২৩০ বছরের পুরোনো আজগর আলী চৌধুরী জামে মসজিদ

চট্টগ্রামের আজগর আলী চৌধুরী জামে মসজিদছবি: লেখক

আজ থেকে বহু বছর আগের কথা। অথই জলরাশির বিশাল সমুদ্রের পার ঘেঁষে গড়ে উঠেছে একটি ক্ষুদ্র জনপদ। সামুদ্রিক যাত্রাবিরতির জন্য জায়গাটি বেশ সুবিধাজনক। প্রায়ই বিভিন্ন দেশের ধনবান ব্যবসায়ীদের আনাগোনা হয় এখানে। সমুদ্রের পার্শ্ববর্তী এই জনপদের পাশেই বিশাল ভূখণ্ড, যা ছিল ভালো মানের ধান উৎপাদনের অঞ্চল। এখানেই সূক্ষ্ম সুতিবস্ত্র মসলিন তৈরি হতো। সুগন্ধি মসলাসহ বিভিন্ন ধরনের নামীদামি পণ্যের জন্য বিখ্যাত ছিল এ এলাকা। ব্যবসার জন্য ছুটে আসতেন দেশি-বিদেশি মানুষেরা।
বলছি বন্দরনগরী চট্টগ্রামের কথা। আজও যা বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর। শুধু তা–ই নয়, ঐতিহাসিক এ বন্দর এখনো ঠিক আগের মতোই ব্যস্ত। প্রতিদিনই এখানে আসে বহু দেশের পণ্যবাহী জাহাজ, আবার ছেড়েও যায়।

ঐতিহাসিক বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, হিজরি প্রথম শতকেই ভারতীয় উপমহাদেশ তথা মালাবারে ইসলামের আগমন ঘটে। পরবর্তী সময়ে খ্রিষ্টীয় অষ্টম শতাব্দীতে ভারতবর্ষে ইসলামি শাসন শুরু হয় মুহাম্মদ বিন কাসিমের সিন্ধু জয়ের মাধ্যমে। আরব্য ব্যবসায়ীদের যাতায়াতের ফলে চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর সুপ্রসিদ্ধ হয়ে ওঠে। বাগদাদ, বসরাসহ বিভিন্ন অঞ্চলের আরব বণিকেরা এ এলাকায় প্রায়ই সফর করতেন। বণিক ছাড়াও বহু সুফি–দরবেশ আসেন অঞ্চলটিতে। এখানে বসতি স্থাপন করেন তাঁদের অনেকেই। চট্টগ্রামে আগত পীর, আউলিয়া, ফকির-দরবেশদের মধ্যে হজরত বদর শাহ (রহ.), হজরত বায়েজিদ বোস্তামি (রহ.), হজরত শাহ মোহছেন আউলিয়া (রহ.), হজরত মোল্লা মিছকিন শাহ (রহ.), হজরত শেখ ফরিদ (রহ.), হজরত শাহ গরিব উল্লাহ শাহ (রহ.), হজরত বদনা শাহ (রহ.), প্রকাশ শফি শাহ (রহ.), হজরত আনার উল্লাহ শাহজি (রহ.), হজরত শাহ চান্দ আউলিয়া (রহ.), হজরত শাহ আমানত (রহ.) উল্লেখযোগ্য। এই পীর, বুজুর্গ ও ধর্মপ্রচারক মনীষীদের অক্লান্ত পরিশ্রমের বদৌলতে ইসলামের সুমহান বাণী ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। বাড়তে থাকে মুসলমানদের সংখ্যা। গড়ে ওঠে অসংখ্য মসজিদ, মাদ্রাসা ও বিশাল বিশাল স্থাপনা।

বারো আউলিয়ার পুণ্যভূমিখ্যাত চট্টগ্রামে এমন অনেক প্রত্নতাত্ত্বিক স্মৃতিচিহ্ন রয়েছে, যেগুলোর বয়স ২০০ থেকে ৭০০ বছরের বেশি। যদিও অযত্নে–অবহেলায় পুরোনো ঐতিহ্যের এসব স্মারক হারিয়ে যাওয়ার পথে। মোগল আমলের তৈরি এমনই এক মসজিদ হচ্ছে উত্তর হালিশহরের চৌধুরীপাড়ায় আজগর আলী চৌধুরী জামে মসজিদ। চট্টগ্রামের বাণিজ্যিক এলাকা আগ্রাবাদ থেকে সোজা পশ্চিমে তিন কিলোমিটার গেলেই হালিশহরের বড়পোল এলাকা। সেখান থেকে আরও প্রায় পাঁচ কিলোমিটার পশ্চিম-উত্তরে এগোলেই হালিশহরের চৌধুরীপাড়া। ১৭৯৫ সালে এখানেই নির্মাণ করা হয় সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম নকশায় চুনসুরকির দৃষ্টিনন্দন আজগর আলী চৌধুরী জামে মসজিদটি। মসজিদটি নির্মাণ করেন হালিশহরের সম্ভ্রান্ত চৌধুরী পরিবারের প্রয়াত আজগর আলী চৌধুরী।

আজগর আলী চৌধুরী জামে মসজিদ
ছবি: লেখক

ভারতের তাজমহলের আদলে নির্মিত আজগর আলী মসজিদটির সামনেই রয়েছে পুকুর, পাশেই কবরস্থান। এ ছাড়া মসজিদের ছাদে শোভা পেয়েছে বড় তিনটি গম্বুজ ও বেশ কয়েকটি মিনার। মসজিদের দেয়ালে পোড়ামাটির বিভিন্ন কারুকাজে নির্মিত নানা রকম নকশা, যা দর্শনার্থীদের নজর কাড়ে। মসজিদটির স্থাপত্যরীতি, নকশা, রং—সব মিলিয়ে এর অন্য রকম এক নান্দনিক সৌন্দর্য মন কাড়ে সবার। দেশ-বিদেশের অসংখ্য মানুষ ছুটে আসেন হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্যের এই মহান নিদর্শন দেখতে, যা আজও ইসলামি শাসনব্যবস্থার উৎকর্ষ ও মুসলিমদের সূক্ষ্ম রুচির উজ্জ্বল নিদর্শন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে স্বমহিমায়।

বর্তমানে আজগর আলী চৌধুরীর উত্তরসূরিরাই মসজিদটির দেখাশোনা করছেন। তবে মসজিদটিতে এখন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় বন্ধ রয়েছে। ঐতিহ্য ধরে রাখতে মসজিদ ভবনটি অক্ষুণ্ন রেখে পাশে গড়ে তোলা হয়েছে নতুন একটি মসজিদ। সেখানে মুসল্লিরা নামাজ আদায় করে থাকেন।

হাটহাজারী, চট্টগ্রাম