হাজারো মায়ের ক্রন্দন ধ্বনিত হলো পরীমনির আর্তনাদে

‘মা’ সিনেমার পোস্টারছবি : ফেসবুক

২৫ বছর ধরে বাংলাদেশের টেলিভিশন চ্যানেলের জন্য ধারাবাহিক নাটক তৈরি করে চলেছেন অরণ্য আনোয়ার। সুলেখক, সুনাট্যকার। টিভিতে ধারাবাহিক নাটক দেখতে অনাগ্রহী আজকের দর্শককেও নাটকের নেশা ধরিয়ে, মুগ্ধ করে রাখতে পারেন।

পাঁচ বছর আগে একটি ধারাবাহিক তৈরি করেছিলেন ‘fool hd’। ‘full’কে ‘fool’ করা দেখেই বোঝা যায়, নিটোল হাস্যরসের নাটক। সেই নাটকেই এক জেদি চরিত্র ছিল হরেন দয়াল, অভিনয়ে মোশাররফ করিম। গ্রাম থেকে শহরে এসেছিলেন সিনেমা বানানোর স্বপ্ন নিয়ে। কোনো বাধা–বিপত্তি, প্রতিকূলতা তাঁকে দাবিয়ে রাখতে পারেনি। অরণ্য আনোয়ারকেও আর দাবিয়ে রাখবে কে? সবার প্রত্যাশা ছিল, ধারাবাহিক নাটকের পাশে কবে সিনেমা বানাবেন?

সুপ্ত স্বপ্ন এভাবেই একদিন বনস্পতি হয়। তিনি বানালেন। সিনেমাজগতে এলেন, দেখলেন, জয় করলেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ওপর সিনেমা বানালেন। বাঙালির আবেগ–অনুভূতির একটা সিনেমা, ‘মা’। বাংলাদেশ থেকে একমাত্র চলচ্চিত্র, এ বছর কান চলচ্চিত্র উৎসবে দেখানো হলো। লাখো কোটি বাঙালির স্বপ্নের স্বাধীনতার বিশ্বাসের ছবি ‘মা’। জয় করে নিল বিশ্বের হৃদয়।

পরীমনি নিরাশ করেননি। এই প্রথম ট্যাবু, চরিত্র ভেঙে দেখিয়েছেন। তিনি অভিনয়ের জন্য জন্মেছেন। অভিনয় তাঁর রক্তে। প্রেমিক তরুণী থেকে মা-ও হতে জানেন। মা, মাটি, মাতৃভূমি, সন্তানহারা হাজার হাজার মায়ের ক্রন্দন, আবারও ধ্বনিত হলো পরীমনির আর্তনাদে। চোখের জল মিলিয়ে গেল মুক্তিযুদ্ধের অসহায় দিনগুলোর সঙ্গে।

ছোটবেলায় আমরা গল্পে পড়েছি, বুদ্ধদেবের কাছে মৃত সন্তানকে জীবিত করে তোলার জন্য নিয়ে এসেছিলেন মাতা গৌতমী। তাঁর সরল বিশ্বাস, পুত্র জীবিত হয়ে উঠবেই। বুদ্ধদেব বলেছিলেন, তুমি এমন একটা বাড়ি থেকে একমুঠো ভিক্ষা নিয়ে আসো, যে বাড়িতে দুঃখ প্রবেশ করেনি। মাতা গৌতমী ব্যর্থ হয়েছিলেন।

এই চলচ্চিত্রের মা বীণাপানি বড়ুয়া, সবাই যখন বলছে সাত মাস বয়সী নবজাতক মৃত। চরম শোকে পাগল হয়ে ওঠা মা, উত্তেজিত, ঘর থেকে সবাইকে ঠেলে বের করে দিয়ে সপাটে দরজা বন্ধ করে দিয়ে বলে উঠেছেন, তুই জেগে ওঠ বাছা, তুই জেগে ওঠ! মৃতেরা পৃথিবীতে ফেরে না কখনো। জীবিতরা জনম জনমের শোক শুধু বয়ে নিয়ে চলে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের লাখ লাখ নির্যাতনের শিকার সংখ্যালঘু হিন্দুদের কথা আমরা জানি। যদিও মুক্তিযুদ্ধে গোটা বাঙালি জাতিই সংখ্যালঘু হয়ে উঠেছিল। পাকিস্তানি বর্বর খান সেনারা বিশ্বাসঘাতক রাজাকার, আলবদরদের সঙ্গে মিলে কোনো ধর্মের কোনো মানুষকেই মুক্তি দেয়নি। এই প্রথম সংখ্যালঘু নির্যাতনের শিকার বৌদ্ধধর্মের মানুষের কথাও বড় আকারে ওঠে এল চলচ্চিত্রে।

একদিকে খণ্ডিত মানুষের টুকরা টুকরা ধর্ম, আজন্মবাহিত সরল বিশ্বাসের ধর্মান্ধতা। অন্যদিকে নরখাদক মানুষের ভেতরে গজিয়ে ওঠা হিটলার। কোনো ধর্মের কোনো ভগবান কাউকে বাঁচাতে আসে না। যিশুর মতো ক্রুশবিদ্ধ কাতরে কাতরে মরা মানুষের লাশ দিকে দিকে শুধু স্তূপাকার হয়। গল্প লিখেছেন এই চলচ্চিত্রের প্রযোজক পুলক কান্তি বড়ুয়া। সেই গল্পকে অনবদ্য চিত্রনাট্যে রূপ দিয়েছেন অরণ্য আনোয়ার।

মায়ের গর্ভযন্ত্রণা, প্রসববেদনার মতো যন্ত্রণায় ভুগতে ভুগতে গোটা দেশ তবু লড়ে যায়। কাকতালীয় হলেও সত্যি, এই চলচ্চিত্রে গর্ভে সন্তান নিয়ে বীণাপানি চরিত্রে অভিনয় করতে আসেন পরীমনি। যাঁর গর্ভে বাস্তবেই তখন চার মাসের সন্তান। বমি করতে করতে তিনি চরিত্রে অভিনয় করেছেন। জ্বর গায়ে নিয়ে অভিনয় করেছেন। পরীমনির হঠাৎ বিয়ে, সন্তান একের পর এক ঘটনা। ডেট না পেয়ে হতাশ অরণ্য ভেবেছিলেন এই ছবি আর হবে না।

পরীমনি নিরাশ করেননি। এই প্রথম ট্যাবু, চরিত্র ভেঙে দেখিয়েছেন। তিনি অভিনয়ের জন্য জন্মেছেন। অভিনয় তাঁর রক্তে। প্রেমিক তরুণী থেকে মা-ও হতে জানেন। মা, মাটি, মাতৃভূমি, সন্তানহারা হাজার হাজার মায়ের ক্রন্দন, আবারও ধ্বনিত হলো পরীমনির আর্তনাদে। চোখের জল মিলিয়ে গেল মুক্তিযুদ্ধের অসহায় দিনগুলোর সঙ্গে।

লাবণ্য চৌধুরী, ফারজানা ছবি, রোবেনা রেজা, শাহাদাত হোসাইন, সাজু খাদেম, রায়হান খান—সবার যৌথ প্রচেষ্টার ফসল এই চলচ্চিত্র। বাংলা মায়ের ললাটে এমনই রক্তবরণ, রক্তিম স্বাধীনতার সূর্য উঠুক বারবার। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ধর্ম নয়, মানবতা মিলিয়ে দিক মানুষকে।

হাওড়া, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত