বৃক্ষপ্রেমী বঙ্গবন্ধু এবং কালের সাক্ষী নাটোরের উত্তরা গণভবনের ‘হৈমন্তীগাছ’

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানঅলংকরণ: মাসুক হেলাল

‘টুঙ্গিপাড়ার দস্যি ছেলে বৃক্ষপ্রেমী শেখ মুজিবুর রহমান
        কালের সাক্ষী মধুমতী, গাইছে আজও তাঁরই নাম।
দুরন্ত সেই খোকার স্বপ্ন, গড়বে স্বাধীন সোনার দেশ,
৭-ই মার্চের বজ্রকণ্ঠে গর্জে উঠল এই স্বদেশ।
        মুজিব মানে মা-মাটি আর মাতৃভূমি বাংলাদেশ।’

পল্লিবাংলার সৃজনশীল সাহসী মানুষেরা অবহেলা, উৎসাহ ও অনুপ্রেরণাবিহীন পরিবেশে বেড়ে ওঠেন, অনেকে হয়তো মুখ তুলেও তাকায় না। একসময় যখন দেখতে পায়, সৃষ্টিশীল সাহসী বীরপুরুষটি তাঁর জিয়নকাঠির আলো ছড়িয়ে দেশ ছাড়িয়ে পুরো বিশ্বে বিখ্যাত হয়ে ওঠেন। যাঁর মুনশিয়ানায় একটি স্বাধীন দেশের জন্ম হয়। স্বাধীন বাংলাদেশের দিকপাল, যাঁকে বলা হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষক। কে না চায় তাঁকে ভালোবাসতে কিংবা বিনম্র শ্রদ্ধা জানাতে। একটা সময় তিনি সমগ্র দেশে সর্বজনশ্রদ্ধেয় হয়ে ওঠেন। ছোটবেলা থেকে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি শেখ মুজিবুর রহমানের নাম শুনেছি। বই পড়ে জানলাম, অনেক বড় মাপের রাজনীতির কবি টুঙ্গিপাড়ার দস্যিছেলে শেখ মুজিবুর রহমান। জন্মশতবর্ষে তাঁকে জানার কৌতূহল পেয়ে বসে। এই মহান গুণী মানুষটির জন্মশতবর্ষে কত গল্প, কবিতা-ছড়া-ইতিহাস-প্রবন্ধ রচিত হয়েছে ইয়ত্তা নেই। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি এই মানুষ বৃক্ষপ্রেমী ছিলেন। বৃক্ষের প্রতি ছিল প্রেম, তিনি নিজ হাতে লাগিয়েছেন শত শত বৃক্ষ।

নাটোরের উত্তরা গণভবনে বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিবিজড়িত কালের সাক্ষী হৈমন্তীগাছ। অফিশিয়াল ট্যুরে গিয়েছিলাম নাটোরে। নাটোরের নামকরণ হয়েছে নাট্যপুর থেকে। আবার কেউ বলেন বর্তমানে যে স্থানে রাজবাড়ি নির্মিত হয়, সে স্থানে জলের গভীরতা ছিল অনেক; এটিকে বলা হতো ‘না তর’। কথিত আছে, এই ‘না তর’ থেকে নাটোর নামের উৎপত্তি। এর পেছনে রয়েছে রূপকথার গল্পের মতো এক ইতিহাস। একদা বর্ষাকালে নাটোরের জমিদার রামজীবন ও রঘুনন্দন জ্যোতিষ ও লোকজন নিয়ে নৌকায় আমহাটি এলাকায় বেড়ানোর জন্য ভাতঝরা বিলের মধ্যে উপস্থিত হন। হঠাৎ দেখতে পেলেন, একটি নেউল সাঁতার দিয়ে যাচ্ছে এবং একটি বড় ব্যাঙ একটি সাপকে ভক্ষণ করছে। এই  দৃশ্য দেখে ছোট দুটি বালিকা হাত তালি দিয়ে নাচছে। পণ্ডিতেরা এই স্থানকে বিবেচনা করল রাজবাড়ির জন্য। একসময় রাজা রামজীবন দীঘি ও পুকুর খনন করে মাটি ফেলে বিলটি সমতল করেন। যে স্থানে ব্যাঙ সাপকে খাচ্ছিল এবং বালিকারা নৃত্য করছিল, সেখানে নির্মিত হলো রাজবাড়ি। কালের বিবর্তনে সেখানে বহুলোকের সমাগম ঘটে ভাতঝরা বিলটি একসময় শহরে পরিণত হয়। বালিকারা নৃত্য করেছিল বলে এর নামকরণ হয় নাট্যপুর। নাট্যপুর থেকে নাটোর।

১৯৭২ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান উত্তরা গণভবন পরিদর্শনে এলে গণভবনের বাগানে নিজ হাতে একটি হৈমন্তীগাছের চারা রোপণ করেন। বাগানের সবচেয়ে নান্দনিক ৫১ বছরের পুরোনো হৈমন্তীগাছটি ‘জীবন্ত মূর্তি’র মতো দাঁড়িয়ে আছে এখনো।

একদিন সহকর্মী জাকির বললেন, চলেন দিঘাপতিয়ায় উত্তরা গণভনে যাব। খুব সুন্দর জায়গা। আগে থেকে জানতাম, সেখানে বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিবিজড়িত হৈমন্তীগাছ আছে। বনলতা সেনের স্মৃতিবিজড়িত নাটোরে টমটমের মতো ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক চলে। টমটম ছুটে চলেছে দিঘাপতিয়া রাজবাড়ি। একসময় আমরা এসে পৌঁছালাম দিঘাপতিয়ায়। গণভবনে প্রবেশ করতে মূল ফটকের মাঝখানে চমৎকার একটা ঘড়ি চোখে পড়ল। ইতালির ফ্লোরেন্স থেকে দিঘাপতিয়ার রাজা ঘড়িটি এনেছিলেন বলে নাটোরে এটি ‘ইতালিয়ান ঘড়ি’ নামে পরিচিত। ঘড়িটির নিরবচ্ছিন্ন ঘণ্টার ধ্বনি সকালের নীরবতাকে একসময় চূর্ণবিচূর্ণ করে নাটোরবাসীকে সময় জানিয়ে দিত। ১৭০৬ খ্রিষ্টাব্দে দয়ারামকে রাজা রামজীবন কিছু জমি দান করেন বাসস্থান নির্মাণ করে বসবাসের জন্য। মুর্শিদাবাদের নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ খুশি হয়ে তাঁকে রায়নারায়ণ উপাধিতে ভূষিত করেন। সেই সঙ্গে নওখিলা পরগনা লাভ করেন। এই নওখিলা হলো দিঘাপতিয়া রাজবংশের প্রথম জমিদারি।

১৮৯৭ সালের ১২ জুন ভূমিকম্পে দিঘাপতিয়া রাজবাড়ি, দেবালয়, সুদৃশ্য বাগান, ক্লাব, লাইব্রেরি, ডাকঘর, চিকিৎসালয়সহ মন্দির ও অন্যান্য স্থাপনা ধ্বংস হয়ে গেলে নতুনভাবে ১৮৯৯ সালে রাজা প্রমদানাথ রায় নান্দনিকভাবে উত্তরা গণভবন আবার নির্মাণ করেন। ১৯৬৬ সালে এই রাজপ্রাসাদ পূর্ব পাকিস্তান সরকারের নিয়ন্ত্রণে আসে। পাকিস্তান সরকার দিঘাপতিয়া রাজবাড়িতে প্রতিষ্ঠা করেন গভর্নর হাউস। তৎকালীন গভর্নর আবদুল মোনায়েম খান ১৯৬৭ সালের ২৪ জুলাই এটি উদ্বোধন করেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গভর্নর হাউসকে ‘উত্তরা গণভবন’ নামকরণ করেন। সেই থেকে এটি উত্তরা গণভবন নামে পরিচিত। ১৯৭২ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান উত্তরা গণভবন পরিদর্শনে এলে গণভবনের বাগানে নিজ হাতে একটি হৈমন্তীগাছের চারা রোপণ করেন। বাগানের সবচেয়ে নান্দনিক ৫১ বছরের পুরোনো হৈমন্তীগাছটি ‘জীবন্ত মূর্তি’র মতো দাঁড়িয়ে আছে এখনো।

হৈমন্তীগাছ বা কুরচিগাছের বৈজ্ঞানিক নাম Holarrhena pubescens। চীন, ইন্দোনেশিয়া, ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকা, ভেনিজুয়েলায় এটি পাওয়া যায়। হোমিওপ্যাথ চিকিৎসায় টিংচার হিসেবে এটি ব্যবহৃত হয়। হৈমন্তী ফুলের বেশ সুঘ্রাণ রয়েছে। গাছটি যত্ন না নেওয়ায় কীটপতঙ্গ ও ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণে এর কাণ্ড ও ডালপালা কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও বর্তমানে গাছটি সতেজ হয়ে কালের সাক্ষ্য বহন করছে। হৈমন্তীগাছের নিচে বসে বেশ প্রশান্তি অনুভব করলাম, দু-একটি ছবিও তুলে নিলাম। গণভবন এলাকায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৩ সালের ১ জুলাই নারকেলগাছের চারাও রোপণ করেন। ‘কারাগারের রোজনামচা’ বইয়ে ১৯৬৬ সালের ৬ জুন লিখেছেন, ‘লাউ লাগাইয়াছিলাম। গাছ হয়েছে। ঝিংগা গাছও বেড়ে উঠেছে। ফুলের বাগানটিকে নতুন করে সাজাইয়া–গোছাইয়া করতে শুরু করেছি।’

বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে রেসকোর্সে ঘোড়দৌড় বন্ধ করে দেওয়া হয়। গাছ লাগিয়ে ঘোড়দৌড় ময়দানকে পরিণত করা হয় একটি সবুজ শ্যামল সুদৃশ্য উদ্যানে। যা বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান নামে পরিচিত। সে সময় এক কর্মকর্তা বলেছিলেন, ‘জনগণ গাছের ফল চুরি করে খেয়ে ফেলবে।’ বঙ্গবন্ধু হেসে জবাব দিয়েছিলেন, ‘জনগণের জমি জনগণের গাছ। ওরাই যদি ফল খায়, আপনার আমার আপত্তি কোথায়?’ বৃক্ষপ্রেমী বঙ্গবন্ধুর আজও কালের সাক্ষ্য বহন করছে শৈশব স্মৃতিবিজড়িত হিজল আর আমগাছ। খুলনা সরকারি মহিলা কলেজ প্রাঙ্গণে প্রবেশপথে বিশাল উচু নারকেলগাছ মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে। ১৯৭২ সালের ৩ জুলাই বঙ্গবন্ধু খুলনা মহিলা কলেজে এলে তিনি নিজ হাতে নারকেলগাছটি রোপণ করেন। গাছটিতে আজও নারকেল ধরে। বৃক্ষের পাতাগুলো আজও বাতাসে ওড়ে, গাছগুলো বৃষ্টিতে ভিজে, মিষ্টিরোদের সুধা পান করে, জ্যোৎস্নার আলোতে ঝিলমিল করে বঙ্গবন্ধুর কথা বলে। পত্রপল্লব বাতাসে দুলে গাছের পাতা নেড়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গাছগুলো ধন্যবাদ জানায়, দোয়ার বৃষ্টি বর্ষণ করে। বৃক্ষরোপণের জন্য সদকায়ে জারিয়া হিসেবে তাঁর কবরে সওয়াব পৌঁছে যাচ্ছে। বঙ্গবন্ধুর যে একটা চিরসবুজ সুন্দর মন ছিল, সেটি তাঁর বৃক্ষপ্রেম দেখলে বোঝা যায়।

ফিদেল কাস্ত্রো বলেছিলেন, ‘আমি হিমালয় দেখিনি, বঙ্গবন্ধুকে দেখেছি।’ আমাদের হিমালয় পর্বত হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পরিবারে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট নেমে এসেছিল অমানিশা। বাঙালি জাতির জীবনে এর চেয়ে বিষাদ–বেদনাবিধুর ও কলঙ্কিত অধ্যায়ের মতো বিশ্বে দ্বিতীয়টি আর কোনো দেশে ঘটেছিল কি না, জানা নেই। সেদিন কিছু দুষ্কৃতকারী বিপথগামীর হাতে নিহত হন বঙ্গবন্ধু, তাঁর স্ত্রী ফজিলাতুন্নেছাসহ তিন ছেলে, ভাগনে শেখ ফজলুল হক মণি ও তাঁর পরিবারের সদস্য, বঙ্গবন্ধুর ভগ্নিপতি কৃষক নেতা আবদুর রব সেরনিয়াবাত ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা, বঙ্গবন্ধুর সামরিক সচিব কর্নেল জামিল, বঙ্গবন্ধুর শিশুপুত্র শেখ রাসেলসহ শেখ মনির অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীও সেদিন খুনিদের হাত থেকে রেহাই পায়নি। মাত্র এক ঘণ্টার অপারেশনে সর্বমোট ২৬ জন সদস্যকে নৃশংসভাবে হত্যা করে ঘাতকেরা।

শোকের মাস আগস্ট চলছে। বঙ্গবন্ধুর লাগানো হৈমন্তীগাছ ও নারকেলগাছগুলো আজও কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হলদে পাখি, কাক ও চড়ুই বসে সেখানের গাছের ডালে ডালে। বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিবিজড়িত হৈমন্তীগাছ ও নারকেলগাছগুলো আজও কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বঙ্গবন্ধুপ্রেমীরা সেই বৃক্ষের মাঝে নেতাকে খুঁজে ফেরেন।

বন্ধু, চট্টগ্রাম বন্ধুসভা