আহমদ ছফার যেকোনো লেখনীতে তাঁর বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা সুস্পষ্টরূপে প্রতীয়মান। কিন্তু ‘পুষ্প, বৃক্ষ এবং বিহঙ্গ পুরাণ’ উপন্যাসের মাধ্যমে তিনি ফুল, পাখি ও গাছ নিয়ে স্বকীয় এক জগৎ সৃষ্টি করেছেন। যে জগতে যেকোনো পাঠক অতি সাবলীলভাবে হারিয়ে যেতে পারেন। তাঁর এই আত্মজীবনীমূলক উপন্যাসটি প্রকাশিত হয় ১৯৯৬ সালে। পুরোপুরি ভিন্ন ধারার এই আত্মজীবনীমূলক উপন্যাসটির কেন্দ্রে বিরাজ করে ফুল, পাখি কিংবা গাছের আটপৌরে গল্প; রয়েছে অসাধারণ সব উপমা। দৃশ্যমান জাদুকরের মতো আহমদ ছফা তাঁর ঢাকাইয়া চাষা হওয়ার গালগপ্প জুড়ে দিয়েছেন বইটিতে।
সে সময়ে চারতলা চিলেকোঠায় ছফা সাহেবের বিচরণ। প্রথমে মৃতপ্রায় নয়নতারা গাছটিকে অদৃশ্য মায়ায় যত্ন দিয়ে বড় করা, এরপর তুলসি পাতা থেকে শুরু করে ফুলের রানি গোলাপ গাছ লাগানোর দারুণ বর্ণনা পাঠককে অতি সূক্ষ্মভাবেই মুগ্ধ করবে। তাঁর ভাষ্যমতে, সব পুষ্পের মধ্যে ঈশ্বর বিরাজ করেন। তিনি লিখেন, ‘আমি যখন তুলসী এবং নয়নতারার ফোটা ফুলগুলো দেখি সেগুলোকে জীবনের দীর্ঘ সংগ্রামলব্ধ বিজয় মুকুটের মতো মনে হয়। তুলসী এবং নয়নতারা ফুল দেখে আমার জীবনের প্রতি আস্থা এবং বিশ্বাস নতুন করে জন্মায়।’
পুষ্প, বৃক্ষ নিয়ে এমন গভীর চিন্তাভাবনা কজন করে বলুন তো? চিলেকোঠার বাগানে শুধুই যে পুষ্প বিরাজ করে তা নয়; বেশ কয়েকটা পাখি আসে ছফা সাহেবের আঙিনায়। তিনিও ভাত ছিটিয়ে সাদরে গ্রহণ করেন সেসব পাখিদের। এক ঝুঁটি শালিকের বর্ণনা আছে বইয়ে। নিয়মিত ভিন্ন রং মেখে গোসল করানো থেকে শুরু করে এ পাখিটির পালিয়ে যাওয়ার নিদারুণ দৃশ্য পাঠকের মনে আঁচ কাটায়। এখান থেকে দার্শনিক ছফা খুঁজে পেয়েছেন জীবনের অনুপ্রেরণা। তিনি লিখেন, ‘একমাত্র অন্যকে মুক্ত করেই মানুষ নিজের মুক্তি অর্জন করতে পারে।’
বৃক্ষের প্রতি অপরিসীম মায়া নিয়ে লেখক থেঁতলে যাওয়া বেগুন চারা পুরোপুরি সতেজ করে তুলেছিলেন একবার। এখান থেকেই ঢাকাইয়া চাষা হওয়ার অনুপ্রেরণা পান আহমদ ছফা। এখান থেকেই প্রভাবিত হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসে বিরাট সবজির বাগান গড়ে তুলেছিলেন। লেখক তাঁর এই সবজির বাগান করার অভিজ্ঞতাকে জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি বলে মনে করেন। লেখক ফুল, পাখি কিংবা গাছ, সঙ্গে কিছু চরিত্র দিয়ে কী অকল্পনীয় মায়ার দৃশ্য এঁকেছেন বইয়ে। ভিন্ন ধারার লেখককে ভিন্ন আঙ্গিকে চেনা যায় বইয়ের মাধ্যমে। তিনি লিখেন, ‘এই পুষ্প, এই বৃক্ষ, তরুলতা, এই বিহঙ্গ আমার জীবন এমন কানায় কানায় ভরিয়ে তুলেছে; আমার মধ্যে কোনো একাকিত্ব, কোনো বিচ্ছিন্নতা আমি অনুভব করতে পারিনে।’
কী অদ্ভুত জাদুর ছোঁয়ায় ব্যক্তি মনের স্মৃতিচারণ ফুটিয়ে তুলেছেন আহমদ ছফা। পুষ্প, বৃক্ষ এবং বিহঙ্গ নিয়ে এত সাবলীল চিন্তাভাবনার এমন বহিঃপ্রকাশ কেবল তিনিই সার্থকভাবে তুলে ধরতে পেরেছেন। তাঁর প্রয়াণ দিবসে অজস্র শ্রদ্ধা।
বন্ধু, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধুসভা