নজরুলের জীবনের মজার কিছু ঘটনা

কাজী নজরুল ইসলামপ্রতিকৃতি: মাসুক হেলাল

অসামান্য প্রতিভাবান কবি কাজী নজরুল ইসলাম কেবল বিদ্রোহী চেতনার মানুষই ছিলেন না, তাঁর মধ্যে লুকায়িত ছিল অপরিমেয় রঙ্গ-তামাশা বোধ। ভীষণ আয়েশি আড্ডাবাজ স্বভাব এবং যেকোনো পরিস্থিতিতে খোশমেজাজে থাকতে পারা কাজী নজরুল ইসলামের রসবোধ সম্পর্কে তাঁর লেখনীর মাধ্যমে আমরা সবাই কমবেশি পরিচিত। শিশু–কিশোরদের প্রিয় হৃদয়পটে চিরভাস্বর কবি নজরুলের জীবনের কিছু মজার ঘটনা আজ তুলে ধরব।

এক.
একদিন নজরুল বারান্দায় বসে আছেন। দেখলেন একটা পেয়ারাগাছের নিচে দাঁড়িয়ে চোখ-ঠোঁট উল্টিয়ে, হাত-পা নেড়ে একটি মেয়ে কার সঙ্গে যেন কথা বলছে। সেই কথা আর শেষই হতে চায় না। নজরুল ভাবলেন, নিশ্চয়ই কেউ পেয়ারা গাছে উঠেছে। তার কাছে কাকুতি-মিনতি করে মেয়েটি পেয়ারা চাইছে। কিন্তু গাছের ওপর যে, সে পেয়ারা দিচ্ছে না। নজরুল তো ছোটদের খুব ভালোবাসতেন। তিনি ভাবলেন, মেয়েটির হয়ে পেয়ারা চাইবেন। ছেলেটা দেয় তো ভালো, না দিলে নিজেই পেয়ারা পেড়ে দেবেন। মজার ব্যাপার হলো, সামনে গিয়ে কবি গাছের ওপর কাউকেই দেখতে পেলেন না। তবে মেয়েটি কথা বলছিল কার সঙ্গে? নজরুল জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি কার সঙ্গে কথা বলছিলে?’ জবাবে বলল, ‘কাকাবাবু! ওই দেখো দুষ্টু কাঠবেড়ালী। রোজ রোজ দুষ্টুটা পেয়ারা খেয়ে পালিয়ে যায়। আমাকে একটাও দেয় না।’ কাঠবেড়ালীর সঙ্গে ছোট মেয়েটির এই মান–অভিমানের এই ঘটনা নজরুলকে এতটাই চমৎকৃত করল যে ঘটনাটিকে স্মরণীয় করে রাখার জন্যই তিনি লিখলেন ‘খুকী ও কাঠবেড়ালী’ নামের সেই কবিতা—
‘কাঠবেড়ালী! কাঠবেড়ালী!
পেয়ারা তুমি খাও?
গুড়-মুড়ি খাও! দুধ-ভাত খাও?
বাতাবি লেবু? লাউ?...’

দুই.
অতিরিক্ত কথা বলা ব্যক্তিদের কাজী নজরুল ইসলাম একদম পছন্দ করতেন না। সময়ভেদে তাঁদের এমন অপমান করতেন যে তাঁরা সারা জীবনের শিক্ষা পেয়ে যেতেন। গ্রামোফোন কোম্পানির সঙ্গে নজরুলের যেহেতু সদ্ভাব ছিল, তাই যেকোনো প্রয়োজনে কোম্পানির লোকেরা নজরুলের সাহায্য পেতেন। একবার গ্রামোফোন কোম্পানিতে রেকর্ডে গান দিতে এক ব্যক্তি এলে তাঁকে নজরুলের কাছে পাঠানো হয়, তাঁর গানের দৌড় পরীক্ষা করার জন্য। লোকটি হারমোনিয়াম নিয়ে কবির সামনে বসলেন। কিন্তু গান শুরু না করে তিনি কার কাছে গান শিখেছেন, কবে তাঁর গান শুনে কে প্রশংসা করেছে, তিনি কতখানি পাণ্ডিত্যের অধিকারী ইত্যাদি বকবক করেই যাচ্ছিলেন। নজরুল তখন বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘আপনি তো দেখছি একটি জানোয়ার লোক।’ ভদ্রলোক নজরুলের এ কথায় বেশ উত্তেজিত হলেন। নজরুল বললেন, ‘না না অন্য কিছু মনে করবেন না, দেখলাম আপনি অনেক কিছু জানেন, তাই আপনার সম্বন্ধে “জানোয়ার” শব্দটি প্রয়োগ করেছি!’ লোকটি হা করে বসে রইলেন।

তিন.
কাজী নজরুল ইসলামের লেখার কারণে সরকার তাঁর পেছনে গোয়েন্দা লাগিয়ে রাখত সব সময়। কিন্তু রসিক নজরুলের কাছে ঝানু গোয়েন্দা নাস্তানাবুদ হলো। ঘটনার স্থান কবি সুফিয়া কামালের বাড়ি। সুফিয়া কামাল স্বামীর সঙ্গে কলকাতায় যে বাড়িতে বাস করতেন, সে সময় কাজী নজরুল প্রায়ই তাঁদের বাড়িতে বেড়াতে যেতেন। সুফিয়া কামাল নাকি তাঁকে ‘দাদু’ বলে ডাকতেন। তিনি কবি সুফিয়া কামালের বাড়িতে গেলে সেখানে গানের আসর বসত এবং সে আসরে পাড়ার অনেকেই এসে উপস্থিত হতেন। কিছু গোয়েন্দাও তাঁদের সঙ্গে মিশে যেতেন। তো একদিন এক ভদ্রলোকের মুখের ওপর বিদ্রোহী কবি কবিতা আওড়ালেন—‘তুমি টিকটিকি, জানি ঠিকঠিকই।’

তখনই লোকটি রক্তরাঙা মুখে সে স্থান পরিত্যাগ করতেই কবি সুফিয়া কামাল জিজ্ঞেস করে বসলেন, ‘কী করে তুমি চিনলে দাদু?’ বিদ্রোহী কবি হেসে জবাব দিলেন, ‘গায়ের গন্ধে। ও আমার বড় কুটুম্ব যে!’

আন্দোলন, প্রেম, রাজনীতি, কী নেই কবি নজরুল ইসলামের গান-কবিতায়। হৃদয়নিংড়ানো অনুভূতি কাজী নজরুলের মতো এত সহজ–সরল করে কে–ই বা লিখতে পেরেছেন? তাই তো তিনি বিদ্রোহী কবি। কবির ১২৪তম জন্মদিনে তাঁর প্রতি রইল শ্রদ্ধা।

তথ্যসূত্র: রসিক নজরুল-হিরণ্ময় ভট্টাচার্য