প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে অদ্যাবধি তামাম দুনিয়ায় যত পরিবর্তন এসেছে, সব কটিতেই যুবসমাজের অবদান উল্লেখযোগ্য। বিশ্বের বহু অর্জন, আত্মত্যাগ, সংগ্রাম, দুর্যোগ প্রতিরোধ ও সভ্যতা বিনির্মাণের নেপথ্যে রয়েছে যুবসমাজের প্রত্যক্ষ ভূমিকা। ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সী প্রায় ১ দশমিক ২ বিলিয়ন তরুণ, যা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ১৬ শতাংশ, তাঁরা বৈষম্যহীন সমাজ গঠনে আগামীর বিশ্বকে নেতৃত্ব দেবে। বৈশ্বিক শান্তি প্রতিষ্ঠা, ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব, সামাজিক অগ্রগতি ও অংশগ্রহণমূলক উন্নয়ন নিশ্চিতের জন্য ক্রমবর্ধমান এ যুবসমাজকে কর্মোদক্ষ করে গড়ে তোলা ভীষণ জরুরি। এরই পরিপ্রেক্ষিতে দক্ষ যুবসমাজের প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করে ইউনেসকোর মাধ্যমে ১৫ জুলাই জাতিসংঘ যুব দক্ষতা দিবস হিসেবে উদ্যাপন করে আসছে। এবারের দশম বিশ্ব যুব দক্ষতা দিবসের প্রতিপাদ্য ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও ডিজিটাল দক্ষতার মাধ্যমে যুবদের ক্ষমতায়ন’, যা প্রকৃতপক্ষে সময়োপযোগী ও বাস্তবসম্মত হয়েছে।
এ ছাড়া বিজ্ঞানের সর্বশেষ সংযোজন হিসেবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে কাজে লাগিয়ে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে পরিবেশবান্ধব নতুন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ পশমন, অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন, লিঙ্গবৈষম্য দূরীকরণ, কার্বন নিঃসরণ ও জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলার জন্য দক্ষ ও প্রশিক্ষিত যুবসমাজের বিকল্প নেই। বিশ্বায়নের এই যুগে আকাশ সংস্কৃতি, সাইবার অপরাধ, পর্নোগ্রাফি ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অত্যধিক ব্যবহার কমাতে এবং বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশের তরুণদের প্রশিক্ষিত জনশক্তিতে রূপান্তরের জন্য সময়োপযোগী ও বাস্তবায়নযোগ্য একটি মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করা যেতে পারে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ দেশি ও আন্তর্জাতিকভাবে নিম্নোক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে:
১. আগামী দিনের কর্ণধার হিসেবে যুবকদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য সরকারের পক্ষ থেকে পূর্ণাঙ্গ একটি প্যাকেজ থাকা উচিত, যেখানে তরুণদের শিক্ষা গ্রহণ থেকে শুরু করে চাকরির সুযোগ, সামাজিকতা, দেশপ্রেম, নৈতিকতা, বিনোদনের সুযোগ, মানবতা, সাংস্কৃতিক ও মনস্তাত্ত্বিক সচেতনতা ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত থাকবে। উল্লেখ্য, যুবকদের দক্ষতা বলতে শুধু কারিগরি বা প্রযুক্তিগত দক্ষতাই বোঝায় না, বরং শৃঙ্খলাবোধ, আত্মনির্ভরশীলতা, সাহসিকতা, যোগাযোগ সক্ষমতা, কৌতূহল, সৃজনশীলতা, সততা, দায়িত্ববোধ, অভিযোজন ক্ষমতাসহ সব কটি গুণের সমাবেশকে বোঝাবে। প্রকৃতপক্ষে শিক্ষার সঙ্গে দক্ষতার একটি নিবিড় সংযোগ রয়েছে বলেই দক্ষ তারুণ্যের ভিত্তিমূল প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার স্তর, যেখান থেকে একজন যুবকের শারীরিক ও মানসিক দক্ষতার একটি কাঠামো নির্ধারিত হয়। সুতরাং প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষাব্যবস্থা পর্যন্ত যুব দক্ষতার বিষয়টি ভাবনায় রেখে একটি যুব দক্ষতা বৃদ্ধির কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা উচিত।
২. যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় কর্তৃক বাস্তবায়িত বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় ‘ইকোনমিক এক্সিলারেশন অ্যান্ড রেজিলিয়েন্স ফর নিট (ইএআরএন)’ প্রকল্পটি অধিকতর বাস্তবসম্মত ও কর্মসংস্থানবান্ধব প্রশিক্ষণ অব্যাহত রাখার পাশাপাশি তরুণদের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, মেশিন লার্নিং, ডিপ লার্নিং, রোবোটিকস, বায়োটেকনোলজি, ন্যানোটেকনোলজি, কোয়ান্টাম কম্পিউটিং, পারমাণবিক শক্তি ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি, চতুর্থ প্রজন্মের কম্পিউটারে ভাষার ব্যবহার, প্রায়োগিক শিক্ষার ওপর অঞ্চলভিত্তিক নিবিড় কারিগরি ও বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ প্রদান করতে হবে। যেহেতু কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আমাদের বিশ্বকে এক নতুন রূপ দিচ্ছে, তাই ‘এজেন্ডা-২০৩০’–এর মাধ্যমে জাতিসংঘ যুবসমাজকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও ভার্চ্যুয়াল রিয়েলিটি ব্যবহারের জন্য প্রশিক্ষণের ওপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করছে। সুতরাং আমাদের দেশের তরুণদের ভার্চ্যুয়াল রিয়েলিটি ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহারের জন্য জরুরি ভিত্তিতে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে সরকারকে দ্রুত উদ্যোগ নিতে হবে; নইলে পার্শবর্তী ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার যুবকেরা আমাদের চেয়ে এগিয়ে যাবে।
৩. তরুণদের সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের পাঠ্যক্রমে সমন্বিত কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করতে হবে। বৈশ্বিক চাহিদা বিবেচনায় এমন একটি শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়ন করা উচিত, যেখানে উচ্চমাধ্যমিক বা স্নাতক শেষ করেই যেন শিক্ষার্থীরা চাকরি বাজারে প্রবেশের সুযোগ পায়। চীন, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার মতো দেশগুলোতে কর্মসংস্থানের সঙ্গে বা ভবিষ্যৎ চাকরির সম্ভাবনা মাথায় রেখে কয়েক বছর পরপর শিখনপ্রক্রিয়া আধুনিকায়ন করতে পাঠ্যক্রমে পরিবর্তন আনা হয়। সুতরাং আগামী দিনের কর্মসংস্থানের ধরন বিবেচনায় রেখে উন্নত দেশের মতো আমাদের পাঠ্যক্রম ও শিখনপদ্ধতিতে পরিবর্তন আনতে হবে। তা ছাড়া কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার ব্যবহারিক পাঠদান কর্মসূচি হাতে–কলমে শেখানোর জন্য প্রতিটি স্কুল-কলেজে আধুনিক ল্যাবরেটরি স্থাপন করতে হবে। কারণ, এই পর্যায়ের শিক্ষার্থীরাই কয়েক বছর পর চাকরির বাজারে প্রবেশ করবে। পাশাপাশি স্নাতক সমাপ্তের আগে নিজ নিজ বিষয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ছয় মাসের ইন্টার্ন বাধ্যতামূলক করতে হবে।
৪. উন্নত দেশগুলোতে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের মাতৃভাষা ও ইংরেজি ভাষার পাশাপাশি অন্য একটি ভাষা শেখা বাধ্যতামূলকভাবে শিখতে হয়। এ ছাড়া পৃথিবীর যেকোনো দেশে বাইলিঙ্গুয়াল বা মাল্টিলিঙ্গুয়াল ব্যক্তিদের কর্মসংস্থানের সুযোগ প্রসারিত থাকে। সুতরাং দেশে ও বিদেশে সম্মানজনক ও উচ্চ বেতনের কর্মসংস্থানের জন্য আমাদের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের পাঠ্যক্রমে বাংলার পাশাপাশি কমপক্ষে দুটি ভাষা শেখার সুযোগ রাখতে স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি সমন্বিত একটি পরিকল্পনা গ্রহণ এখন সময়ের দাবি। এ ক্ষেত্রে বিভিন্ন ভাষার শিক্ষক নিয়োগ, অত্যাধুনিক ল্যাব স্থাপনের বিষয়টি দীর্ঘমেয়াদি হওয়ায় ২০৩০ সালের মধ্যে সম্পন্ন করার উদ্যোগ নিতে হবে। অন্যথায় আমরা বিশ্বের শ্রমবাজারে কোনোভাবেই টিকে থাকতে পারব না। এ ছাড়া কায়িক শ্রমঘনিষ্ঠ কাজের চেয়ে বুদ্ধিবৃত্তিক পেশায় মনোযোগ দিতে সরকারকে উদ্যোগী হতে হবে। ভবিষ্যৎ বিশ্বের শ্রমবাজার যাচাই করে তরুণদের ইংরেজি, চায়নিজ, জাপানিজ, কোরিয়ান, থাই, ফ্রেঞ্চ, জার্মান, আরবি, রুশ, আফ্রিকান সোয়াহিলি, হিন্দি ভাষা শেখানোর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
৫. অনেক দিন পরে হলেও জাতিসংঘ স্পষ্টই আগামী দিনের রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে যুবকদের প্রশিক্ষিত করার বিষয়ে উদ্যোগ নিয়েছে। তবে শুধু দিবস উদ্যাপনেই সীমাবদ্ধ না থেকে জাতিসংঘ ও অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগী প্রতিষ্ঠানকে ১ দশমিক ২ বিলিয়ন তরুণদের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও ভার্চ্যুয়াল রিয়েলিটি ব্যবহারের সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে বিভিন্ন ট্রেডে প্রশিক্ষিত করে কর্মক্ষম করে তুলতে উদ্যোগী হতে হবে। এ বিষয়ে জাতিসংঘ ও তার অঙ্গসংগঠনগুলো অনুন্নত ও স্বল্পোন্নত রাষ্ট্রগুলোর যুবকদের জন্য আলাদা টেকনিক্যাল ও বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র চালু করতে পারে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহারে পিছিয়ে পড়া দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকার দেশগুলো তরুণ ও বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়া অভিবাসীদের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও ভার্চ্যুয়াল রিয়েলিটিবিষয়ক প্রশিক্ষণ প্রদানসহ সহজ শর্তে বিভিন্ন স্কলারশিপের সুযোগ করে দেওয়া জরুরি হয়ে পড়েছে। তবে এসব বিষয় বাস্তবায়নের জন্য ‘গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ডের’ মতো ‘যুব স্কিলস ফান্ড’ গঠন করতে উদ্যোগী হওয়ার জন্য স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে জাতিসংঘের ওপর চাপ অব্যাহত রাখতে হবে।
৬. বিশ্বের প্রায় ১২ দশমিক ৮ শতাংশ বেকার যুবকদের প্রশিক্ষিত করে কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দিতে না পারলে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা বেশ কঠিন হবে। তা ছাড়া টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার মানসম্মত শিক্ষা, লিঙ্গসমতা, শালীন কাজ ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, অসমতা দূরীকরণ, জলবায়ু কার্যক্রম, শান্তি, ন্যায়বিচার ও কার্যকর প্রতিষ্ঠান, অভীষ্ট অর্জনে অংশীদারত্ব লক্ষ্যসমূহ যুব দক্ষতার বিষয়টির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত এবং ওতপ্রোতভাবে জড়িত বিধায় তরুণদের সুদক্ষ করতে না পারলে সমাজ তথা রাষ্ট্রের জন্য তারা বোঝা হয়ে থাকবে। এর ফলে সমাজে শান্তিশৃঙ্খলা বিঘ্নিতসহ শ্রেণিবৈষম্য ও সামাজিক অস্থিরতা বৃদ্ধি পাবে।
সর্বোপরি আকাশ সংস্কৃতির এই যুগে অত্যধিক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার, সাইবার অপরাধ, পর্নোগ্রাফি, বৈশ্বিক যুদ্ধ পরিস্থিতি, অর্থনৈতিক বৈষম্য ইত্যাদির অনিবার্য ঝুঁকিসমূহের প্রভাব মোকাবিলা করে যুবসমাজকে সুদক্ষ করে গড়ে তোলা জাতিসংঘ ও এর অঙ্গসংগঠনগুলোর জন্য একটি বিরাট চ্যালেঞ্জ। এমতাবস্থায় ‘বিশ্ব যুব দক্ষতা দিবস’ উদ্যাপনের বিশ্বের বিপুলসংখ্যক তরুণদের সুদক্ষ করে গড়ে তোলার দায়িত্বের অংশ হিসেবে জাতিসংঘকে সদস্যরাষ্ট্রগুলোর জন্য আর্থিক, কারিগরি ও পরামর্শমূলক বিশেষ সহায়তা কার্যক্রম গ্রহণ করা এখন সময়ের দাবি।
লেখক: উপসচিব, কৃষি মন্ত্রণালয়