বিতর্ক
তারুণ্য ও বিতর্ক
লেখাটি ২০২৪ সালের জুনে প্রকাশিত বন্ধুসভা জাতীয় পরিচালনা পর্ষদের ‘তারুণ্য’ ম্যাগাজিনের দশম সংখ্যা থেকে নেওয়া।
বাংলাদেশ সৃষ্টি হয়েছে একটি গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষা থেকে। গণতন্ত্র প্রসঙ্গে নোবেল বিজয়ী অমর্ত্য সেন বলেছেন, ‘গণতন্ত্র কতটা উৎকর্ষ লাভ করল, সেই বিতর্কে না গিয়েও এর বিকাশের প্রতি নজর দেওয়া জরুরি।...গণতন্ত্রে আলোচনা ছাড়া কিছু সম্ভব নয়।’ ‘স্বাধীনতা তুমি’ কবিতায় কবি শামসুর রাহমান লিখেছেন, ‘স্বাধীনতা তুমি বটের ছায়ায় তরুণ মেধাবী শিক্ষার্থীর শাণিত কথার ঝলসানি-লাগা সতেজ ভাষণ।’
স্বাধীনতা আর গণতন্ত্র—এই দুয়ের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। গণতন্ত্র মানুষের ব্যক্তিস্বাধীনতা স্বীকার করতে বাধ্য থাকে। আর গণতন্ত্রের জন্য ভিন্নমত, তথা কথা বলার বা মুক্তভাবে মতপ্রকাশের অধিকার অপরিহার্য। শামসুর রাহমান যেভাবে স্বাধীনতাকে দেখেছেন শিক্ষার্থীর সতেজ ভাষণ হিসেবে, একইভাবে সব বর্ণ, ধর্ম, পেশা ও নানা বয়সের মানুষের বক্তব্য রাখার, মতপ্রকাশ করার বা যুক্তি তুলে ধরার অধিকারও স্বাধীনতার অবিচ্ছেদ্য অংশ। এই অধিকারগুলো স্বীকার করেই এগিয়ে চলে গণতন্ত্র।
এ দেশের সাহসী ও সৃষ্টিশীল তরুণদের হাত ধরেই প্রায় শত বছর আগে যাত্রা শুরু করেছিল বিতর্ক। বিতর্ক এক বিশেষ ধরনের তর্ক, যেখানে নিয়ম করে সব বক্তার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করা হয়। কেউ গায়ের জোরে বেশি বলার সুযোগ পান না। যতই অযৌক্তিক হোক, ভিন্নমতকে মনোযোগ দিয়ে শুনতে হয় এবং বুদ্ধিমত্তা দিয়ে পাল্টা যুক্তি দিতে হয়। যুক্তির পৃষ্ঠে কেবল যুক্তি দিয়েই এই খেলা।
খেলা নিয়ে রয়েছে আরেক বিতর্ক। ‘বিতর্ক’ নিয়ে বিতর্ক। বিতর্ক হচ্ছে প্রতিযোগিতামূলক শিল্প; অর্থাৎ এটা একই সঙ্গে ক্রীড়া বা বুদ্ধিদীপ্ত খেলা এবং একধরনের বাচিকশিল্প। এখানে কণ্ঠের প্রয়োগ থেকে শুরু করে অভিনয় বা দৈহিক ভাষার দারুণ প্রয়োগ বিদ্যা কাজে লাগাতে হয়।
বুদ্ধিদীপ্ত প্রতিযোগিতামূলক এই শিল্পের চর্চা তরুণদের মধ্যে দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মের প্রায় পাঁচ দশক আগে এই ভূখণ্ডে প্রথম আনুষ্ঠানিক বিতর্কচর্চার ইতিহাস সূচিত হয়েছিল। এই ইতিহাসের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম দশকের ইতিহাস।
২.
একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশ্বমানের জ্ঞানচর্চা নিশ্চিত করতে গেলে যুক্তির চর্চাকে কোনোভাবেই বাদ রাখা যায় না। আরও শক্ত করে বলতে গেলে, ভুল-ঠিকের তর্ক থেকেই নতুন আবিষ্কার, নতুন চিন্তার উন্মেষ ঘটে। এই ভুল-ঠিকের তর্কাতর্কিতে যুক্তিবোধ বাটখারার ভূমিকা পালন করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম দশক থেকেই শিক্ষার্থীদের মধ্যে যুক্তির চর্চা শুরু হয় বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। ‘জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, বুদ্ধি যেখানে আড়ষ্ট, মুক্তি সেখানে অসম্ভব’ স্লোগানবাহী শিখা পত্রিকা কালের সাক্ষী হয়ে আছে ইতিহাসের পাতায়। শিখা পত্রিকার এই আলোক ছড়ানোর কালেই একদল শিক্ষার্থী সাহিত্যের নানা বিষয় নিয়ে আনুষ্ঠানিক বিতর্কচর্চা শুরু করেছিলেন।
আল মামুন ক্লাব ছিল দেশের প্রথম ডিবেটিং ক্লাব। এই ক্লাবে সাহিত্যকেন্দ্রিক বিষয় নিয়ে বিতর্ক ও বক্তৃতার আয়োজন করা হতো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন মুসলিম হল ইউনিয়নের বার্ষিক প্রতিবেদনে (১৯২৬-২৭) বিতর্কচর্চায় ক্লাবটির সাফল্যের প্রশংসা রয়েছে। জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্প-সাহিত্যের অনুরাগী ইসলামের ইতিহাসের প্রগতিশীল খলিফা আল মামুনের নামে এই ক্লাবের নামকরণ করা হয়েছিল। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম পর্যন্ত আল মামুন ক্লাবের প্রশংসা করেছিলেন।
পঞ্চাশের দশকে বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রতিনিধিত্ব করে দেশের বাইরে পর্যন্ত বিতর্ক করতে যাওয়ার ইতিহাস পাওয়া যায়। কোনো এক অজানা কারণে শিখা গোষ্ঠীর মতো আল মামুন ক্লাবেরও আলো নিভে যায়। এরই মধ্যে ১৯৫৩ সালে ফাদার আর ডব্লিউ টিমের নেতৃত্বে ঢাকার নটর ডেম কলেজে নটর ডেম ডিবেটিং ক্লাব প্রতিষ্ঠিত হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক বিতর্ক সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে।
৩.
ঝগড়াতে যুক্তি মুখ্য নয়। সেখানে থাকে জোর। বিতর্কে জোর নয়, যুক্তির জয় হয়। বি-তর্ক মানে বিশেষ তর্ক। এই তর্ক সতর্কতার সঙ্গে করতে হয়। গোঁড়ামি, কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাসের বিরুদ্ধে কথা বলতে হয়। কথা বলতে হয় কাউকে আঘাত না করে, সম্মান বজায় রেখে বিনয় ও বিচক্ষণতার সঙ্গে। ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর মতে, ‘বিতর্ক হচ্ছে একটি দ্বন্দ্বমূলক শিল্পকলা, যেখানে সুন্দরভাবে বিদ্যা ও বুদ্ধির সংযোগ ঘটে।’
বিরূপাক্ষ পাল তাঁর বিতর্ক ভুবন বইয়ে বিতর্ককে উল্লেখ করেছেন একটি ‘উদ্বুদ্ধকরণ শিল্প বা আর্ট অব মোটিভেশন’ হিসেবে। তিনি মনে করেন, উদ্বুদ্ধকরণের শর্ত ছাড়া বক্তৃতা অনেকটা পাগলের কূটতর্কে পরিণত হয়। তাই বিতর্ক হচ্ছে মন জাগানোর মন্ত্র, মন গলানোর কলা। মানুষকে শুভ কাজে টেনে আনার সবচেয়ে বেশি ক্ষমতা ভালো কথার। তাই বিতর্ক হচ্ছে ভালোভাবে কথা বলার বিদ্যা।
বিতর্কশাস্ত্রের জনক বিবেচনা করা হয় ডেমস্থেনিসকে। তিনি যখন বক্তৃতা করতেন, তখন মানুষ এতটাই উদ্বুদ্ধ হতেন যে তাঁরা বলতেন, ‘চলো, এখনই এগিয়ে যাই’; অর্থাৎ ডেমস্থেনিস যেদিকে আহ্বান করতেন, লোকে সেদিকে ভীষণমাত্রায় উদ্বুদ্ধ হতেন। তাই বলা যায়, নিজের চিন্তাকে প্রকাশ ও মানুষের কাছে সেটিকে গ্রহণযোগ্য মাত্রা দিতে বক্তৃতা বা বিতর্ক অত্যন্ত চমৎকার একটি মাধ্যম।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে নির্বাচনী বিতর্ক তারই নজির। মার্কিন মুলুকে আব্রাহাম লিংকনের গেটিসবার্গ বক্তৃতা, মার্টিন লুথার কিংয়ের ‘আই হ্যাভ আ ড্রিম’ কিংবা আমাদের দেশে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের মধ্যে এক অসম্ভব সম্মোহনী শক্তি নিহিত রয়েছে। বিশ্বের লাখো কোটি জনতা আজও উদ্বুদ্ধ হন এই বক্তৃতাগুলো শুনলে। একজন বিতার্কিক চর্চার মাধ্যমে এই জাদুকরি গুণ রপ্ত করতে পারেন, নিজেকে জগদ্বিখ্যাত করে তুলতে পারেন তাঁর পছন্দের কর্মক্ষেত্রে।
বিতর্কের সবচেয়ে বড় গুণ নিজেকে প্রকাশ করা শেখা। চাণক্যের একটি কথা রয়েছে, ‘গ্রন্থগত বিদ্যা আর পরহস্তে ধন, নহে বিদ্যা নহে ধন হলে প্রয়োজন’; অর্থাৎ সময়মতো উপযুক্ত জ্ঞান বা তথ্য যদি প্রকাশ করা না যায়, তবে সে জ্ঞান কোনো উপকারে আসে না। বিতর্কচর্চা একজন শিক্ষার্থীর জ্ঞান ও সুপ্ত প্রতিভাকে প্রকাশ করে। মুখস্থবিদ্যার বাইরে এনে প্রত্যুৎপন্নমতি করে তোলে। বিতর্কচর্চা নানা বিষয় ও সমস্যা সম্পর্কে শিক্ষার্থীকে ভাবতে ও বিশ্লেষণ করতে শেখায়। ধরা যাক, বাল্যবিবাহ নিয়ে একজন শিক্ষার্থী তার পাঠ্যবইয়ে পড়েছে। ঠিক এ বিষয়েই যদি ওই শিক্ষার্থীকে বিতর্ক করতে বলা হয়, ‘আইনের প্রয়োগই পারে বাল্যবিবাহ ঠেকাতে’। এই শিক্ষার্থী তখন তার পুঁথিগত বিদ্যা, তার সমাজবাস্তবতা ও নিজস্ব চিন্তার প্রয়োগ ঘটিয়ে বিষয়টির পক্ষে বা বিপক্ষে বক্তব্য তুলে ধরবে। এর মধ্য দিয়ে জীবনের যে স্তরেই বাল্যবিবাহ নিয়ে লিখতে বসুক না কেন, সে অন্যদের চেয়ে এগিয়ে থাকবে।
নোবেল বিজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন বলেছেন, ‘সহজভাবে কোনো কিছু তুলে ধরার জন্য গভীরভাবে জানতে হয়।’ তাই একজন বিতার্কিককে তাঁর অবস্থানের পক্ষের যুক্তি ও তথ্য সংগ্রহ করার জন্য বই-পত্রিকা পড়তে হয়। সেগুলোকে নিজের ভাষায় লিখতে হয়, নিজের চিন্তা, বিশ্লেষণ সুন্দরভাবে উপস্থাপন করতে হয় এবং প্রতিপক্ষের যুক্তি খণ্ডন করার জন্য তাঁদের কথাগুলো মনোযোগসহকারে শুনতে হয়। ফলে ভালো বক্তা হওয়ার জন্য ভালো পাঠক ও শ্রোতা হওয়াটাও প্রয়োজন।
অন্যের মতকে সহ্য করার মানসিকতা, যাকে আমরা বলি পরমতসহিষ্ণুতা এবং সময়ানুবর্তিতা শেখায় বিতর্ক। অনেক সময়ই দেখা যায়, বিভিন্ন সভা-সমাবেশ বা অনুষ্ঠানে বক্তব্য দিতে গিয়ে বক্তা ১০ মিনিটের বক্তৃতায় ৫-৬ মিনিট কাটিয়ে দেন কে কে উপস্থিত আছেন তাঁদের নাম ও বিশেষণ বলতে গিয়ে। আবার ‘আমি খুব ভালো বক্তা নই’, এমন কথা বলে বক্তব্য শুরু করা মানুষটির সমস্যা এটি নয় যে তিনি ভালো বক্তা নন। তাঁর বড় সমস্যা, ভালো বক্তা না হয়েও তিনি অধিক সময় ধরে বক্তব্য দিয়ে অনুষ্ঠানে উপস্থিত দর্শকদের বিরক্তিভাব বৃদ্ধি করেন। বিতর্কচর্চার মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীরা নির্ধারিত স্বল্প সময়ের মধ্যে কীভাবে দর্শকদের ধৈর্যচ্যুতি না ঘটিয়ে গুরুত্বপূর্ণ সব কথা বলে দেওয়া যায়, সেই কৌশল রপ্ত করতে পারেন।
বিতর্ক একজন অন্তর্মুখী শিক্ষার্থীকে বহির্মুখী (ইন্ট্রোভার্ট টু এক্সট্রোভার্ট) করে তোলে। বিতর্ক করতে গিয়ে নানা স্থানে নানা মানুষের সঙ্গে পরিচয় ঘটে, আলাপ হয়। এর মধ্য দিয়ে সম্পর্ক ও পরিচিতি গড়ে ওঠে। এভাবে তৈরি হওয়া যোগাযোগদক্ষতা পরবর্তী জীবনের নানা ক্ষেত্রে কাজে লাগে। তাই বিতর্ক একটি শিল্প, একটি আন্দোলন। বিতর্কের মধ্য দিয়ে একজন মানুষ শৈল্পিকভাবে তাঁর মনের ভাব যেমন প্রকাশ করতে পারেন, তেমনি সামাজিক নানা অসংগতির বিরুদ্ধে যৌক্তিকভাবে নিজের মতপ্রকাশের আন্দোলনে যুক্ত হতে পারেন, নেতৃত্ব দিতে পারেন।
বিতর্কবিষয়ক সম্পাদক (২০২৩), বন্ধুসভা জাতীয় পরিচালনা পর্ষদ