‘প্রিয়তমা’ অশ্রু দিয়ে ফোটানো শাপলা ফুল

‘প্রিয়তমা’ সিনেমায় শাকিব খান ও ইধিকা পালছবি : পরিচালকের সৌজন্য

হিমেল আশরাফের ‘প্রিয়তমা’ চলচ্চিত্রের পোস্টারে শাকিব খানের বৃদ্ধ বয়সের ভঙ্গুর রূপ দেখে প্রথমে মনে হচ্ছিল, গৌতম ঘোষের ‘মনের মানুষ’ সিনের লালন; মানে লালন ফকির, অভিনেতা প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়কে দেখছি। চলচ্চিত্র দেখতে গিয়ে বুঝলাম, না, এই রূপ, এই চরিত্র অনেকটা আলাদা। তবে শাকিব খানের বৃদ্ধ বয়সের রূপ দেখে আন্দাজ করে নেওয়ায় যায়, শেষে এমন কিছু ঘটবে, এই পর্যায়ে এসে পৌঁছাবে নায়ক। হয়ে উঠবে একজন প্রেমের পীর, বিরহে কাতর ফকির।

‘প্রিয়তমা’ চলচ্চিত্রে হৃদয়ে মোচড় দিয়ে চোখে পানি নিয়ে আসা অসাধারণ কাহিনিটি লিখেছেন ফারুক হোসেন। অনেকের মনে হয়েছে শাকিবের এই রূপের সঙ্গে ব্যক্তি ফারুকের অনেকটা মিল আছে। ফারুক ও আত্মমগ্ন প্রকৃতির, মিতবাক, কিছুটা গম্ভীর মনে মনে কথা বলা মানুষ। তবে পরিচালক ফারুকের রূপকে মনে রেখে শাকিবের রূপকার হয়ে ওঠেননি; বরং গল্পের রূপকে শিকড়ে জল দিয়ে পরম মমতায় রৌদ্র ঝিলিকে পাতায় পাতায় ফুলে ফুলে রাঙিয়ে তুলেছেন। পরিবেশ পরিস্থিতির চাপে নায়কের অনেকগুলো রূপ ভাবতে ভাবতে এই পর্যায়ে এসে পৌঁছেছেন।

কাহিনিকার ফারুক হোসেন কক্সবাজারে বেড়াতে গিয়ে সমুদ্রের জলে হারিয়ে গিয়েছিলেন। এই হারিয়ে যাওয়াটা বেশ মর্মান্তিক, হৃদয়বিদারক ও রহস্যজনক। ‘প্রিয়তমা’ চলচ্চিত্রের শুরুতেও সুমন, মানে শাকিবের দাদা সুজন এবং তার ব্যবসা দেখাশোনা করা ম্যানেজার হারিয়ে যান। ম্যানেজারকে কক্সবাজারের ব্যবসায়িক অংশীদার, স্থানীয় ভিলেন ওসমান যে খুন করেছে, শুরুতেই তা দেখানো হয়েছে। সুমনের মনে হয়েছে, তার দাদা সুজনও হারিয়ে যায়নি, তাকে খুন করা হয়েছে। ওসমানের কাছ থেকে ব্যবসায় বিনিয়োগ করা বিপুল টাকা উদ্ধার করতে সুমন কক্সবাজারে আসে। একটা পর্যায়ে রহস্য উন্মোচিত হয় এবং ওসমানকে বেশ মারধর করে সুমন পুলিশের হাতে তুলে দেয়। খুনখারাবি, মারপিট, গালিগালাজ ও স্থানীয় রাজনীতি শুরু থেকে মনে হচ্ছিল অন্য একটা অন্ধকার জগতের ছবি তুলে আনতে চলেছেন পরিচালক। ক্রমে সেই জগৎ ছাড়িয়ে উঠে আসে অন্য জগৎ।

কিংবদন্তী গীতিকার পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় মুহূর্তের তীব্র আত্মবিষাদে কলকাতার গঙ্গায় আত্মবিসর্জন দিয়েছিলেন। গীতিকারের আত্মহননের পর মান্না দের কণ্ঠে তাঁর লেখা বিখ্যাত একটি গানের অংশ আলোচনায় উঠে আসে। পুলক লিখেছিলেন, ‘যখন এমন হয়/জীবনটা মনে হয় ব্যর্থ আবর্জনা/ভাবি গঙ্গায় ঝাঁপ দিই/রেললাইনে মাথা রাখি/কে যেন হঠাৎ বলে, ‘আয়, কোলে আয়, আমি তো আছি, ভুললি তা কি?’ অনেকের মনে হতে শুরু করেছে কবি, গীতিকার পুলক কি তবে চেতনে, অবচেতনে সৃষ্টির মধ্য দিয়ে তেমন একটি অবস্থায় পৌঁছে যাচ্ছিলেন? সেই ইঙ্গিত দিয়ে যাচ্ছিলেন?

‘প্রিয়তমা’ সিনেমার দৃশ্য
সংগৃহীত

সেই রচনা হঠাৎ বেদনাদায়ক, সত্যি হয়ে গেল? ফারুকের ক্ষেত্রেও তিনি আত্মহত্যা করেছেন এমনটা কোনো অবস্থাতে বলা যাবে না। কিন্তু কাহিনিতেও কক্সবাজার আছে, আবার এই কাহিনির যে প্রিয়তমা নায়িকা ইতি, সে–ও অবধারিত মৃত্যুর আগে নিজেই নিজেকে শেষ করে অন্তিম শূন্যপুরে পৌঁছে যান। এই শূন্যতা, এই অন্তিম প্রহর চেতনে–অচেতনে ফারুকের মধ্যেও কি ঘুরে বেড়াত না? বিষাদ থেকে মহৎ সৃষ্টির উৎপত্তি হয়। সৃষ্টিশীল মানুষেরা কঠিন সাধনার কঠোর জীবনযাপন অধ্যবসায়ের মধ্য দিয়ে সৃষ্টির পথে এগিয়ে যান। কক্সবাজারে টাকা উদ্ধার করতে গিয়ে স্থানীয় চেয়ারম্যানের সুন্দরী কন্যা ইতির প্রেমে পড়ে সুমন। সেই ইতিকে হারিয়ে নিঃসঙ্গ মহৎ প্রেমিক, নিজের ভেতরে ভাঙতে ভাঙতে সারাটা জীবন ইতির স্মৃতি আঁকড়ে বেঁচে থাকে। বৃদ্ধ বয়সেও রোজ মানসীর কবরের সামনে গিয়ে কেঁদে ওঠে, অতল শূন্যতার ভেতর প্রেম ও জীবনকে হাতড়ে বেড়ায়। রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর কালজয়ী ‘ভালো আছি, ভালো থেকো’ গানটি আমাদের বারবার অকালে রুদ্রের হারিয়ে যাওয়াকে মনে করিয়ে দেয়। রুদ্রের জন্য মন কেঁদে ওঠে। হিমেল আশরাফের ‘প্রিয়তমা’ চলচ্চিত্রটিও বাস্তবের সৃষ্টিকর্তা ফারুকের হারিয়ে যাওয়ার ব্যথায় অমর হয়ে থাকবে।

চলচ্চিত্রের শেষে যে এ রকম একটা মোচড় আছে, প্রথমের দীর্ঘ সময় আমাদের বুঝতে দেননি পরিচালক। অথবা বলা যেতে পারে সলতে পাকিয়ে পাকিয়ে গল্পের ভেতরে গল্প দিয়ে চরিত্রের ডালপালা মেলে, আমাদের উত্তেজিত করে, আমাদের হাসি–আনন্দে উৎফুল্ল করে, আমাদের বিষাদে–বেদনায় জর্জরিত করে, মূল ধাক্কাটার সম্মুখীন হতে নিয়ে যাচ্ছিলেন।

শাকিব খান এই চলচ্চিত্রে নিজেকে ভেঙে, নতুন করে গড়ে দেখিয়েছেন। তাঁর ঢেউখেলানো চুলের বাহারও সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো এই চলচ্চিত্রের সম্পদ।

‘প্রিয়তমা’ অবশ্যই একটি বেদনাবিধুর মর্মস্পর্শী প্রেমের কাহিনি। তবে অন্য দশটি প্রেমকাহিনির মতো প্রেমকে অমর করবেন বলে পরিচালক চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করেননি। সব শ্রেণির দর্শকের কথা মাথায় রেখে একটি সফল বাণিজ্যিক বিনোদনের চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে চেয়েছেন। বেশ কিছু ভুলত্রুটি থাকলেও নিজের অদম্য আন্তরিক প্রচেষ্টা ও দক্ষ মুনশিয়ানায় সফল কারিগর হয়ে উঠতে পেরেছেন। এখানেও আরেকটি ধ্রুব সত্য উঠে আসে, জীবনের ঝড়–ঝঞ্ঝায় লড়াই করে টিকে থেকে ভালোবাসার সৃষ্টি সাধনাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হয়। মনের মধ্যে পাহাড়সম একটা দুঃখের ঝড় কাটিয়ে উঠে পরবর্তী লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত হতে হয়।

সোমেশ্বর অলির লেখা ও প্রিন্স মাহমুদের সুর করা রিয়াদের কণ্ঠে ‘ঈশ্বর কি তোমার আমার মিলন লিখতে পারত না’ চিকন করুণ অসাধারণ বিরহ দহনের গানটির রেশ চলচ্চিত্রের শেষেও মনের মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকে। ‘কোরবানি কোরবানি’ গানটি প্রার্থনার গান হলেও বাণিজ্যিক সিনেমার আইটেম সং ধরনের গান। ‘ও প্রিয়তমা’, ‘গভীরে’, ‘তোমার পরশ’ গানগুলোও ভালো লাগে।

চট্টগ্রামের খাঁটি আঞ্চলিক ভাষার মানুষেরা অন্য জায়গার মানুষের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করলে, আদান–প্রদানের সুবিধার্থে একটু মিশ্র ভাষা উঠে আসে। সিনেমার খলনায়ক শহীদুজ্জামান সেলিমের সংলাপে তা বোঝা যাচ্ছিল। তবে পুরোপুরি চট্টগ্রামের ভাষার টান, যা আমি নিজেও মা–বাবার মুখে শুনেছি, তা কিন্তু সেলিম ততটা রপ্ত করতে পারেনি। বেশ কয়েকটি আঞ্চলিক গালাগাল এখানে উঠে এসেছে। শাকিব খান এই চলচ্চিত্রে নিজেকে ভেঙে, নতুন করে গড়ে দেখিয়েছেন। তাঁর ঢেউখেলানো চুলের বাহারও সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো এই চলচ্চিত্রের সম্পদ। শাকিব আর ইধিকার টুকরা টুকরা দুষ্টু মিষ্টি প্রণয় দৃশ্যগুলোও শিমুল তুলার মতো নরম, আকাশের হাজার তারার মধ্যেও যেন জ্বলতে থাকা মাটির প্রদীপ। দুজনের ভুল–বোঝাবুঝি একটা পাহাড়সম অভিমান থেকে বিরহ দংশন দুটি পথ দুই দিকে ছিনিয়ে নিয়ে গিয়ে চলতি হাওয়ার পন্থী হয়ে উঠতে দেয় না। ইধিকার মুখের ভুল ইংরেজিও আনন্দ দেয়। শাবনূরের মতো এই নবাগতাও চোখের ভাষায় কথা বলতে পারেন। ভবিষ্যতে তিনি অনেক দূর এগিয়ে যেতে পারবেন বলে বিশ্বাস।

পরিচালক কাজী হায়াৎকে চলচ্চিত্রে পেলাম সুমন, সুজনের বাবা হিসেবে। লুৎফুর রহমান জর্জ, লুৎফুর রহমান খান, এলিনা শাম্মী, শিবা শানু সবাইকে নিজের নিজের ভূমিকায় ভালো লাগে। চলচ্চিত্রের দৃশ্যায়ন, ক্যামেরার ভাষা চমৎকার। তরুণ পরিচালক হিমেল আশরাফ বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকে বিশ্বধারার পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে চলেছেন। সবশেষে বলতেই হয়, ‘প্রিয়তমা’ অশ্রু দিয়ে ফোটানো শাপলা ফুল।

হাওড়া, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত