মন্বন্তরের ভেতর-বাইরের গল্প সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ‘নয়নচারা’

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ‘নয়নচারা’

‘নয়নচারা’ গল্পটি কথাসাহিত্যিক সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর সাহিত্য সাধনার সূচনাপর্বের ‘নয়নচারা’ গল্পগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন দুর্ভিক্ষের প্রেক্ষাপটে সমাজের অন্তর্বাস্তবতা উন্মোচনে গল্পটি রচিত। বিশ্বব্যাপী যুদ্ধের প্রভাব আর মন্বন্তরের আঘাতে বিপর্যস্ত তখন বাংলা। সমকালীন পটভূমিতে দাঁড়িয়ে সাধারণ মানুষের জীবনযন্ত্রণা, মৃত্যু; অপর দিকে সম্পদশালী, ক্ষমতাবানদের নির্দয় প্রহসনকে লেখক নির্মোহ দৃষ্টিতে চিত্রিত করেছেন।

গতানুগতিকভাবে দুর্ভিক্ষের করুণ দৃশ্যের বর্ণনা দিয়ে গল্পের শুরু হয়নি। যুদ্ধ-মন্বন্তরে ভিটাছাড়া, কৈশোর হারানো এক কিশোরের মনোজগতের বেদনা আর কল্পনায় আঁকা দৃশ্য দিয়ে আরম্ভ করেছেন লেখক, ‘ঘনায়মান কালো রাতে জনশূন্য প্রশস্ত রাস্তাটাকে ময়ূরাক্ষী নদী বলে কল্পনা করতে বেশ লাগে।’

ময়ূরাক্ষী নদীর তীরের নয়নচারা নামের গ্রামের কিশোর আমু। দুর্যোগে, দুর্ভিক্ষে গ্রাম থেকে যায় সদা সুবিধাবঞ্চিত। এখানে পৌঁছায় না ক্ষমতাবানের কৃপার হাত। ক্ষুধার তাড়নায় মৃতের মিছিল পেরিয়ে তাই দুমুঠো ভাতের সন্ধানে আরও শত শত মানুষের মতো নিজ গ্রাম ছেড়ে শহরে এসেছে সে। সঙ্গে আছে তার গ্রামের ভুতো, ভুতনি আর চেনা-অচেনা নিরন্ন মানুষের দল। শহরের কালো সড়কের ধারে ফুটপাতে এলিয়ে আছে তারা। সরকারি লঙ্গরখানায় কখনো চারটে খেতে পায়, কখনো পায় না। খাবারের অভাবে মারা গিয়েছে ভুতনির ভাই ভুতো। প্রতিদিন মারা যাচ্ছে শত শত অনাহারী মানুষ। লেখকের ভাষায়, ‘সে মরেছে, ও মরেছে; কে মরেছে বা কে মরছে, সেটা কোনো প্রশ্ন নয়, আর মরছে মরেছে কথা দুরঙা দানায় গাঁথা মালা।’

আমু ভাবুক। তার কল্পনাপ্রবণ মন চিরচেনা গ্রামের সরল–উদার জীবনের সঙ্গে শহরের মানুষের নির্দয়–যান্ত্রিক আচরণের তফাত দেখে প্রতিনিয়ত। দুর্ভিক্ষ-পীড়িত আমুর বুকে শেল হয়ে বিঁধে শহুরে জনস্রোতের নির্বিকার হাসি-কোলাহলের জীবনযাত্রা। ‘আমুরা যখন ক্ষুধার যন্ত্রণায় কঁকায়, তখন পথচলতি লোকেরা যেমন আলাদা অপরিচিত দুনিয়ার কোনো অজানা কথা নিয়ে হাসে, এ-ও যেন তেমনি হাসছে।’
ময়রার দোকানে ননি থাকলেও তার চোখে সেই ননি-কোমলতা নেই। খাবারের দোকানে দাঁড়ানোর অপরাধে হতে হয় রক্তাক্ত। শহুরে অগণিত মানুষের কাছে ক্ষুধা মেটানোর তাগিদে ভিক্ষা চাইতে গেলে বিনিময়ে তারা পায় হিংস্রতা। বহুতল দালানের পাষাণ ভেদ করে মমতার ছোঁয়া প্রকাশ পায় না তারা। মানুষ যেন বাইরে মানুষ, ভেতরে কুকুরে পরিণত। তার পর্যবেক্ষণ, আশ্চর্য কথা—শহরের কুকুরের চোখে বৈরিতা নেই। (এখানে মানুষের চোখে এবং দেশে কুকুরের চোখে বৈরিতা।) কিংবা তারপর জানলে যে ওরা মানুষ, কুকুর নয়। অথবা ভেতরে কুকুর, বাইরে কুকুর নয়।

অমানবিক এই নিষ্ঠুরতায় দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া ‘ভেতরে-বাইরে মানুষ’ আমুর ভেতরে জাগে প্রতিবাদী সত্তা। শক্তিশালী, এমনকি হয়তো সৃষ্টিকর্তার বিরুদ্ধেও বিদ্রোহী হয়ে ওঠে তার মন। ঈশ্বর সেজে বসে থাকা মানুষদের প্রতি আক্রোশে ধ্বনিত হয়, ‘আর এ সন্ধ্যায় তুমি আমাকে নির্মমভাবে কণ্টকাকীর্ণ প্রান্তরে দাঁড় করিয়ে রেখেছ? কে তুমি, তুমি কে? জানো সারা আকাশ আমি বিষাক্ত রুক্ষ জিহ্বা দিয়ে চাটব, চেটে-চেটে তেমনি নির্মমভাবে রক্ত ঝরাব সে-আকাশ দিয়ে—কে তুমি, তুমি কে?’
পরক্ষণে দুর্বলের অনুভূতিতে সে অনুতপ্ত হয়। ক্ষমতা আর শক্তির আধিপত্যের এই পৃথিবীতে দুর্বল হওয়াই যেন তার অপরাধ। দুর্ভিক্ষের করালগ্রাসেও যাদের জীবনে এর আঁচ লাগেনি, সেই সুবিধাভোগী শ্রেণির কাছে আমুদের জীবন মূল্যহীন। তাই সে ক্ষমা চায়, ‘দুটি ভাত দিয়ে শক্তিশালী তাকে ক্ষমা করুক।’ এভাবে চেতনাপ্রবাহ রীতির বর্ণনায় দুর্ভিক্ষপীড়িত আমুর মনোজগতের ভাবনার মাধ্যমে উন্মোচিত হয়েছে দুর্ভিক্ষের অন্তর্বাস্তব।

নগরের অলিগলিতে অন্নের সন্ধানে নিরুপায় ছুড়ে বেড়ায় আমু। শহরের ধাঁধাময় সেই পথগুলো তার জন্য আশ্রয়ের সন্ধান দেয় না। দিন শেষে দেহের সর্বশক্তি দিয়ে আর্তচিৎকার করে ভাতের জন্য। অবশেষে কোনো এক বধূর দয়ায় ভিক্ষা পায়, বিস্মিত আমু তখন আকুল হয়ে জানতে চায় মেয়েটির কাছে, ‘নয়নচারা গাঁয়ে কী মায়ের বাড়ি?’
এ বক্তব্যেই ‘নয়নচারা’ গল্পের অন্তর্নিহিত তাৎপর্যকে প্রতিফলিত করে। আবাল্য গ্রামে বেড়ে ওঠা কিশোর আমু হয়ে ওঠে দুর্ভিক্ষের করালগ্রাসে ভিটামাটি হারানো মানুষের প্রতিনিধি। ফুটে ওঠে গ্রাম–শহরের জীবনযাত্রার, বোধের ব্যবধান। লেখক দেখাতে চেয়েছেন, এই দুর্ভিক্ষ প্রাকৃতিক দুর্যোগ নয়, মানবসৃষ্ট। নির্দয় ক্ষমতাশালী আর কালোবাজারি, মুনাফাখোর ব্যবসায়ীর লোভের ফসল। আমুদের মতো বাংলার হাজারও অসহায় জনগণ যার গ্রাস হয়েছে। পথে-প্রান্তরে মারা গিয়েছে লাখ লাখ মানুষ।
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ‘নয়নচারা’ গল্পটি তাই কেবল দুর্ভিক্ষের দুর্দশার বর্ণনা নয়, কাব্যিক ভাষায় ও চেতনাপ্রবাহ বৈশিষ্ট্যের বর্ণনায় উপস্থাপিত তেতাল্লিশের মন্বন্তরের ভেতরে-বাইরের বাস্তবতার গল্প।