কর্মজীবনের প্রস্তুতি

মডেল: তূর্য ও ভাবনাফাইল ছবি: কবির হোসেন

১. বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষ থেকে পার্টটাইম কাজ করুন। যেদিন থেকে কাজে লেগে পড়বেন, মনে রাখবেন, ওই দিন থেকেই ক্যারিয়ার শুরু। এটা আজীবন আপনার মোট অভিজ্ঞতাকে বাড়িয়ে রাখবে। যেকোনো পণ্য এক জায়গা থেকে কিনে আরেকজনের কাছে বিক্রি করার কৌশল, কথা বলার কৌশল, টাকা উপার্জনের কৌশল ছাত্রজীবন থেকে জানা থাকলে কর্মজীবনটা এমনিতেই সহজ হয়ে যাবে।

২. প্রতি সেমিস্টার শেষ হলে একটা প্রতিষ্ঠানে কাজে লেগে পড়ুন। কপিপেস্ট রিপোর্ট দিয়ে ইন্টার্ন না, কমপক্ষে পাঁচ-সাতটি কোম্পানিতে কাজ করুন বন্ধগুলোতে। গ্র্যাজুয়েশনের আগে এক্সপেরিয়েন্স অবশ্যই।

৩. টাকা নয়, কাজ শিখতে প্রথমে কাজ করুন। কাজ দেখান। কোনো একদিন কেউ হয়তো আপনার কাজে খুশি হয়ে প্রথম ৫০০০ টাকা দেবে। তখন থেকে শুরু হবে আপনার পাওয়ার। পরের যেকোনো কাজে বলতে পারবেন, আগে যার ওখানে কাজ করেছেন, তিনি ৫০০০ টাকা দিয়েছেন। সে দেবে ৬০০০ টাকা, এভাবেই দাম বাড়ে। যে কাজই করবেন, সততার সঙ্গে করবেন, ভালোবেসে করবেন, নিজেকে উজাড় করে দিয়ে করবেন, তাহলেই ভালো ফল পাবেন।

৪. স্টুডেন্ট লাইফে চাকরি করে অনেকে বিজনেসের লাইনঘাট বের করে ফেলতে পারে, আপনি তেমন করতে পারলে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হবে না। নিজেই চাকরি দিতে পারবেন। তবে সবাই এ রকম হয় না। তবে যা–ই হোক, যেকোনো একটি লক্ষ্য জীবনে ঠিক করুন। দুই বা ততোধিক ভাবনা লক্ষ্যভ্রষ্ট করে দেবে।

৫. ট্রেনিং করা ও বই পড়াকে অভ্যাস বানিয়ে ফেলুন। এই খাতে বিনিয়োগ যত বাড়াবেন, তত জীবন সহজ হয়ে যাবে। আর যাঁরা আজ এসব করে পয়সা বিনিয়োগ করছেন, তাঁদের দেখে আপনি যদি হাসেন, তাহলে আমার অনুরোধ, বুকে পাথর বাঁধেন। দ্রুতই আপনি নিজেই মহা হাসির পাত্রে পরিণত হবেন। টেনেটুনে ক্যারিয়ার বেশি দূর যাবে না, নিশ্চিত থাকেন। জীবন আপনাকে হাড়ে হাড়ে শিখিয়ে দেবে আপনি কী মস্ত ভুলটাই না করেছেন।

৬. প্রশ্ন আসতে পারে, কী কী প্রশিক্ষণ করব? আমার মতে এক্সেল, পাওয়ার পয়েন্ট, ইংরেজি বলতে ও লিখতে পারার দক্ষতাটুকু অবশ্যই থাকতে হবে। সেই সঙ্গে আপনি যে ফিল্ডে কাজ করতে চান, তার সঙ্গে সম্পৃক্ত প্রশিক্ষণ করে নিজেকে এগিয়ে রাখতে পারেন।

৭. ভাইয়া, কোন কোন বই পড়ব? আমার পছন্দের জীবন সহজকারক ও ক্যারিয়ারবিষয়ক বইয়ের নাম দিচ্ছি। স্টিফেন কভের, ‘দ্য সেভেন হ্যাবিট অব হাইলি ইফেক্টিভ পিপল’ পড়বেন, রবার্ট কিওসাকির ‘রিচ ড্যাড পুওর ড্যাড’ পড়বেন, রবিন শর্মার ‘লিডার হু হ্যাজ নো টাইটেল, দ্য মঙ্ক হু সোল্ড হিজ ফেরারি’ পড়বেন, ব্রায়ান টেসির ‘ইট দ্যাট ফ্রগ’ পড়ুন, ডোনাল্ড ট্রাম্পের ‘দ্য আর্ট অব দ্য ডিল’ পড়ুন, ভিক্টর ফ্রাংকেলের ‘ম্যানস সার্চ ফর মিনিং’ পড়ুন, মার্ক ম্যানসনের ‘দ্য শাটল আর্ট অব নট গিভিং আ এফ’ পড়ুন। যেকোনো বই পড়ুন, পড়তে আপনাকে হবেই, হয় বই নয়তো পিছিয়ে, কোনটা করবেন সিদ্ধান্ত আপনার হাতে। ইংরেজি বই পড়ার সুবিধা একসঙ্গে বইয়ের মেসেজ পাওয়া যায় আবার সঙ্গে ইংরেজি চর্চাটাও হয়ে যায়।

৮. আপনার আয় কত হবে, তা নির্ভর করে আপনি কোন দশজন মানুষের সংস্পর্শে আছেন, তার ওপর। কারণ, ওই ১০ জন মানুষের গড় আয় হচ্ছে আপনার আয়। কাজেই ভালো বন্ধু নির্বাচন করুন। যাদের সঙ্গে আপনার মত মেলে। তাদের ভেতর থেকে কাউকে বেস্ট ফ্রেন্ড নির্বাচন করুন। তার সঙ্গে নিজের পরিকল্পনাগুলো শেয়ার করতে পারেন। নিজেকে হালকা লাগবে। তবে যাকে-তাকে গোপন কথা না বলাই ভালো। কারণ, ৮০ শতাংশ লোক আপনার সমস্যার সমাধান দিতে পারবে না, আর ২০ শতাংশ লোক এটা শুনে খুশি হবে।

৯. জীবনে কী হতে চান, সেই লক্ষ্য স্থির করুন, সেটাকে কাগজে লিখে রাখুন, সেটার ডেডলাইন সেট করুন, আপনার সেই লক্ষ্যপূরণের জন্য আপনার হাতে কী কী শক্তি আছে সেটা যাচাই করুন, কী কী নেই, সেটা চিহ্নিত করুন। একেক সময় একেক লক্ষ্য নির্ধারণ করবেন না। যেটা ঠিক করবেন, সেটা নিয়ে লেগে থাকবেন। কীভাবে সেই লক্ষ্য অর্জন করবেন, তার একটা লিস্ট করে নিন। লিস্টের কোন কোন কাজ কবে নাগাদ শেষ করবেন, সেটাও ঠিক করুন। আজকের কাজ আপনাকে আপনার লক্ষ্যের দিকে কতটুকু এগিয়ে দিচ্ছে, সেটা ঠিক করুন।

১০. একজন ভালো কোচ নির্ধারণ করুন, যার-তার কাছ থেকে পরামর্শ নেবেন না। কারণ, এতে করে আপনি আরও কনফিউজ হয়ে যাবেন। এমন কাউকে কোচ হিসেবে ভাবুন, যিনি আপনাকে জানেন-বোঝেন এবং আপনাকে প্রশ্ন করে করে তিনি আপনার ভেতরের সত্তাকে জাগিয়ে তুলতে পারেন।

১১. ছাত্রজীবনে ঘুরে বেড়ান, শুধু বইয়ে মুখ গুঁজে বসে থাকলে হবে না। নতুন নতুন জায়গা ঘুরুন, মানুষের সঙ্গে মিশুন, একেক জায়গার পরিবেশ ও মানুষের আচরণগত পার্থক্য লক্ষ করুন। সম্ভব হলে দেশের সব কটি জেলা ছাত্রাবস্থায় ঘুরে নিন। দেশের বাইরে একবার ঘুরে আসুন। আর এই সব কটি ট্রিপের টাকা নিজের উপার্জিত অর্থ দিয়ে যেন আসে।

১২. ছাত্রজীবন থেকে আয়ের অনেক উপায় আছে, ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট, ফ্রিল্যান্সিং, পত্রিকায় লেখালেখি, এডিটিং, ফটোগ্রাফি, ভিডিও মেকিং—এসবের মাধ্যমে সহজেই অর্থ আয় করা সম্ভব। পার্টটাইম জব বা ভলান্টিয়ার জবের মধ্যে আছে বিভিন্ন হোটেল-রেস্টুরেন্টে বা সুপার শপে কাজ করা। আমাদের বাসার পাশের রেস্টুরেন্টের ছেলেগুলো ভার্সিটির থার্ড ইয়ারে পড়ে। সেদিন সিলেটের বিছনাকান্দি গেলাম, মাঝি ছেলেটা স্কুলের ফাঁকে ফাঁকে নৌকা বায়। বাজারে একটা কলেজে পড়া ছেলেকে চিনি, সে ভোররাতে উঠে আড়ত থেকে মাছ এনে বিক্রি করে, এরপর কলেজে যায়। দুনিয়ার কোনো কাজ ছোট নয়। কাজেই আজ থেকেই লেগে পড়ুন পছন্দের যেকোনো কাজে। কিছু না পারুন, অন্তত দুটি টিউশনি করান। নিজের খরচ নিজে চালান।

১৩. একটি বানরের সামনে আপনি যদি কলা আর ১০০০ টাকার একটি নোট রাখেন, বানরটা কলা নেবে। কারণ তার এই বুদ্ধি নেই যে টাকা দিয়ে আরও অনেকগুলো কলা কেনা সম্ভব। তেমনি আপনার জীবনে চলার পথেও কোন কাজটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ আর কোনটা কম গুরুত্বপূর্ণ, সেটাও আপনাকেই বুঝতে হবে। ছোটখাটো অনেক বিষয় জীবনে ছাড় দিতে হবে বড় কোনো লক্ষ্য অর্জনের জন্য। লোভ এবং লাভের মধ্যে পার্থক্য বুঝতে হবে।

১৪. নেটওয়ার্কিং খুবই দরকারি। ছাত্রজীবনের ৫৫% সময় পড়াশোনা আর ৪৫% সময় দিতে হবে নেটওয়ার্কিংয়ের পেছনে। আপনার ভার্সিটির বড় ভাই-আপুরা কে কোথায় চাকরি করছেন, সেটার খোঁজ রাখুন। বিভিন্ন ক্লাবের সঙ্গে যুক্ত হন, ভলান্টিয়ার হিসেবে কাজ করুন। নেটওয়ার্ক এবং সুপারিশ এক নয়। দিনে দিনে সুপারিশের কদর কমছে। আপনার কোনো কাজ যদি জানা না থাকে, তাহলে নেটওয়ার্ক কাজ করবে না। মানুষ মূল্যায়িত হয় কেবলই তার কাজ দিয়ে।

১৫. একবার এক লোককে একটি দোকানে চাকরি দেওয়া হলো। সে বলল, এ কাজে স্বাধীনতা নেই। তাকে স্বাধীনতা দেওয়া হলো। সে ভাবল, হয়তো তার জন্য কোনো ফাঁদ পাতা হয়েছে। তাকে কুটিরশিল্প করতে বলা হলো। সে বলল, এতে তার সীমিত আয় হবে। তখন তাকে ব্যবসা করতে বলা হলো। সে জানাল, তার কাছে টাকা নেই। এরপর তাকে কিছু টাকা দেওয়া হলো। সে বলল, আমার যে কোনো লিং নেই। এবার তাকে কিছু লিংক দেওয়া হলো। সে জানাল, তার তো কোনো অভিজ্ঞতা নেই। তখন অভিজ্ঞতা দিতে তাকে ট্রেনিং করানো হলো। সে জানাল, তার আসলে ট্রেনিংয়ে হবে না, তার দরকার নতুন আইডিয়া। সে ভাবল, এতে নিশ্চয়ই ঝুঁকি আছে। তাকে বলা হলো তোমার বন্ধুও তো এই ব্যবসা করছে। সে বলল, ও তো পাগল। কিন্তু তোমার বন্ধু তো ভালো করছে। সে বলল, ও তো লাকি। তাকে জিজ্ঞেস করা হলো, তাহলে তুমি কী করতে চাও? সে আর উত্তর দিতে পারল না। গল্পের মূল শিক্ষা হচ্ছে অজুহাতটা ঝেড়ে ফেলে দাও। কঠিন কাজটা আগে করো। ঝুঁকি না নেওয়াটাই বড় ঝুঁকি।

লেখক: প্রধান নির্বাহী পরিচালক, করপোরেট আস্ক।

প্রথম আলো বন্ধুসভা জাতীয় পরিচালনা পর্ষদের প্রকাশনা ‘তারুণ্য’, সপ্তম সংখ্যা, আগস্ট ২০১৮ থেকে নেওয়া।