সুন্দরভাবে গোছানো একটি রুম। কার্নিশে রাখা আছে সুসজ্জিত দু–একটা ফুলের টব। একটাতে ক্যামেলিয়া ফুটেছে। খুবই সুন্দর। কিন্তু ফুলটা স্নিগ্ধতার বদলে কেমন জানি মলিনতা ছড়াচ্ছে। বাকি টবের গাছগুলো শুকিয়ে অর্ধমৃত হয়ে আছে। পোষা বিড়ালটিও আর রুমে হইচই করে বেড়ায় না। খাবার পেলে খায়, না পেলে মিউ মিউ করে ডাকেও না। সারা দিন রুমের এক কোনায় গিয়ে চুপটি মেরে বসে থাকে। যে চড়ুই পাখিগুলো কিচিরমিচির শব্দ করে সারা দিন রুমটি ভরিয়ে রাখত সে পাখিগুলোও এখন আর শব্দ করে না। তবে বাসাটি এখনো আছে। মাঝেমধ্যে সন্ধ্যাবেলায় রুমের জানালাটি খুললে স্নিগ্ধ হাওয়ার ঝাপটা এসে গা জুড়িয়ে দিত। এখন হাওয়া আসে ঠিকই, কিন্তু সে হাওয়ায় আর গা জুড়ায় না। হাওয়া লাগলে শরীর যেন অস্বস্তিতে ভরে ওঠে। রুমের ভেতর একটি টেবিলে থরে থরে সাজানো আছে দশম শ্রেণির বিজ্ঞান শাখার কিছু বই। এক পাশে কিছু খাতা। সঙ্গে একটি ক্যালেন্ডারও আছে। টেবিল ক্যালেন্ডারটির পাশে একটি ছোট কার্টুনের মতো দেখতে অ্যালার্ম ঘড়ি। দেখে বোঝার উপায় নেই আসলে ওটা ছোট্ট কার্টুন নাকি ঘড়ি! দুটো চেয়ারের মধ্যে একটি চেয়ার খালি। টেবিলে থাকা ক্যালেন্ডারটিতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে আজ মাসের ৪ তারিখ।

ঈশিতা সেই ক্যালেন্ডারটি হাতে নিয়ে ফিরে যায় এক মাস আগের এই দিনে। মুহূর্তেই তার চোখজোড়া জলে চিকচিক করে উঠল। ঈশিতার যমজ বোন পুষ্পিতা। একই ক্লাসে পড়ত তারা। গলায় গলায় ভাব। ম্যাচিং করে পোশাক পরতে পছন্দ করত তারা। একই রকমের জুতা নিয়েও দুজনের খুনসুটি যেন থামতে চাইত না। একটি পারফিউম দুজনের মধ্যে ভাগ করে দেওয়াটা রীতি হয়ে যায়। তাদের দুষ্টমিষ্ট সেই বন্ধনে কেউ ফাটল ধরাতে পারেনি কখনো।
—ঈশা, একটি কথা বল তো।
—পুষ্পিতা, কী বল।
—আচ্ছা আমি কি দেখতে ভীষণ রকমের মোটা? খুবই বিশ্রী?
পুষ্পিতার মুখ থেকে এমন প্রশ্ন শুনে অবাক তাকিয়ে রইল ঈশিতা। পুষ্পিতাকে একটু খোঁচা দিয়ে বলল, ‘তুই দেখতে একটু মোটা। তবে অতটা বিশ্রীও নয়।’ ঈশিতার মুখ থেকে কথাটি শুনে পুষ্পিতা বলল, ‘মায়ের পেটের বোন হয়েও তুই শেষ পর্যন্ত এমন করে বলতে পারলি আমাকে। এইভাবে অপমান করতে পারলি। তোর সঙ্গে আর কোনো কথাই বলব না।’ বলেই পুষ্পিতা মুখ ভার করে রাখল। ঈশিতা পরক্ষণে পুষ্পিতাকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘তুই দেখতে প্রিন্সেসের মতো। কে বলল আমার বোনটি দেখতে বিশ্রী!’ পুষ্পিতা স্মিথ হেসে বলল,
—জানিস ঈশা আমার বান্ধবীরা আমাকে মোটা বলে উপহাস করে বেড়ায়। আমি নাকি দেখতে খুবই বিশ্রী।
 —ওরা বললে বলুক, তুই ওসবে কান দিস না।

বোনের এমন কথা পুষ্পিতার মন গলাতে পারল বলে মনে হয় না। ইতিমধ্যে পুষ্পিতা তার ওজন পরখ করে দেখল ৯৫ কেজি ছাড়িয়ে গেছে। ওজন কীভাবে কমানো যায়, ওই চিন্তা তার কাছে প্রাধান্য হয়ে উঠল। ধীরে ধীরে সবকিছু থেকেও নিজেকে গুটিয়ে রাখতে শুরু করে। দিন-রাত কেবল নিজের গড়ন কীভাবে পরিবর্তন করা যায়, সেটা ভাবতে থাকে। মনে মনে জেদ ধরল যেভাবেই হোক ওজন ৫০ কেজির আশপাশে নামিয়ে আনবে। স্লিম হয়ে বান্ধবীদের দেখিয়ে দেবে সে কতটা স্মার্ট।
শুরুতেই পুষ্পিতা তিন বেলার খাবার দুই বেলায় নামিয়ে আনল। ধীরে ধীরে প্রিয় খাবারগুলো থেকেও মুখ ফিরিয়ে নিতে লাগল। এভাবে পরিবারের অগোচরে খাবারকে অবহেলা করতে করতে একধরনের অনীহা চলে আসে। খাবার দেখলেই কেমন যেন ঘৃণা ঘৃণা অনুভব হওয়া শুরু হয়। যতটুকু খায় বমি করে সব উগরে দেয়। এই কদিনে পুরোপুরি বদলে গেল পুষ্পিতার শরীর। হঠাৎ একদিন দুপুরবেলা সবাই একসঙ্গে খেতে বসে আবিষ্কার করল পুষ্পিতার পরিবর্তনের লক্ষণ। খাওয়ার চেষ্টা করেও পারছে না। আদরের মেয়ের এমন অবস্থা দেখে চমকে ওঠে মা। কয়েক লোকমা ভাত মুখে পুরতেই বমি করে দিল পুষ্পিতা। মাথা ঘুরিয়ে পড়ে যাবে এমন সময় ঈশা ধরে ফেলল।

ঘণ্টা দুয়েক পর পুষ্পিতার জ্ঞান ফেরে। নিজেকে আবিষ্কার করল হাসপাতালের বেডে। মা বসে আছে তার মাথার পাশে। ঈশিতা আর বাবা কী নিয়ে যেন কথা বলছিল। ডাক্তার এসে বাবাকে জানায়, মেয়ে বডি শেমিংয়ের শিকার। সেটা থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য কিটো ডায়েট করতে গিয়ে শরীরে ‘অ্যানোরেক্সিয়া নার্ভোসা’ নামক বড় ধরনের একটা রোগ বেঁধে ফেলেছে। অবস্থা ভালো নয়, বেশি দেরি হয়ে গেছে। বিদেশে চিকিৎসা করালে ভালো হওয়ার সম্ভাবনা আছে। কথাটি শোনার পর সবার কপালে চিন্তার ভাঁজ। এই অসময়ে কী করবে বুঝে উঠতে পারে না পুষ্পিতার বাবা।
ওই দিনই মায়ের কোলে মাথা রেখে হাসপাতালের বেডে ধীরে ধীরে চোখ দুটি বন্ধ হয়ে আসে পুষ্পিতার। ঈশিতা হাত দুটি মুষ্টিবদ্ধ করে রেখেছে। বাবার দিগ্বিদিক ছোটাছুটি আর মায়ের বুকফাটা আহাজারিতে সব ডাক্তাররা ছুটে আসে। পুষ্পিতার মুখে হাসি লেগে আছে। কিন্তু কোনো সাড়াশব্দ নেই। ওজন কমানোরও কোনো তাড়া নেই। বন্ধুদের মিছে অপবাদও শুনতে হবে না।

ঈশিতা শরীরের সব শক্তি একত্র করে ক্যালেন্ডারটা বুকে জড়িয়ে ধরে। ডুকরে কেঁদে উঠলেও মুহূর্তে আবার নিজেকে সংবরণ করে নিল। রুমটির দেয়ালে একটা সদ্য বড় করে বাঁধানো চশমাসমেত হাসিমাখা মুখের ছবি শোভা পাচ্ছে। ঈশিতার কাছে বিষয়টা অবিশ্বাস্য লাগল। ‘না, এটা কোনোভাবে হতে পারে না।’ বলে চিৎকার করলেও তার মুখ দিয়ে কোনো আওয়াজ বের হলো না। হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায়। তাড়াতাড়ি পানির বোতল হাতে নিয়ে ঢকঢক করে পানি পান করল সে। শরীর ঘামছে। অ্যালার্ম ঘড়িটা হাতে নিয়ে দেখে রাত ২টা ৪০। রুমে থাকা ড্রিমলাইটের আবছা আলোয় চোখ ঘুরিয়ে দেখল, তার পাশে স্নিগ্ধ একটি মুখ বালিশে মাথা রেখে নীরবে ঘুমাচ্ছে। জাগিয়ে তুলতে চেয়েও জাগাল না। মাথার ওপর ফ্যানটা ভনভন করে ঘুরছে। অ্যালার্ম ঘড়িটা টিকটিক করে চলছে। রুমের মধ্যে একটা শিহরণজাগানো মৃদু বাতাস বয়ে গেল।