রহস্যে ঘেরা ইজিপ্টোলজি

সাড়ে চার হাজার বছরের পুরোনো গ্রেট পিরামিড অব গিজাছবি: রয়টার্স
সেদিন আমার একাডেমিক বাংলা পড়ার ইচ্ছা উবে গেলেও জন্ম নিয়েছিল আরেকটা নতুন ইচ্ছা—দ্বিতীয় আলী আহসান হওয়ার ইচ্ছা।

নাকের নিচের জায়গাটায় দাগ টেনে দিয়েছে সদ্য উঁকি দেওয়া গোঁফের সারি—সেই রঙিন স্বপ্নময় কৈশোরের কথা। ঢলে পড়া দুপুরে যখন সবাই ভাতঘুমে ব্যস্ত, আমি তখন কবিতা লিখতে গিয়ে নিজের কাছে নিজেই প্রতিজ্ঞা করেছিলাম—আর যা–ই করি, প্রথমে সায়েন্সের কোনো একটা বিষয়ে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে আবার বাংলায় গ্র্যাজুয়েশন করব। তারপর একটু বড় হয়ে যখন জানতে পারলাম, সৈয়দ আলী আহসান ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করে অধ্যাপনা করে গেছেন বাংলা সাহিত্যে; তখন আমার সেই বাংলা পড়ার ইচ্ছা একেবারে ফিকে হয়ে গেল। সেদিন আমার একাডেমিক বাংলা পড়ার ইচ্ছা উবে গেলেও জন্ম নিয়েছিল আরেকটা নতুন ইচ্ছা—দ্বিতীয় আলী আহসান হওয়ার ইচ্ছা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে সম্ভবত সৈয়দ আলী আহসানই একমাত্র ব্যক্তি, যিনি গ্র্যাজুয়েশন করেছেন এক বিষয়ে আর শিক্ষকতা করেছেন অন্য বিষয়ে। সেটা আবার রাষ্ট্রবিজ্ঞান পড়ে ইতিহাস কিংবা ইতিহাস পড়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান নয়। ইংরেজি সাহিত্যে মাস্টার্স করে পড়িয়েছেন বাংলা সাহিত্য। শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই নয়, অধ্যাপনা করেছেন করাচি বিশ্ববিদ্যালয় এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগেও। করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্বও পালন করেছেন। বিষয়টা কতটুকু গুরুত্বপূর্ণ কিংবা অস্বাভাবিক, সে বিষয়ে তুলনামূলক আলোচনা করলে হয়তো আরেকটা নিবন্ধ হয়ে যাবে। আমি শুধু আমার সেই রঙিন স্বপ্নময় দুরন্ত কৈশোরের কথা বলছি। যে কৈশোরের রঙিন স্বপ্নগুলো সেই রঙিন দিনগুলোতেই সুন্দর। আমার সেই ইচ্ছাও সেই কৈশোরেই ছিল প্রাণবন্ত, উচ্ছল। কিন্তু যখন গোঁফের রেখা আরেকটু গাঢ় হয়ে এল, চোয়ালের দুই পাশে আরেকটা দাগ টেনে দিল সদ্য উঁকি দেওয়া শ্মশ্রু, তখন আরেকটু বুঝতে শিখলাম। বুঝলাম, সবাই আলী আহসান হয় না। কেউ কেউ হয়। কিন্তু আমি কখনো আমার স্বপ্নকে কবর দিই না। থামিয়ে দিই না স্বপ্নের পথে চলা। হতে পারে ধীর পদক্ষেপে। তবু পথ চলি একটু একটু করে।

দুই.
দাখিল (এসএসসি) পরীক্ষা দেওয়ার পর হঠাৎ এনথ্রোপলজি পড়ার ইচ্ছা হলো। সেই ইচ্ছা আবার চাঙা হয়ে উঠেছিল যখন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে এনথ্রোপলজিতে ভর্তির ডাক পেয়েছিলাম। এর মধ্যে আবার কখন কীভাবে যেন ইতিহাসের প্রতি অনুরক্ত হয়ে গেলাম। তবে ইতিহাস পড়তে গিয়ে সব সময় একটা বিষয় মনে হয়েছে যে ইতিহাস আমার আরও পরে শুরু করা উচিত। কেন এ কথা মনে হয়েছে, তার উত্তর এখনো পাইনি। আর তাই হয়তো আজ অবধি উল্লেখযোগ্য কোনো ইতিহাস পড়া হয়ে ওঠেনি।

তিন.
সম্প্রতি পড়েছি বুলবুল সরওয়ারের কিশোর ভ্রমণকাহিনী ‘মমির দেশ মিশর’। বুলবুল সরওয়ারের ঝরঝরে গদ্যে মিসরের বর্ণনা পড়ে এখন ইজিপ্টোলজি পড়ার ইচ্ছা হচ্ছে। ইজিপ্টোলজির প্রতি অনুরক্ত হওয়ার পর মনে পড়ল, একসময় আমার আর্কিওলজি নিয়েও আগ্রহ ছিল প্রচুর।

চার.
এই লেখা লিখতে গিয়ে খেয়াল করেছি, এখন পর্যন্ত আমার যতগুলো বিষয়ে পড়ার আগ্রহ জেগেছে, তার সবগুলোই মানুষ নিয়ে, মানুষের ইতিহাস নিয়ে। সাহিত্য, এনথ্রোপলজি, আর্কিওলজি—এসব তো মানুষের কথা, মানুষের ইতিহাস। আল্লাহ তাআলা মানুষকে কী অসীম ক্ষমতা দিয়ে সৃষ্টি করেছেন! আশ্চর্যরকমের অভিযোজন ক্ষমতা দিয়েছেন মানুষকে। দিয়েছেন রহস্যময় এক মস্তিষ্ক। এই মস্তিষ্কে যে কত বিচিত্র রসায়ন লুকায়িত আছে, তা ইতিহাস আর প্রত্নতত্ত্ব পড়লে কিছুটা অনুমান করা যায়। কিন্তু সবচেয়ে বেশি অবাক হতে হয় হয়তো ইজিপ্টোলজি পড়তে গিয়েই। যে আমরা এখন নিজেদেরকে আধুনিক, অত্যাধুনিক, স্মার্ট বলে পরিচয় দিয়ে গর্ববোধ করি—অথচ এই আমরাই ইজিপ্টোলজির শত–সহস্র অনাবিষ্কৃত রহস্যের ধারেকাছে যেতে পারিনি।

পাঠাগার ও পাঠচক্র সম্পাদক, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধুসভা