কেন বার্সায় এক মৌসুমের বেশি খেলতে পারেননি ইব্রাহিমোভিচ

জ্লাতান ইব্রাহিমোভিচ ও পেপ গার্দিওয়ালাছবি: সংগৃহীত

ফুটবল খেলায় সাফল্যের অনেকটা নির্ভর করে একজন কোচের ওপর। দল নির্বাচন থেকে শুরু করে ম্যাচের ছক পরিকল্পনা, সাইডলাইনে দাঁড়িয়ে খেলোয়াড়দের নির্দেশনা দেওয়া—সবকিছুর নিয়ন্ত্রণ কোচ করে থাকেন। তাই নেতৃত্ব ও টেকনিক্যাল দিক দিয়ে যে কোচ যত বেশি দক্ষ, তাঁর দলের সাফল্যের হার তত বেশি। পাশাপাশি প্রত্যেক ফুটবলারকে তাঁদের মেধা অনুযায়ী কাজে লাগাতে পারাও বড় দক্ষতা। কখনো কখনো কিছু ফুটবলারকে পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজে লাগানো সম্ভব হয়ে ওঠে না। যার অন্যতম বড় উদাহরণ ২০০৯-১০ মৌসুমে বার্সেলোনার হয়ে খেলা জ্লাতান ইব্রাহিমোভিচ। মাত্র এক মৌসুম খেলেই ক্লাবটি থেকে চলে যেতে বাধ্য হন তিনি।

ওই সময় বার্সেলোনার কোচ ছিলেন পেপ গার্দিওয়ালা। ফুটবলের ইতিহাসে অন্যতম সেরা কোচ তিনি। আগের মৌসুমেই বার্সাকে ট্রেবল শিরোপা এনে দেন। অন্যদিকে ওই সময় বিশ্বের অন্যতম সেরা স্ট্রাইকার জ্লাতান ইব্রাহিমোভিচ। আগের মৌসুমেই ইন্টার মিলানের হয়ে ৩৫টি সিরি’আ ম্যাচে ২৫ গোল করেন। এমন একজন স্ট্রাইকারকে দলে ভেড়ানোয় সবাই ভেবেছিলেন, বার্সা আরও ভয়ংকর রূপে প্রতিপক্ষের ত্রাস হয়ে দাঁড়াবে; কিন্তু দেখা গেল, মাত্র এক মৌসুম শেষেই সুইডিশ তারকাকে ছেড়ে দেয় কাতালান ক্লাবটি, যা আজও ফুটবলের ইতিহাসে আলোচিত ঘটনার একটি হয়ে আছে।

জ্লাতান ইব্রাহিমোভিচ এমন সময় স্পেনে পাড়ি জমান, যখন কাতালান ক্লাবটি সাফল্যের চূড়ায় অবস্থান করছিল।

২০০৮-০৯ মৌসুমে বার্সেলোনা ট্রেবল শিরোপা জয় করে। রিয়াল মাদ্রিদকে ৯ পয়েন্টের ব্যবধানে পেছনে ফেলে লা লিগা জয়, আতলেটিকো ক্লাবকে হারিয়ে কোপা দেল রে শিরোপা এবং রোমে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতে ট্রেবল নিশ্চিত করে পেপ গার্দিওয়ালার বাহিনী। মৌসুমজুড়ে অসাধারণ পারফরম্যান্স প্রদর্শন করেন লিওনেল মেসি। ট্রেবল জেতার পর নতুন চ্যালেঞ্জ নিতে ক্যাম্প ন্যু ছেড়ে ইন্টার মিলানে পাড়ি জমান সামুয়েল ইতু। বিনিময়ে বার্সার কাছে ৪৫ মিলিয়ন ইউরো মূল্যে ইব্রাহিমোভিচকে বিক্রি করে দেয় হোসে মরিনহোর ইন্টার মিলান।

জ্লাতান ইব্রাহিমোভিচ এমন সময় স্পেনে পাড়ি জমান, যখন কাতালান ক্লাবটি সাফল্যের চূড়ায় অবস্থান করছিল। পরের মৌসুমে তারা প্রায় অপরাজিত থেকে আবারও লা লিগা জয় করে। কেবল আতলেটিকো মাদ্রিদের বিপক্ষে এক ম্যাচ হেরেছিল। কোপা দেল রেতে সেভিলার কাছে ফাইনালে হেরে রানার্সআপ হয় এবং চ্যাম্পিয়নস লিগে ইন্টার মিলানের কাছে পরাজিত হয়ে সেমিফাইনাল থেকে বিদায় নেয়।

কাতালান ক্লাবটিতে নামের প্রতি সুবিচার করতে পারেননি ইব্রাহিমোভিচ। লা লিগার অন্তত পাঁচ ম্যাচে দলের খেলোয়াড় তালিকায় ছিল না তাঁর নাম এবং দুই ম্যাচে বেঞ্চে থাকতে হয়েছে। বিষয়টি মেনে নিতে পারেননি সুইডিশ কিংবদন্তি।

জ্লাতান ইব্রাহিমোভিচ ও পেপ গার্দিওয়ালা
ছবি: সংগৃহীত

পুরো মৌসুমে গোল করা এবং করানো মিলিয়ে মোট ৩৪ গোলে অবদান ছিল তাঁর। তবু গার্দিওয়ালার খেলার ধরনের (তিকিতাকা) সঙ্গে পুরোপুরি খাপ খাওয়াতে পারেননি তিনি। যেটা বেশ ভালোভাবে করতে পারতেন লিওনেল মেসি, আন্দ্রেস ইনিয়েস্তা, জাভি হার্নান্দেজসহ বার্সেলোনার বাকি সব খেলোয়াড়।

পরবর্তী সময়ে জ্লাতান ইব্রাহিমোভিচ দাবি করেছেন, বার্সেলোনায় খেলা মৌসুমটি ছিল তাঁর ক্যারিয়ারের সবচেয়ে ‘খারাপ স্মৃতি’, যার শেষ হয় চ্যাম্পিয়নস লিগের সেমিফাইনালে বার্সার বিদায় নেওয়ার মাধ্যমে। ওই ম্যাচের প্রথম লেগে নিজেদের মাঠে ৩-১ গোলের বড় ব্যবধানে জয় পায় ইন্টার মিলান। ক্যাম্প ন্যুতে দ্বিতীয় লেগে ১-০ গোলে হারলেও ফাইনালে জায়গা করে নিতে বেগ পেতে হয়নি হোসে মরিনহোর দলকে। পরে তারা শিরোপাও জিতে নেয়। দুই লেগেই জ্লাতানকে পুরো সময় খেলাননি পেপ গার্দিওয়ালা।

ম্যাচ শেষে কী হয়েছিল, সেই ঘটনা স্মরণ করে নিজের আত্মজীবনীতে ইব্রাহিমোভিচ লেখেন, ‘গার্দিওয়ালা আমার দিকে তাকিয়ে ছিল এবং আমি মেজাজ হারিয়ে ফেলি। আমি ভেবেছিলাম, আমার শত্রু দাঁড়িয়ে আছে এবং সে তার টাকমাথা আঁচড়াচ্ছে! আমি পুরো পাগল হয়ে গিয়েছিলাম। অনুশীলনের কিটের একটি বাক্স আমি রুমে ছুড়ে মারি। এটি ফ্লোরে পড়ে ভেঙে যায়। কিন্তু পেপ কিছু বলেনি। কেবল কিটগুলো আবার বক্সে ভরে রাখে। আমি হিংস্র নই; কিন্তু আমি যদি গার্দিওয়ালার জায়গায় থাকতাম, তাহলে মারামারি করতাম।’

বার্সার খেলোয়াড়েরা স্কুলশিক্ষার্থীদের মতো; কোচকে অন্ধভাবে মেনে চলে। অন্যদিকে আমি বারবার প্রশ্ন করতাম।

আত্মজীবনীতে সুইডিশ ফরোয়ার্ড আরও উল্লেখ করেন, ‘বার্সার খেলোয়াড় সবাই গার্দিওয়ালাকে অন্ধভাবে অনুসরণ করে। আমি রুমে গেলে সে চলে যেত। সে দলের বাকিদের হ্যালো বলত, কিন্তু আমাকে উপেক্ষা করত। মানিয়ে নেওয়ার অনেক চেষ্টা করেছি। বার্সার খেলোয়াড়েরা স্কুলশিক্ষার্থীদের মতো; কোচকে অন্ধভাবে মেনে চলে। অন্যদিকে আমি বারবার প্রশ্ন করতাম। যারা নিয়মের মধ্যে থাকে, তাদের আমি পছন্দ করি না। আমি চেষ্টা করেছি ভালো থাকতে এবং মেজাজ না হারাতে। কিন্তু ওই দিনের পর চেষ্টা করা বন্ধ করে দিই। যেমন বার্সেলোনায় খেলোয়াড়দের নিজেদের স্পোর্টস গাড়িতে করে অনুশীলনে আসা নিষিদ্ধ। আমার কাছে এটা হাস্যকর মনে হয়েছে। আমি কোন গাড়ি ব্যবহার করব, এটা অবশ্যই কোনো ক্লাবের সিদ্ধান্ত হতে পারে না। তাই এপ্রিলের দিকে আলমেরিয়ার বিপক্ষে ম্যাচের আগে আমার ফেরারি গাড়ি নিয়ে অনুশীলনে যাই এবং এটা নিয়ে কথা ওঠে।’

বার্সেলোনা ছেড়ে আসার পেছনে জ্লাতান ইব্রাহিমোভিচ তাঁর বইয়ে বারবার গার্দিওয়ালাকে দায়ী করেছেন। দলে মূল স্ট্রাইকার ইব্রাহিমোভিচ থাকলেও কোচ সিদ্ধান্ত নেন, মেসিকে প্রধান স্ট্রাইকার হিসেবে খেলানোর। কোচের ভরসার প্রতিদানও দেন আর্জেন্টাইন সুপারস্টার। ওই মৌসুমে সব ধরনের প্রতিযোগিতা মিলিয়ে ৫৩ ম্যাচে ৪৭ গোল করেন তিনি। মৌসুম শেষে আবারও ইতালিতে ফিরে যান জ্লাতান। যোগ দেন এসি মিলানে।

জ্লাতান ইব্রাহিমোভিচ সম্পর্কে কোনো খারাপ মন্তব্য করেননি পেপ গার্দিওয়ালা। ২০১০ সালে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘জ্লাতানকে কোচিং করানো আমার জন্য সম্মানের ছিল। তার কাছ থেকে অনেক কিছু শিখেছি। সে আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় ছিল। সে আমাদের অনেক সাহায্য করেছে এবং তার প্রথম ছয় মাস দারুণ ছিল। আমি আবারও বলছি, তার সঙ্গে আমার কোনো সমস্যা নেই।’