আমি একটি মানুষকে খুন করতে যাচ্ছি। অতি নিরীহ মানুষ। পৃথিবীতে তার কেউ নেই। একেবারে এতিম ও অতি দরিদ্র একজন মানুষ। তার দ্বারা আমি কোনো প্রকার ক্ষতিগ্রস্ত হইনি, ভবিষ্যতেও হওয়ার সম্ভাবনা নেই। তবু তাকেই খুন করব। খুন করে আমার আমিত্বকে একটু হাইলাইটস করতে চাই। ধারালো কোনো অস্ত্র দিয়ে খুন করব না। পিস্তল দিয়েও নয় বা নিষ্ঠুর কোনো উপায়েও নয়। তাকে খুন করব কলম দিয়ে।
হয়তো ভাবছেন এটা কী ধরনের কথা! কলম দিয়ে কি মানুষ খুন করা যায়? বড়জোর কলম দিয়ে গুঁতা দিয়ে কাউকে আঘাত করা যায়। চোখে গুঁতা দিলে হয়তোবা লোকটি অন্ধ হয়ে যেতে পারে। আসলে আমি বলতে চাচ্ছি, আমার লেখা একটা গল্প নিয়ে। লেখাটা যখন শুরু করি, তখন পরিকল্পনা ছিল একটি মিষ্টি–মধুর প্রেমের গল্প হবে। গল্পে থাকবে রাগ-অনুরাগ, মান-অভিমান, মজাদার সংলাপ, হালকা-পাতলা হাসির কথা, শেষে নায়ক-নায়িকার মিলন ঘটিয়ে গল্পটা শেষ করব। কিন্তু অর্ধেক লিখে সিদ্ধান্ত পাল্টে ফেললাম।
গল্প-উপন্যাসে আমরা চরিত্রগুলোকে এত সুন্দর পরিপাটি করে সাজাই যে তা পড়ে পাঠক মুগ্ধ হয়ে সেগুলোকে গিলে খায়, আত্মতৃপ্তি লাভ করে। অনেক ভেবে দেখিনি। তবে সামান্য ভেবেই বুঝতে পেরেছি, বাস্তব জীবনটা আমাদের মোটেই সে রকম নয়। মানুষ যা চায়, সবকিছুই কি সহজেই পেয়ে যায়? মোটেই পায় না। অনেক কষ্ট ও ত্যাগ–তিতিক্ষা স্বীকার করেও কখনো কখনো আমাদের কারও কপালে সামান্যতম কিছু পাওনাও জুটে না। অবশ্য অনেকে এমন আছে, যারা না চাইতেও অনেক কিছু পেয়ে যায়। আর যারা পায় না, তারা হাহাকারে সারা জীবন কাটিয়ে দেয়।
আমরা যারা সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির লোকদের নিয়ে পর্যবেক্ষণ বা গবেষণা করি, তারা অতি সহজেই চোখে তা দেখি। একজন লোক সারা জীবন সৎ থাকল, কিন্তু দেখা গেল অনেক কষ্ট করেও ভালো মানের উপার্জন করতে পারছে না। সৃষ্টিকর্তার উপাসনাতেও ত্রুটি রাখছে না, পরিশ্রমেও ঘাটতি নেই; তবু তার জীবনে নুন আনতে পান্তা ফুরায়।
অন্যদিকে আলেম সমাজ বলে থাকে, আল্লাহপাক ইমানদার বান্দাদের পৃথিবীতে দুঃখ-কষ্টে রেখে তাদের ইমানি পরীক্ষা নেন। এ পরীক্ষায় সফলভাবে কৃতকার্য হলে তাদের জন্য পরকাল ধবধবে সাদা। এটা বিধাতার অপরিবর্তনীয় বিধান। এটাকে খণ্ডন করার উপায় আছে কি নেই, তা জানা নেই। অনেকে বলেন, দোয়ার মাধ্যমে মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন হতে পারে। কোনটা সঠিক, তা–ও আমার ধারণা নেই। আমি যে কথা বলতে চাচ্ছি, তা হলো লেখক সমাজে অনেক লেখকই এমন আছেন, যাঁরা অতি চমৎকারভাবে একটি ঘটনাকে যদিও সেটার সঙ্গে বাস্তবতার মিল নেই, রহস্যময়ভাবে ফুটিয়ে তুলেন। পাঠক নাওয়া–খাওয়া ভুলে মন্ত্রমুগ্ধের মতো পড়ায় আছন্ন হয়ে থাকেন। কী পড়ছেন, কতটুকুই-বা বাস্তবতার সঙ্গে মিল আছে, তা–ও খুঁজে বা বুঝে উঠতে পারেন না।
সিনেমা-নাটকের কাহিনির মতো জীবন নয়। বাস্তবে আমাদের জীবনে অনেক কিছু চাওয়া-পাওয়া থাকলেও সেটা সেভাবে পাই না। অনেক কিছু পাওয়া থেকে বঞ্চিত হয়ে থাকি। না পাওয়ার যন্ত্রণায় হতাশায় নিমজ্জিত হই। অনেকে আবার যন্ত্রণার ভার সইতে না পেরে আত্মহননের পথ বেছে নেয়।
জীবন আসলেই কঠিন। এখানে আবেগের কাছে বশীভূত হওয়ার সুযোগ নেই। তাই ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও অনেক গল্পকে মিলনাত্মক করা যায় না। চোখের জলে ভেসে ভেসে গল্পটি শেষ করতে হয়। এটাই নিয়তি।
সিনিয়র শিক্ষক, দনারাম উচ্চবিদ্যালয়, ফেঞ্চুগঞ্জ, সিলেট