দশ বছর বাড়ি ফেরেননি, ভ্রমণ করলেন ২০৩টি দেশ!

ডেনমার্কে ফেরার পর ভালোবাসায় সিক্ত পেডারসনছবি: ফেসবুক থেকে সংগৃহীত

৩৫৭৬ দিন, ৩৭টি কনটেইনার জাহাজ, ১৫৮টি ট্রেন, ৩৫১টি বাস, ২১৯টি টেক্সি, ৩৩টি নৌকা ও ৪৩টি রিকশা; সংখ্যাগুলো পেডারসন নামের এক ডেনমার্ক নাগরিকের ভ্রমণের পরিসংখ্যান। তিনি ২০১৩ সালের ১০ অক্টোবর বাড়ি থেকে বের হয়ে যান, টানা ১০ বছর বিশ্বের ২০৩টি দেশ ঘোরা শেষে চলতি বছরের ২৬ জুলাই মার্তৃভূমি ডেনমার্কে ফিরে আসেন। মজার ব্যাপার হলো, পুরো ভ্রমণে কখনোই আকাশপথ ব্যবহার করেননি এই ডাচ নাগরিক। সড়ক ও নৌপথে পাড়ি দিয়েছেন একের পর এক দেশ-মহাদেশ!

দীর্ঘ ভ্রমণযাত্রা
যখন ভ্রমণের পরিকল্পনা করেন, তখন অবশ্য এত দিন লাগবে তা পেডারসন কল্পনাও করেননি। ভেবেছিলেন চার বছরে ২০৩টি দেশ ঘুরে ফেলতে পারবেন। কিন্তু সড়কপথে বিভিন্ন দেশে প্রবেশের অনুমতি পেতে অনেক সময় লেগে যায়। ইকোয়াটোরিয়াল গিনি এর মধ্যে অন্যতম। চার মাস ধরে অসংখ্য ব্যর্থ চেষ্টার পর আফ্রিকার দেশটিতে প্রবেশের অনুমতি পান তিনি। পরবর্তী সময়ে পেডারসন ভেবেছিলেন মঙ্গোলিয়া সীমান্তে চীনা ভিসা পেয়ে যাবেন এবং সেখান থেকে সরাসরি পাকিস্তান ভ্রমণ করবেন। কিন্তু দীর্ঘ প্রক্রিয়ার কারণে এবং ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে তাঁকে পাকিস্তানে যাওয়ার জন্য বিভিন্ন দেশের মধ্য দিয়ে প্রায় ৭ হাজার ৫০০ মাইল পাড়ি দিতে হয়েছে। এ ছাড়া সিরিয়া, ইরান, নাউরু ও অ্যাঙ্গোলার মতো দেশের ভিসা পেতে মাসখানেকের বেশি সময় লেগে যায়।

স্ত্রীর সঙ্গে পেডারসন
ছবি: ফেসবুক থেকে সংগৃহীত
করোনার দুই বছর হংকংয়ে থাকার সময় পেডারসন দেশটি চষে বেড়িয়েছেন, রেডক্রসের সঙ্গে কাজ করেছেন, বিভিন্ন জায়গায় মোটিভেশনাল বক্তব্য দিয়েছেন এবং একটি ড্যানিশ সিমেন চার্চে কাজ করেছেন। একটি কর্মসংস্থান ভিসা এবং হংকংয়ে থাকার অনুমতিও নিয়ে নেন। এই সময় তিনি তাঁর বাগদত্তা লিকে বিয়ে করেন।

এর বাইরে ঘানায় সেরিব্রাল ম্যালেরিয়ার গুরুতর সংক্রমণ কাটিয়ে উঠতে হয়েছে, আইসল্যান্ড থেকে কানাডায় পাড়ি দিতে আটলান্টিক অতিক্রম করার সময় দীর্ঘ চার দিন তীব্র সামুদ্রিক ঝড়ের সম্মুখীন হতে হয়েছে। বিরোধপূর্ণ অঞ্চলগুলোতে স্থলসীমান্ত বন্ধ থাকায় যাত্রাপথ পরিবর্তন করতে হয়েছে, জাহাজ ভেঙে যাওয়া বা ক্লান্তির কারণে অনেক নৌযান পরিবর্তন করতে হয়েছে। এসবের কারণে আরও সময় বেশি লেগে যায়।

করোনা মহামারি
যাত্রাপথে সবচেয়ে বড় বিরতি পড়ে করোনা মহামারির সময়। ২০২০ সালের শুরুর দিকে হংকংয়ে আটকা পড়ে যান তিনি। অথচ সে সময় মাত্র ৯টি দেশ বাকি রয়ে যায়। পেডারসন বলেন, ‘হংকংয়ের দিকে ফিরে তাঁকালে বলব, এটি একদিকে আমার জীবনের সবচেয়ে খারাপ সময়, আবার অন্যদিকে জীবনের সবচেয়ে ভালো সময়ও। আমাকে পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে হয়েছে। একবার মনে হয়েছিল, বাকি ৯টি দেশ ভ্রমণ ছাড়া দেশে ফিরে যাই। নিজেকে জিজ্ঞেস করেছি, আমার জীবনের কতটুকু এর পেছনে দেব? তবে আবার বিশ্ব খোলার অপেক্ষা না করে আমি হংকংয়ে একটি নতুন জীবন তৈরি করে নিই এবং অনেক বিশেষ সম্পর্ক ভুলে যাই।’

করোনার দুই বছর হংকংয়ে থাকার সময় পেডারসন দেশটি চষে বেড়িয়েছেন, রেডক্রসের সঙ্গে কাজ করেছেন, বিভিন্ন জায়গায় মোটিভেশনাল বক্তব্য দিয়েছেন এবং একটি ড্যানিশ সিমেন চার্চে কাজ করেছেন। একটি কর্মসংস্থান ভিসা এবং হংকংয়ে থাকার অনুমতিও নিয়ে নেন। এই সময় তিনি তাঁর বাগদত্তা লিকে বিয়ে করেন। পেডারসন বলেন, ‘আমরা একসঙ্গে ১০০ দিন কাটিয়েছি এবং দিনগুলো ছিল অসম্ভব সুন্দর।’ ২০১৩ সালে ডেনমার্ক ছেড়ে আসার পর এটাই ছিল তাঁদের একসঙ্গে এত দীর্ঘ সময় থাকা। হংকং থেকে লি আবারও ডেনমার্ক ফিরে যান।

শ্রীলঙ্কায় পেডারসন
ছবি: ফেসবুক থেকে সংগৃহীত

আবার যাত্রা শুরু
২০২২ সালের ৫ জানুয়ারি আবার বিশ্বযাত্রা শুরু করেন পেডারসন। তাঁর প্রথম গন্তব্য ছিল পালাউ। কনটেইনার জাহাজের মাধ্যমে দেশটিতে প্রবেশের অনুমতি পেতে ছয় মাস লেগে যায়। অনুমতি পাওয়ার পর ১৫ দিন কেটে যায় সমুদ্রে। এরপর পালাউ ঢুকে ১৪ দিনের মধ্যে ৮ দিনই কাটাতে হয়েছে হোটেল কোয়ারেন্টিনে। পরবর্তী আরও ১৬ দিন জার্নি করে ফিরে যান হংকংয়ে। সেখানে আরও দুই সপ্তাহ কোয়ারেন্টিন। এক মাস পর আবারও যাত্রা শুরু। এবারের গন্তব্য অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, সামোয়া ও টোঙ্গা। তবে কোনো যাত্রাই সহজ ছিল না। পেডারসন বলেন, ‘প্রায় প্রতিটি দেশের সরকার থেকে আমাকে বিশেষ অনুমতি নিতে হয়েছে যেমন টোঙ্গা, দেশটির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, নৌবাহিনী, সেনাবাহিনী—সবার সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। কিন্তু করোনার কারণে কেউই অনুমতি দিতে চায়নি। তারপর এক রাতে দেশটির প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে একটি ই–মেইল পাই। সেটিতে লেখা ছিল—ওকে, তাঁকে আসতে দাও।’

ভ্রমণের সর্বশেষ দেশ ছিল মালদ্বীপ। যখন তিনি সমুদ্রপথে শ্রীলঙ্কা থেকে মালদ্বীপের মালে বন্দরে অবতরণ করেন, সেখানে তাঁকে স্বাগত জানানোর জন্য অপেক্ষা করছিল অনেকে। এর মধ্যে একজন বিশ্বের প্রতিটি দেশ দুবার করে ভ্রমণ করা প্রথম ব্যক্তি নরওয়ের নাগরিক গুনার গারফোর্স। পেডারসন বলেন, ‘যখন আমি মালদ্বীপে ছিলাম, খুব ব্যস্ত সময় গেছে। পেছন ফিরে তাঁকানোর জন্য আমার কাছে কোনো সময় ছিল না। মানসিকভাবেও খুব ক্লান্ত ছিলাম।’

মালদ্বীপের মালে বন্দরে অবতরণ করার পর পেডারসন
ছবি: ফেসবুক থেকে সংগৃহীত

উদ্দেশ্য
পুরো ভ্রমণটি সংখ্যায় প্রকাশ করতে চান না পেডারসন। তিনি বলেন, ‘আমি একটি উদ্দেশ্য নিয়ে এই ভ্রমণে বের হই। একজন অচেনা ব্যক্তি আপনার বন্ধু হয়ে যেতে পারে, যার সঙ্গে আগে কখনো দেখা হয়নি। আর আমি এটির প্রমাণ বারবার পেয়েছি।’ পেডারসন জানান, তিনি বিশ্বের প্রায় সব জায়গায় বন্ধুত্বপূর্ণ ও সহযোগী মানুষের দেখা পেয়েছেন; যারা তাঁর জন্য চা ও খাবার এবং থাকার ব্যবস্থা করেছেন। অসংখ্য অচেনা ব্যক্তির বাড়িতে রাত যাপন করেছেন। পেডারসন বলেন, ‘হয় আমি পৃথিবীর সবচেয়ে সৌভাগ্যবান ব্যক্তি, অথবা সোশ্যাল মিডিয়া ও নিউজ চ্যানেলে যেমন সংবাদ প্রচারিত হয়, তার চেয়েও পৃথিবী অনেক ভালো জায়গা।’

চলতি বছরের ২৪ মে সফলভাবে সর্বশেষ দেশ হিসেবে মালদ্বীপ ভ্রমণ শেষ হয়। এরপর চাইলেই আকাশপথে ডেনমার্কে ফিরে যেতে পারতেন। কিন্তু ৪৪ বছরের পেডারসন চক্র পূর্ণ করতে চান। তাই এমভি মিলান নামক জাহাজে করে শুরু করেন সর্বশেষ যাত্রা। ভারত মহাসাগর, রেড সি, সুয়েজ খাল, ভূমধ্যসাগর, ইংলিশ চ্যানেল এবং জার্মানি পার হয়ে অবশেষে ডেনমার্ক পৌঁছান। ২৬ জুলাই ডেনমার্কের পূর্ব উপকূলীয় বন্দর আরহাসে পৌঁছালে দেখেন, সেখানে তাঁকে স্বাগত জানাতে প্রায় ১৫০ জন মানুষ অপেক্ষা করছেন। এর মধ্যে ছিলেন স্ত্রী লি, বাবা, ভাইবোন, বন্ধুসহ আরও অনেক সমর্থক। সে সময়কার অনুভূতি ব্যক্ত করে পেডারসন বলেন, ‘আমি অসংখ্য অশ্রুমিশ্রিত চোখ দেখেছি। তাঁরা আমাকে জড়িয়ে ধরতে এসেছেন। অসংখ্য উপহারও পেয়েছি। পরিবার আমার জন্য গর্বিত। চারদিকে সবার কাছ থেকে ভালোবাসা পাচ্ছি।’

২০৩টি দেশ ভ্রমণ করেছেন তিনি
ছবি: ফেসবুক থেকে সংগৃহীত

পরবর্তী লক্ষ্য
বিশ্বভ্রমণে বের হওয়ার আগে শিপিং ও লজিস্টিক বিভাগে কাজ করতেন এই ডাচ। সবকিছু ছেড়ে বের হয়ে যান। এবার ভ্রমণ শেষ, দীর্ঘ ১০ বছর পর বাড়ি ফেরা হলো। পরবর্তী লক্ষ্য কী? পেডারসন জানান, আপাতত স্ত্রীকে সময় দিতে চান। তাঁর সঙ্গে মিলে সুন্দর একটি পরিবার শুরু করতে চান। ‘আমাদের অনেক কিছু উদ্‌যাপন করা বাকি রয়েছে। যখন আমি ভ্রমণে ছিলাম, সে (স্ত্রী) অনেক কিছু সম্পন্ন করেছে। সে মেডিকেলের ডিগ্রি সম্পন্ন করেছে, পিএইচডি শেষ করেছে, একটি ফার্মাসিউটিকাল কোম্পানিতে কাজ শুরু করেছে, সেখানে পদোন্নতি পেয়েছে। সে সুপার ওম্যান,’ যোগ করেন তিনি।

আগে মঞ্চে দাঁড়িয়ে কথা বলতে পারতেন না। এখন ৩০০ মানুষের সামনে হাসিমুখে কথা বলতে পারেন। পেডারসন বলেন, ‘ভ্রমণ আমাকে আমার শক্তির জায়গা খুঁজে পেতে সহায়তা করেছে। এর মধ্যে মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ ও মেলামেশা অন্যতম। আশা করছি, আমার এই অভিজ্ঞতার মাধ্যমে মানুষকে অনুপ্রেরণা জোগাতে পারব যে কখনো হাল ছাড়তে নেই।’

সূত্র: সিএনএন ট্রাভেল