প্রতিভা দুই ধরনের হয়। একটা সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত, আরেকটা শৃঙ্খলা, সাধনা ও কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে নিজের ভেতর তৈরি করে নিতে হয়। কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে নিজেকে তৈরি করার সবচেয়ে বড় উদাহরণের কথা বললে, সবার আগে নাম আসবে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর। সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত প্রতিভারও যত্ন নিতে হয়। তখন ওই প্রতিভা সেরাদের সেরা হয়ে ওঠে। যার জ্বলন্ত উদাহরণ লিওনেল মেসি। আর প্রতিভার যত্ন না নিলে অকালে ঝরে যাওয়ার প্রবল সম্ভাবনা থাকে।
এমনই এক প্রতিভার নাম ছিল আদ্রিয়ানো লেইটে রিবেরিও। আদ্রিয়ানো নামেই বেশি পরিচিত। যাঁকে ব্রাজিল ফুটবল দলে রোনালদো নাজারিও, রোনালদিনহো, রিভালদোদের মতো তারকাদের যোগ্য উত্তরসূরি ভাবা হচ্ছিল। ক্যারিয়ারের শুরুটাও হয়েছিল সেভাবেই। ইন্টার মিলানে যোগ দেওয়ার পর সমর্থকেরা তাঁকে ‘শাসক’ উপাধিতেও ভূষিত করেছিলেন। বিভিন্ন কারণে সেই আদ্রিয়ানো পরবর্তী সময়ে বড় আক্ষেপে পরিণত হন। ক্যারিয়ারও খুব একটা লম্বা করতে পারেননি। ডালপালা মেলার আগেই ভেঙে পড়েন।
৬ ফুট ২ ইঞ্চি উচ্চতার রিও ডি জেনেইরোর এই ফুটবলার ছিলেন শক্তিশালী, দ্রুতগতির এবং টেকনিক্যালি দুর্দান্ত। তাঁর বাঁ পায়ের শটে প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়েরাও মুগ্ধ হতেন। ২০২০ সালে স্পোর্টস বাইবেলকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে আদ্রিয়ানোর এক সময়কার সতীর্থ ও প্রতিপক্ষ জ্লাতান ইব্রাহিমোভিচ তাঁর সম্পর্কে বলেন, ‘সে (আদ্রিয়ানো) যেকোনো অ্যাঙ্গেল থেকে শট নিতে পারত। তাকে কেউ ট্যাকল করতে পারত না। কেউ তার কাছ থেকে বল নিতে পারত না। সে ছিল সত্যিকারের অ্যানিমেল (প্রশংসাবোধক অর্থে)। আমি তার সঙ্গে খেলা উপভোগ করেছি।’ সতীর্থকে নিয়ে আক্ষেপ করতেও ভোলেননি সুইডিশ কিংবদন্তি। জ্লাতান ইব্রাহিমোভিচ বলেন, ‘এটা দুঃখজনক যে মাত্র অল্প কিছু সময় ছিল তাঁর ক্যারিয়ারের সেরা অধ্যায়। আপনি যা কিছুই করেন না কেন, তার ৫০ শতাংশ হলো মানসিক দিক। যদি আপনার মাথায় এটা না থাকে, তাহলে তা কঠিন।’
ক্যারিয়ারের সেরা সময়
ইন্টার মিলানের হয়ে ১৭৭ ম্যাচে ৭৪ গোল করেন আদ্রিয়ানো। ব্রাজিলের জার্সিতে গোল আছে আরও ২৭টি। তবে কেবল এই সংখ্যা দিয়ে তাঁর ক্যারিয়ার মূল্যায়ন করা যাবে না। তাঁর যে কত বড় প্রতিভা ছিল, তার একটা উদাহরণ দেওয়া যাক।
ব্রাজিল জাতীয় দল তখন তারকায় ভরপুর। ২০০২ বিশ্বকাপজয়ী দল। তখনো দলটির নিয়মিত সদস্য হতে পারেননি আদ্রিয়ানো। এর মধ্যে ২০০৪ কোপা আমেরিকার জন্য দল ঘোষণা করেন তৎকালীন কোচ কার্লোস আলবার্তো পেরেইরা। সেই দলে রোনালদিনহো, কাফু, রবার্তো কার্লোস ও রোনালদোর মতো তারকাকে বিশ্রাম দেওয়া হয়। সম্পূর্ণ তরুণ একটি দল সাজান পেরেইরা। সুযোগ মেলে আদ্রিয়ানোর। মূলত এর আগের ছয় মাসে ইন্টার মিলানের হয়ে তাঁর দুর্দান্ত ফর্মই দলে জায়গা পেতে সহজ করে দেয়। সুযোগটিও দারুণভাবে লুফে নেন এই ফরোয়ার্ড। ব্রাজিলকে শিরোপা জেতানোর পাশাপাশি সর্বাধিক গোল করে গোল্ডেন বুট এবং গোল্ডেন বল জিতে নেন আদ্রিয়ানো। আর্জেন্টিনার বিপক্ষে ফাইনাল খেলা শেষে আনন্দাশ্রু মিশ্রিত কণ্ঠে আদ্রিয়ানো বলেন, ‘এই মুহূর্তে আমি কেমন অনুভব করছি, তা ঠিক ব্যাখ্যা করার মতো নয়। এটি অবশ্যই আমার ক্যারিয়ারের সেরা মুহূর্ত। এই শিরোপা আমি আমার বাবাকে উৎসর্গ করছি। তিনি আমার জীবনের সেরা বন্ধু, সতীর্থ। তাঁকে ছাড়া আমি কিছুই না।’
আদ্রিয়ানো ভুল বলেননি। আসলেই বাবা তাঁর জীবনের সবকিছু। ১৯৮২ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি ব্রাজিলের রিও ডি জেনেইরোতে এক দরিদ্র পরিবারে জন্ম আদ্রিয়ানোর। বাল্যকাল কেটেছে এমন পরিবেশে, যেখানে খুন, নেশা, সহিংসতা ও দুর্নীতির মতো অপরাধ ছিল অহরহ। তবে তা তাঁকে ভাঙতে পারেনি। বাবার অনুপ্রেরণায় পেশাদার ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন দেখেন। রাস্তাঘাট ও ময়লা মাঠে অনুশীলন করতেন। মাত্র সাত বছর বয়সে বিখ্যাত ক্লাব ফ্ল্যামেঙ্গো একাডেমিতে ভর্তি হন। পরবর্তী আট বছর কঠোর পরিশ্রম করেন এবং বিশ্বাস করতেন একদিন পেশাদার ফুটবলার হবেন। প্লেয়ার্স ট্রিবিউনকে আদ্রিয়ানো বলেন, ‘আমার পায়ে সব সময় একটি বল থাকত। এটি ছিল সৃষ্টিকর্তার দেওয়া।’
নতুন রোনালদো নাজারিও
মাত্র ১৬ বছর বয়সে ফ্ল্যামেঙ্গো মূল দলে সুযোগ পেয়ে যান। ক্লাবটির হয়ে খেলার সময় ২০০০ সালে মাত্র ১৮ বছর বয়সে ব্রাজিল জাতীয় দলের হয়ে অভিষেক ঘটে। এর পরের বছর ২০০১ সালে ইতালিয়ান জয়ান্ট ইন্টার মিলানের নজরে পড়েন তিনি। মিলানের হয়ে প্রথম ম্যাচেই রোনালদোর ভক্ত হিসেবে নজর কাড়েন আদ্রিয়ানো। সান্তিয়াগো বার্নাবোতে প্রাক্ মৌসুম প্রীতি ম্যাচে রিয়াল মাদ্রিদের বিপক্ষে বক্সের বাইরে থেকে দারুণ এক ফ্রি-কিক করে নিজের জাত চেনান। এত দ্রুতগতির (রেকর্ড ১০৫ কিমি) শট ছিল যে তা প্রতিহত করার কোনো সুযোগই পাননি রিয়াল গোলকিপার ইকার ক্যাসিয়াস। দলও জেতে ২-১ ব্যবধানে। ম্যাচে তাঁর পারফরম্যান্স নিয়ে তখনকার ইন্টার মিলান অধিনায়ক জাভিয়ের জেনেটি বলেছিলেন, ‘আমি নিজেকে বলছিলাম; সে নতুন রোনালদো।’
তবে সময় বদলাতে বেশি সময় লাগেনি। রোনালদো নাজারিওর সঙ্গে তুলনার কারণে হোক কিংবা ইউরোপের বড় ক্লাবের খেলার স্বপ্ন; এত অল্প বয়সে ইন্টার মিলানে খেলার চাপ নিতে পারেননি আদ্রিয়ানো। এক মৌসুম পরেই তাঁকে ইতালির আরেক ক্লাব পার্মাতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সেখানে দুই মৌসুমে পার্মার হয়ে ৩৭ সিরি-এ ম্যাচে ২৩ গোল করেন। মিলান কর্তৃপক্ষ বুঝতে পারে তারা হয়তো ভুল করেছে রত্নকে যেতে দিয়ে। তাই ব্রাজিলিয়ান তরুণ তুর্কিকে ২০০৪ সালের জানুয়ারিতে চার বছরের চুক্তিতে আবারও দলে ভেড়ায় ইন্টার মিলান।
সত্যিকারের তারকা হয়ে ওঠা
এরপর আর পেছনে ফিরে তাঁকাতে হয়নি। প্রথম ১৬ ম্যাচেই ৯ গোল করে ইন্টার মিলানকে বোঝালেন, তারা এত দিন কী মিস করছিল। সব ধরনের প্রতিযোগিতা মিলে ওই মৌসুমে মোট ২৮ গোল করেন তিনি। কোপা ইতালিয়াও জয় করেন এবং নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেন ইউরোপের অন্যতম সেরা স্ট্রাইকার হিসেবে। ওই সময়ই সমর্থকেরা তাঁকে ‘মিলানের শাসক’ উপাধিতে ভূষিত করেন। আদ্রিয়ানো এতটাই ভয়ংকর ছিলেন যে সে সময় বিপক্ষ ক্লাব ইমপলির ডিফেন্ডার এমিলসন ক্রিবারি ২০২২ সালে ইএসপিএনকে বলেন, ‘তাঁর সেরা সময়ে, রোনালদো নাজারিও এবং তিনি একসঙ্গে মাঠে থাকলে তাঁদের থামানো কঠিন ছিল।’
জীবন বদলে যাওয়া
তবে বেশি দিন শীর্ষে থাকতে পারেননি। ২০০৪ সালে কোপা আমেরিকা জয়ের পর যখন মিলানে ফিরে আসেন, তখন একটি সংবাদ পান, যা তাঁর জীবন পুরোপরি পরিবর্তন করে দেয়। ২০০৪ সালের ৩ আগস্ট মোবাইলের মাধ্যমে আদ্রিয়ানো জানতে পারেন, তাঁর বাবা মাত্র ৪৪ বছর বয়সে হার্ট অ্যাটাক করে মারা গেছেন। ঠিক ওই মুহূর্তটায় তিনি তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা হারিয়ে ফেলেন। পরে এক সংবাদমাধ্যমকে জাভিয়ের জেনেটি বলেন, ‘যখন সে (আদ্রিয়ানো) তার বাবার মৃত্যুর সংবাদ ফোনকলে শুনছিল, আমরা রুমেই ছিলাম। মুহূর্ত পরই সে মোবাইল ফেলে দিল এবং চিৎকার করে কান্না শুরু করল। ওই ফোনকলের পর কোনো কিছুই আর আগের মতো ছিল না।’
এরপরও কিছুদিন গোল করার ধারা অব্যাহত থাকলেও গতি ঠিক আগের মতো ছিল না। প্রতিটি গোলের পর আকাশের দিকে তাঁকিয়ে বাবাকে স্মরণ করতেন। প্লেয়ার্স ট্রিবিউনকে আদ্রিয়ানো বলেন, ‘ফুটবলের প্রতি আমার ভালোবাসা আর আগের মতো ছিল না। আমি সমুদ্রের এপার ইতালিতে ছিলাম, পরিবার থেকে অনেক দূরে এবং ঠিক মানিয়ে নিতে পারছিলাম না। অনেক হতাশ হয়ে পড়ি। প্রচুর মদ্যপান করতে থাকি। আমি সত্যিই অনুশীলন করতে চাচ্ছিলাম না। ইন্টারের সঙ্গে আমার কিছুই করার ছিল না। আমি কেবল বাড়ি যেতে চেয়েছিলাম।’
অনিয়ন্ত্রিত জীবন
অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনের প্রভাব ধীরে ধীরে তাঁর ক্যারিয়ারের ওপর পড়তে থাকে। শরীরে মেদ বাড়ে, বারবার ইনজুরিতে পড়তে থাকেন। একটা সময় ইন্টার মিলানের মূল স্কোয়াডে অনিয়মিত হয়ে পড়েন। এর মধ্যে ২০০৫ সালের কনফেডারেশনস কাপে ৫ গোল করে ব্রাজিলের শিরোপা জয়ে বড় অবদান রাখেন এবং গোল্ডেন বুট ও গোল্ডেন বল পান। তবে পতন শুরু হয় ২০০৬ বিশ্বকাপ থেকে। পুরো টুর্নামেন্টে মাত্র দুটি গোল করতে সক্ষম হন আদ্রিয়ানো। ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন ও হট ফেবারিট হয়েও ব্রাজিল বিদায় নেয় কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে। বিশ্বকাপের পরই জাতীয় দল থেকে বাদ পড়ে যান। ইন্টার মিলানের সঙ্গে ২০১০ সাল পর্যন্ত চুক্তি ছিল। তাঁর পারফরম্যান্স এতটাই খারাপ ছিল যে ২০০৮ সালে তাঁকে ব্রাজিলের ক্লাব সাও পাওলোতে ধারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সেখানে গিয়েও জীবনে শৃঙ্খলা আনতে পারেননি। শেষ পর্যন্ত বিরক্ত হয়ে এক মৌসুম পরেই আদ্রিয়ানোকে আবারও মিলানে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তখন তাঁকে ফ্রি এজেন্ট করে দেয় ইতালিয়ান ক্লাবটি।
এরপর ব্রাজিলিয়ান ক্লাব ফ্ল্যামেঙ্গোতে যোগ দেন। সেখানে ভালো পারফরম্যান্সের সুবাদে ইতালিয়ান ক্লাব রোমা তিন বছরের চুক্তিতে তাঁকে দলে ভেড়ায়। মনে হচ্ছিল ক্যারিয়ার হয়তো আবার আগের অবস্থায় ফিরে আসবে। কিন্তু ইতালিতে যাওয়ার পর আবারও অনিয়ন্ত্রিত জীবন শুরু করেন তিনি। ফলে কয়েক মাস পরেই চুক্তি বাতিল করতে বাধ্য হয় রোমা। এরপর আরও তিনটি ক্লাবে নাম লেখান। কোথাও থিতু হতে পারেননি। হয়তো চেষ্টাই করেননি। ২০১৬ সালে মাত্র ৩৪ বছর বয়সে পেশাদার ফুটবলকে বিদায় বলে দেন তিনি।