আমি খাচ্ছিলাম, মা তাকিয়ে দেখছিলেন। এমনভাবে দেখছিলেন, যেন প্রতিবার গলাধঃকরণে যে ভাত আমার পেটে যাচ্ছে, সেটি একই সঙ্গে তাঁর পেটেও যাচ্ছে। খাচ্ছি আমি, তৃপ্তি পাচ্ছেন মা।
আমার মা যেবার ধরণিতে এসেছিলেন, তার কিছুদিন পর যুদ্ধ শুরু হয়েছিল।
না, এই যুদ্ধ ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর উদ্দেশ্যে নয়, যারা ধ্বংসযজ্ঞ চালাতে এসেছিল, তাদের ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে। এ যুদ্ধ হয়েছিল আমার মাকে রক্ষা করার জন্য; যারা দেশমাতৃকাকে কলুষিত করত, মায়ের ভাষাকে অপবিত্র করতে বিষবাক্য প্রয়োগ করত, এ ছিল তাদের সমূলে উৎপাটনের যুদ্ধ।
আমার মায়েদের পবিত্র মলিন শাড়ির আঁচল টেনে ধরত যেসব কাপুরুষ, তাদের জিব ও কুরুচিপূর্ণ বিবেককে ছিঁড়ে ফেলার যুদ্ধ।
আমার মায়ের জননী আমাকে বলতেন, ‘সেবার কী যুদ্ধরে ময়না, তোর মা-ও তখন হামার কোলের ছোল, কোনটে নে যায়া থাকিনি তোর মাওক!’
আমি বলতাম, ‘নানি, তারপর কী হয়েছিল?’
নানি বলতেন, ‘তোর নানা ওমুরো এডা গর্ত খুঁড়ছিল, ওটে যায়া সগলি নুকে থাকিচ্চিলেম। মেলের কলোনির ওমুক থেকে মোদে মোদে গুলি আসে নাগচে বাঁশের থোপোত। এংকে ম্যালা দিন ধরে চলতে চলতি দেশ স্বাধীন হয়া গেল।’
তিনি কি জানতেন, এই দেশ স্বাধীনের জন্য কোল খালি হয়েছে কত হাজার মায়ের? জানতেন নিশ্চয়ই! আচ্ছা তখনকার মায়েদের কোল খালি না হলে আজকের মায়েদের কোলে যারা আসছে, তারা কি স্বাধীনভাবে কথা বলতে পারত?
না, পারত না।
স্বাধীনতার পর কি পেরেছিল? তারপর কি পেরেছিল? কিংবা তারপর...,বা এখন?
মায়ের আঁচলের বাঁধন ছিঁড়ে যে যুবক যুদ্ধে গিয়েছিল তার মায়ের অধিকার আদায়ে, সে কি নিজ জীবনের বিনিময়ে সেই অধিকার পেয়েছে, বৈষম্যের শিকার যে কৃষক যুদ্ধে গিয়েছিল তার ফসলের ন্যায্য দামের অধিকার আদায়ে, সে কি সেই অধিকার পেয়েছে? যে শ্রমিক গিয়েছিল তার শ্রমের যথাযথ মূল্য পাওয়ার অধিকার আদায়ে, সে কি প্রাপ্য মূল্যের অধিকার পেয়েছে? যে ছাত্র ’৬২-এর শিক্ষা আন্দোলনে যুক্ত হয়েছিল তার শিক্ষার অধিকার আদায়ে, সে কি সেই অধিকার পেয়েছে?
হয়তো পেয়েছে কিংবা পায়নি; প্রত্যাশা, বিবেচ্য হোক সবার কাছে!
দেশমাতৃকার অঢেল সৌন্দর্য আমাকে মুগ্ধ করে। মুগ্ধ করে ডিগলি বিলের ফুটন্ত সাদা সাদা শাপলা; শাপলার ওপর বসে থাকা সাদা রঙের বক কিংবা সমজাতীয় পক্ষীকুল। শাপলার গোলাকৃতি পাতার বুক চিড়ে নৌকা বাইতে ভালো লাগে। ভালো লাগে তিন তক্তার ওই ডিঙিনৌকায় ভাসতে; গলুইয়ে শুয়ে নীলাভ আকাশের সাদা মেঘের-বকের ওড়াউড়ি দেখতে। ভালো লাগে খেতের ধান কাটার সময় ঘাসফড়িংয়ের তীব্র ছোটাছুটি, ছলছলা পরিষ্কার পানিতে ধোয়া পাটের সোনালি আঁশ, আঁশ থেকে আসা ঈষৎ আমিষযুক্ত গন্ধ। যে গন্ধ কৃষকের শরীরের-বাংলা মায়ের মাটির গন্ধের সঙ্গে সম্পৃক্ত; সেই গন্ধ আমার ভালো লাগে।
ভালো লাগে কাঠগোলাপ, কিংবা কাঠগোলাপ বর্ণের নারীকে; তার চুল, চোখ, ঠোঁট, বক্ষ কিংবা বক্ষের ভাঁজ, নিতম্ব, পায়ের গোড়ালি—সবই আমার ভালো লাগে।
বর্ষা এসে যখন ভিজিয়ে দেয় বাংলার মাঠঘাট, পথপ্রান্তর; গ্রামের কাঁচা মেঠো পথ দিয়ে চলতে গিয়ে যখন পিছলে পড়ে যায় পথচারী, ভিজে যায় ধান রোপণকারী কিষানের শরীর, তখন আসেন আমার মা। আমার মা এসে আমাকে বলেন, ‘বাবা, এই নে ভাত, খেয়ে নে।’
আমি বলি, ‘মা, রান্নাঘর থেকে যে ভাত আনলেন, বৃষ্টির মধ্যে ভিজল না?’
মা বলেন, ‘ভিজবে কেন, আঁচল দিয়ে ঢেকে আনলাম।’
দেখলাম, রান্নাঘর থেকে ভাত নিয়ে এ ঘরে আসার সময় মা ভিজে গেছেন, ভিজে গেছে তাঁর শাড়ির আঁচল, তবে ভেজেনি ভাত, ভাপ উঠছে ভাত থেকে।
মা বললেন, ‘কথা না বলে খা, খাওয়ার সময় কথা বলতে হয় না।’
আমি খাচ্ছিলাম, মা তাকিয়ে দেখছিলেন। এমনভাবে দেখছিলেন, যেন প্রতিবার গলাধঃকরণে যে ভাত আমার পেটে যাচ্ছে, সেটি একই সঙ্গে তাঁর পেটেও যাচ্ছে। খাচ্ছি আমি, তৃপ্তি পাচ্ছেন মা।
বললেন, ‘আঙুল চেটে খা, আঙুল চেটে খাওয়ার উপকারিতা অনেক। মা ডাক্তার নন, তবে অনেক রোগ সারানোর বিদ্যা কীভাবে জানি জানেন!
আমি যদি ভাত খাওয়ার পর পানি না খেয়ে কখনো কুষ্টিয়ায় চলে আসি, তখন তিনি হয়তো গ্লাস হাতে আমার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকবেন।
দাঁড়িয়ে থাকবেন তত দিন, যত দিন না আমি আমার গ্রামের বাড়ি গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের-মহিমাগঞ্জের সেই শিংজানী গ্রামে ফিরব।
আমার জননী আমার জন্য দাঁড়িয়েই থাকবেন, কারণ তিনি যে বায়েজিদ বোস্তামী!
বন্ধু, কুষ্টিয়া বন্ধুসভা