু ব্যাংকের চাকরি, টাকাপয়সার ব্যাপার, সব সময় চাপে থাকতে হয়। তা ছাড়া লোকটাকে শত্রু মনে হচ্ছে না। চোখের মধ্যে অসৎ গন্ধ নেই। চোখ দেখে মানুষ বিচার করা যায়। তাই আরও কিছুক্ষণ দেখবে ভেবে আবারও জিজ্ঞেস করল, ‘কেন এসেছেন, কী চাই, না বললে বুঝব কী করে?’ লোকটা এবারও নিশ্চুপ। টুঁ শব্দটি করল না। শেষমেশ বাধ্য হয়ে সদর দরজায় তালা দিয়ে সমরজিৎ বাবু রান্নাঘরে গেল। ইঁদুর ধরার ফাঁদে একটা ইঁদুর আটকে আছে। খটখট আওয়াজের উৎস খুঁজতে বেগ পেতে হলো না। সমরজিৎ বাবু নরম মনের মানুষ। সুনন্দার হাতে পড়লে ইঁদুরটির আর রক্ষা নেই—ভেবে রান্নাঘরের পাশের ব্যালকনিতে গিয়ে ফাঁদের মুখ খুলে দিল। এক লাফে ইঁদুরটি বাগানের ভেতর চলে গেল। মাথা ব্যথা করছে। সমরজিৎ বাবু কড়া লিকার দিয়ে চা করল। দুই কাপ। চিনি ছাড়া। ভেবেছিল চায়ের কাপ হাতে দেওয়ার বদৌলতে লোকটা যদি মুখ খোলে। কিন্তু সে টুঁ শব্দটি করল না। ধৈর্য, সহ্য, মান-অপমান, খারাপ লাগার বোধ লেখকের তুলনামূলক বেশি থাকে। কড়া কথা শোনাতে ইচ্ছে হলেও নিজেকে সামলে নিল সমরজিৎ বাবু। চা কাজে দেয়নি। মাথাব্যথা কমেনি। সে মাথাব্যথা থেকে পরিত্রাণ পেতে অমৃতাঞ্জন আনতে ভেতরের ঘরে গেল। মলমটির সঙ্গে আগে পরিচয় ছিল না। গতবার ভারতে ডাক্তার দেখাতে গিয়ে চিনেছে। মলমটি বেশ কাজের। দুই আঙুল দিয়ে কপালে ডলে আঙুল দুটো নাকের কাছে এনে জোরে কয়েকটা শ্বাস নিলে মাথাব্যথা কমতে শুরু করে।
সমরজিৎ বাবু ডান হাতের তর্জনীতে মলম মাখিয়ে কপালে ডলতে ডলতে এসে সোফায় বসল। লোকটা অসহায়ের মতো মাথা নিচু করে বসে আছে। মায়া লাগলেও সমরজিৎ বাবু দুটো কড়া কথা শোনাবে স্থির করল। কিন্তু বিধি বাম, বিদ্যুৎ চলে গেছে। তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রির ওপরে। সমরজিৎ বাবু গরম সহ্য করতে পারে না। হাতপাখা আনার জন্য উঠে দাঁড়াল। হঠাৎ তাকে বিস্মিত করে কান্না জড়ানো কণ্ঠে লোকটি বলতে শুরু করল,
অজুত নিযুত বছর শেষেও বেঁচে আছি
নিজেকে স্তম্ভ মানি, ঘড়ির কাঁটা খুলে
নক্ষত্রের ভরে মাপি বাটখারার ফাঁকি
সত্যের চেয়ে বড় কোনো অস্ত্র নেই
পৃথিবীতে মৃত্যুই একমাত্র আকাঙ্ক্ষার।
সমরজিৎ বাবু স্তম্ভিত। তার এ কবিতা এখনো কোথাও প্রকাশিত হয়নি। এমনকি ফেসবুকেও শেয়ার করেনি। লোকটি কী করে জানল? মাথাব্যথা, গরম সব মিলিয়ে কোনো ঘোরের মধ্যে আছি; নাকি লোকটি কালো জাদু জানে। ভাবতে ভাবতে ধপ করে সোফায় বসে পড়ল। লোকটা সামনের সোফা থেকে তার পাশের সোফায় এসে বসল।
চলবে….
কেশবপুর, যশোর