আকরামের ‘ঘাসফুল’ যেন জীবনজারিত কবিতা

‘ঘাসফুল’ চলচ্চিত্রের একটি দৃশ্যছবি: সংগৃহীত

শিউলি ফুলকে শেফালি ফুলও বলা হয়। তৌকিরের প্রেমিকা ভোরের জানালায় শিউলি ফুল নিয়ে আসে। ঘুমভাঙা ভোরের আলো চোখে নিয়ে তৌকির জানালা দিয়ে দেখে অন্য এক আলো। সেই আলোর হাত থেকে দুহাত পেতে নেয় শিউলি ফুল। যৌবনের লুকোচুরি খেলা। দুষ্টু মিষ্টি প্রেম। মায়ের ডাক শুনে তৌকির আবার শুয়ে পড়ে। প্রেমিকা পালিয়ে যায়। অন্য একদিন আবার তৌকির সেই প্রেমিকা নার্গিসের অন্য একটা নাম দেয় ‘ঘাসফুল’।

আকরাম খান কবিতা লেখেন। সিনেমা বানান। ফেসবুকে আকরামের অনেক কবিতা পড়েছি। পড়তে পড়তে চোখের সামনে দৃশ্যের পর দৃশ্য ভেসে ওঠে। আর ২০১৫ সালে প্রথম মুক্তি পাওয়া চলচ্চিত্র দেখতে গিয়ে দেখলাম, ক্যামেরার চোখ দিয়েও তিনি সুন্দর কবিতা লিখে যান। ‘শব্দের পায়রা’ কবিতায় যেমন লেখেন, ‘কি দেব তোমাকে বলো আর!/ আমার শব্দগুলো তোমার উদ্দেশ্যে/ পায়রা হয়ে উড়ে যাক/ ভাঙা হৃদয়ের অনুচ্চারিত ধ্বনি/ তোমার পাঠোদ্ধারে পাবে অবয়ব।/ একে তুমি কবিতা বলতে পারো/ কাব্যের মর্যাদা যদি না দাও/ তোমার জানালায়, কার্নিশে বসা/ পায়রাগুলো উড়িয়ে দিও।’ নৈঃশব্দ্যের পায়রাগুলোকে ক্যামেরার চোখ দিয়ে বকবকম বকবকম যেন উড়িয়ে দিতে পারেন, উড়িয়ে দিতে এসেছেন আকরাম।

হাসান আজিজুল হকের রচনা নিয়ে একের পর এক টেলিফিল্ম, চলচ্চিত্র নির্মাণ করে চলেছেন আকরাম খান। সেই চলচ্চিত্রগুলোও নৈঃশব্দ্য জারিত। মানুষ, জীবন, সমাজ, রাষ্ট্র, পরিবারের অন্তর্নিহিত শূন্যতাকে বিরাট এক পরিমণ্ডলে তুলে এনে বাঙ্‌ময়, পূর্ণ করে তোলার চেষ্টা করে চলেছেন। ঘাসফুলের কাহিনি অবশ্য কবি পরিচালক আকরামের নিজের। সংলাপ চিত্রনাট্য লিখেছেন মশিউল আলম, লায়লা আফরোজ এবং আকরাম নিজেই।

এই চলচ্চিত্রে আমরা দেখি রবাহুত তৌকির প্রকৃতির সান্নিধ্যে শব্দের সন্ধানে ঘুরে বেড়ায়। কিন্তু সে স্মৃতিভ্রষ্ট। এক জীবনের মধ্যে তার অনেকগুলো জীবন। মনে করতে চায়, কিন্তু বারবার ব্যর্থ হয়। কিছুতেই মনে করতে পারে না পূর্বজন্মের কথা। ‘রাতের জানালা’ কবিতায় আকরাম যেমন লেখেন ‘ঘাট থেকে ভাটায়, বিন্দু থেকে উধাও হওয়ার/ স্মৃতি আছে হয়ে উষ্ণ দীর্ঘশ্বাস/ রাতে ঝরা পাতা উড়ে, বিজলি চমকায়/ বাতাসে ভেসে আসে কামিনীর সুবাস।/ যে চিন্তা উদাস করে রাখে সর্বক্ষণ/ অবজ্ঞায় দূরে ঠেলে তুমি ভালো আছো তো/ হে উজ্জ্বল প্রাক্তন?’ হ্যাঁ, এই পূর্বজন্মের ঠিকানায় একজন উজ্জ্বল প্রাক্তন আছে। যার চিন্তা এখনো তৌকিরকে উদাস, বিভোর করে রাখে সর্বক্ষণ। কিন্তু হায়! স্মৃতি যেন বড় প্রতারক! অবজ্ঞায় দূরে ঠেলে রাখে। নিজের ভেতরে তৌকির ফালা ফালা হয়ে যায়।

নিজের ঘরে সে এমনভাবে আসে যেন বাইরের কোনো লোক। বন্ধুর বাড়িতে গিয়ে কড়া নাড়ে। কিন্তু সে বাড়িতে আদৌ তার কোনো বন্ধু নেই। যাকে সে বন্ধু ভাবে, কখনোই তার বন্ধুই ছিল না। দাবার বোর্ড ঘুঁটি নিয়ে মনে করতে পারে না, কখনো দাবা খেলত কি না? হারমোনিকায় ফুঁ দিয়ে আজ আর সুর ওঠে না। অ্যালবামে পুরোনো দিনের ছবি, কিন্তু মনে পড়ে না, কবে কোথায় তোলা। ডাক্তারের কাছে যায়। নিয়মিত ওষুধ খায়। সে এখন স্মৃতিভ্রষ্ট রোগী।

কিন্তু মনের ভেতরে তার এখনো একটা আস্ত প্রকৃতি বিরাজমান। প্রেম জগৎ প্রকৃতি জীবনের সূক্ষ্ম অনুভূতি এখনো নিয়ত মনের ভেতরে কড়া নাড়ে। শিরা–উপশিরায় পাঁক খায়। যদিও আড়ষ্ট কিন্তু ইচ্ছা জাগে আস্বাদনের। আকরামের ‘ইচ্ছা’ কবিতার ভাষায় ‘অরণ্যে একটা গৃহ চাই/ প্রখর রোদে ছায়া দেবে, ঝড়-বৃষ্টিতে আশ্রয়/ অবাধ থাকবে প্রবেশ/ যখন–তখন স্বাধীনতা বাহিরে যাওয়ার অনায়াস।/ তবে দরজা থাকবে না/ কিন্তু জানালা থাকতেই হবে/ তাতে শিক থাকবে না কোনো।/ ঘুম ভাঙবে পাখিদের কলকাকলিতে/ নির্মল শিশুরা স্বতঃস্ফূর্ত খেলবে/ থাকবে না অহংকারী মরমরের মেঝে যা/ ময়লা করে ফেলার সম্ভাবনায় থাকে আড়ষ্ট।’

তৌকিরের বাবা জলে ডুবে মারা যায়। ঘাসফুলের গর্ভে তখন তৌকির। ঘাসফুল মানে নার্গিস নিজের পরিবার ছেড়ে তৌকিরদের বাড়িতে চলে আসে। তৌকিরের বাবা নার্গিসের ভবিষ্যতের কথা ভেবে বাধা দিলেও মা একেবারে নাছোড়বান্দা। কিছুতেই নার্গিসকে ছেড়ে দেবে না। হারানো প্রেমিকের ব্যথা বুকে নিয়ে নার্গিসও একদিন সন্তানের জন্ম দেবে।

তৌকিরের জীবনটাকেও আড়ষ্ট হয়ে থাকতে দেবে না আকরাম। কাহিনি এগোবে, মনের দরজাও খুলবে। একদিন জিনস প্যান্টের পকেটে খুঁজে পাবে ধূসর পাণ্ডুলিপির মতো ঘাসফুলের লেখা বিবর্ণ চিঠি। ঘাসফুল একদিন কারও প্রেমে পড়ে অনন্ত ইচ্ছার বাঁধনছাড়া মুহূর্তে গর্ভে ধারণ করেছিল প্রেম। গর্ভে ধারণ করেছিল কবিতা। কবিতার খাতা মেলে তাকে সেই প্রেমের পরিপূর্ণতা এনে দিয়েছিল তৌকির।

হয়তো অপরাধ ছিল সেটা। আকরামের ‘অপরাধের দোসর’ কবিতার ভাষায় আমরা যেমন পড়ি ‘তুমি আমার পাপের সাক্ষী/ প্রাণপ্রিয় আমার তুমি অপরাধের দোসর/ কাঙ্ক্ষিত দোজখের দরজা ধুতরা ফুল ধূলি ধূসর/ রূপালী আগুনের তুমি আঁচ/ জলসাগরের ঝাড়বাতি রঙিন আতশ কাচ/ তুমি এক নম্বরি ঘোড়া, লাল রুমাল উড়ানো/ আমি শিস দেয়া জকি/ তুমি সুরা তুমি সাকি তুমিই জীবনের বাদবাকি/ পেয়েছি ইয়ার দোস্তদের ভালো হয়ে যাবার উপদেশ/ পাতাল নগরে স্বেচ্ছা নির্বাসন ওখানেই জীবন/ আবর্জনা জমা পূঁতিগন্ধ তলদেশ/ সামাজিক নাগরিকেরা সভ্য ভব্য স্বাভাবিক/ দ্রব্য গুণে বেসামাল আমি অস্বাভাবিক/ আবারও যদি বেছে নিতে হয় স্বর্গ কিংবা নরক/ ধরব প্রিয়তমা সর্বনাশা গন্তব্যের তোমারই সড়ক!’ সেদিন যে ছিল ভরা বাদলের দিন। সেদিন যে ছিল বজ্র আগুনে জল কে ছলকে তোলার দিন। সেদিন যে কাকভেজা লাবণ্য, স্নিগ্ধস্নাত আগুন নিয়ে প্রেমিকা এসেছিল ঘরে। দ্রব্য গুণে বেসামাল অস্বাভাবিক হওয়াটাই যে স্বাভাবিক।

কিন্তু আজকের তৌকিরের কাছে এখনো যে সব ধাঁধা। কে এই ঘাসফুল? বন্ধুর কাছে গিয়ে জানতে চায়, কখনো প্রেমিকা ছিল কি না? বন্ধু তানিয়া জানায়, তার অন্য প্রেমিক আছে। সূত্র মেলাতে গিয়েও কিছুতেই মেলে না। হতাশায় গ্লানিতে অনুসন্ধানী মন আরও বিমর্ষ হয়ে পড়ে। জটিল থেকে আরও জটিলতর হয়ে পড়ে কাহিনির মোড়। ক্রমে খোলসা হবে এবার। এত দিন বাবা-মা যে গল্পগুলো এড়িয়ে যেত, এবার একদিন কলেজ থেকে ফিরে তৌকিরের হাতে পুরোনো চিঠি পেয়ে বলে যেতে থাকবে সব। তৌকির আসলে তৌকিরের বাবা। ঘাসফুল তৌকিরের মা। এত দিন যারা তাকে পুত্রস্নেহে মানুষ করে এসেছে, তৌকির যাদের বাবা-মা বলে জানে, তারা হলো দাদু আর দিদা।

তৌকিরের বাবা জলে ডুবে মারা যায়। ঘাসফুলের গর্ভে তখন তৌকির। ঘাসফুল মানে নার্গিস নিজের পরিবার ছেড়ে তৌকিরদের বাড়িতে চলে আসে। তৌকিরের বাবা নার্গিসের ভবিষ্যতের কথা ভেবে বাধা দিলেও মা একেবারে নাছোড়বান্দা। কিছুতেই নার্গিসকে ছেড়ে দেবে না। হারানো প্রেমিকের ব্যথা বুকে নিয়ে নার্গিসও একদিন সন্তানের জন্ম দেবে।

এরপর আবার পড়াশোনা শুরু করবে। ডাক্তারি পড়তে চলে যাবে। মাঝেমধ্যে সন্তানকে দেখতে আসবে। তার এক প্রেমিক হবে। দুজনে বিয়ে করবে। সন্তানকে ফিরিয়ে নিতে এলে তৌকিরের মা কিছুতেই ছেড়ে দেবে না। জোর করে নিতে চাইলে আত্মহত্যা করবে জানায়। নার্গিস কাঁদতে কাঁদতে ফিরে যাবে। আজকের তৌকির দাদু-দিদাকে বাবা-মা জেনে বড় হতে থাকবে।

সবকিছু জানার পর তৌকিরের ইচ্ছা হয় মাকে একবার দেখার। অবশ্য বৃদ্ধ দাদু-দিদাকে ফেলে একেবারে সে কখনোই মায়ের কাছে চলে যাবে না। দাদু বাবার লেখা ডায়েরি তৌকিরের হাতে তুলে দেবে। সেই ডায়েরি সঙ্গে নিয়ে তৌকির বন্ধুর সঙ্গে ট্রেনে চাপবে। যাত্রাপথে পড়তে পড়তে যাবে। চোখের সামনে খুলে যাবে বর্ণময় দুটি জীবনের নীল দিগন্ত।

ওরা প্রেমে পড়েছিল। ওরা ভালোবেসেছিল। ওরা পরস্পরের ঠোঁটে দিগন্ত রাঙিয়ে চুমু এঁকেছিল। আর আজকের তৌকিরের যাত্রায় আকরাম খানের ‘শেষ চুম্বন’ কবিতার শেষের কয়েকটা লাইন যেন অনিবার্য সত্য হয়ে ওঠে, ‘অভিজ্ঞতা থেকে উপলব্ধ অমোঘ সত্য-/ কোনো কিছুই থেমে থাকে না,/ ট্রেন কোনো স্টেশনেই দাঁড়ায় না বেশিক্ষণ।/ তাহলে ভালোবাসা জানাতে দ্বিধা কিসের,/ বিদায় সম্ভাষণের পর ছুড়ে দিতে শেষ চুম্বন!’ চোখে না দেখা হারানো বাবাকে সে তো আর কখনো ফিরে পাবে না। মায়ের নতুন সংসারে গিয়ে থাকার ইচ্ছাও তার নেই। নিজের মধ্যে বাবা এখন বিরাজ করে। নিজের মধ্যে তার বাবার সত্তা। নিজের মধ্যে তার বাবার স্মৃতি। নিজের মধ্যে তার বাবার ভবিষ্যৎ। কারও জন্য জীবন থেমে থাকেনি। জীবন নামের এই ট্রেন কোনো স্টেশনেই দাঁড়ায় না বেশিক্ষণ। মায়ের কাছে গিয়ে একবার ভালোবাসা জানাতে তবে দ্বিধা কিসের?

আকরামের বিচিত্র কবিতাময় জীবন। জীবনময় চলচ্চিত্র। কবিতার সূত্র, জীবনের সূত্র কাহিনির পরতে পরতে এসে চলচ্চিত্রে মিলে যায়। সূত্র থেকে উঠে আসে সত্য। জীবনের বাঁক যেদিকেই যাক, ক্ষণিকের টুকরো টুকরো মুহূর্তই মহাকাল। এভাবেই কাঁটার ওপরে গোলাপের ফুটে ওঠার উদ্‌যাপন।

এই চলচ্চিত্রের দৃশ্য গ্রহণ, দৃশ্য বুনন চমৎকার। তৌকির চরিত্রে কাজী আসিফ রহমান, নার্গিস চরিত্রে শায়লা সাবি, তৌকিরের বাবা-মা নায়লা আজাদ নূপুর, মানস বন্দ্যোপাধ্যায় এবং অন্য সবার অভিনয় অনবদ্য। প্রিয়াঙ্কা গোপের গানটিও ভালো লাগে।

সৃষ্টিশীল মানুষের জীবন মাত্রই পাগলের জীবন। এই পাগলামো উচ্চমাত্রায়, উচ্চমার্গে পৌঁছে কখনো কখনো মানসিক অসুখের আকার নেয়। সেই অসুখ থেকে ভালোবাসার বন্ধনে সেরে ওঠার ওষুধও থাকে এই মানুষগুলোর হাতে। এই চলচ্চিত্রের সংলাপ রচয়িতার অংশীদার লায়লা আফরোজ রীতার কাছে বিশেষভাবে কৃতজ্ঞ থাকার প্রয়োজন তাই আমাদেরও। এমন একজন পাগলের সঙ্গে তিনি ঘর করেন। কবি পরিচালক আকরামের ঘরনি তিনি। নিজেও আবার চিকিৎসক। মানসিক অসুখ থেকে সেরে ওঠার গল্প বলে ঘাসফুল।

হাওড়া, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত