উপলব্ধি

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
এই ঈদে বাড়ির চেয়ারটা ফাঁকা পড়ে আছে উঠানের এক কোনায়। মানুষ সত্যিই পৃথিবীতে আসে চলে যাবার জন্য। থেকে যাবার জন্য মানুষের জন্ম হয়নি।

মসজিদের সামনের সারিতে নিয়মিত নামাজ আদায় করা মুরুব্বিদের অনেকেই আর নেই।

আমার নানাভাইকে কখনো মসজিদের দ্বিতীয় কাতারে নামাজ পড়তে দেখিনি। কিছুদিন আগে উনি চলে গেছেন। খেয়াল করে দেখলাম, নানাভাইয়ের নামাজের জায়গাটায় আরেকজন মুরুব্বি। আমি তাঁকে মামা ডাকি। আরও তিনজনকে এমন মামা ডাকতাম। তাঁদের মধ্যেও দুজন নেই। আছেন একজন। বাকি দুজনের নামাজের জায়গাতেও অন্য মানুষ দাঁড়িয়েছেন। তাঁকেও মামা ডাকি। বয়স সত্তর ছুইঁ ছুঁই।
এগিয়ে গিয়ে বললাম, ‘মামা ভালো আছেন?’ তিনি হাসলেন। বললেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ মামা। আল্লাহ যে হালে রাখেন।’
আলাপচারিতার শেষে বললাম, ‘মামা আসি। ভালো থাকেন।’ আমি ফিরে তাকিয়ে আরেকবার দেখে নিলাম। বেনজির ভাইয়ার কথা মনে পড়ল। ভদ্রলোক সেদিন কথায় কথায় বললেন, ‘আমার যার সঙ্গেই দেখা হয়, তার কাছ থেকে সময় নিয়ে ভালোভাবে বিদায় নিই। যেকোনো দেখাই শেষ দেখা হতে পারে।’

গত কুরবানি ঈদে নানাভাইয়ের সঙ্গে দেখা করে ঢাকায় ফিরেছি। এই ঈদে বাড়ির চেয়ারটা ফাঁকা পড়ে আছে উঠানের এক কোনায়। মানুষ সত্যিই পৃথিবীতে আসে চলে যাবার জন্য। থেকে যাবার জন্য মানুষের জন্ম হয়নি।

ছোটবেলার ঘটনা। যে মাঠে ক্রিকেট, ফুটবল, হা-ডু-ডু, কানামাছি, গুলবারি, বদন খেলতাম—আমাদের বাড়ির উঠানের শেষ প্রান্ত থেকে সেই মাঠ দেখা যেত। আজানের সময় হলেই নানাভাই উঠানের মাথায় এসে হাত তুলে গলা ছেড়ে ডাকতেন, ‘এ খাইরুল। আজান দিবি না?’
শিশুশ্রেণিতে নানাভাইয়ের কাছে প্রশিক্ষণ নিয়ে একবার আজান প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছিলাম। নানাভাই আমাকে খাইরুল বলে ডাকতেন। পৃথিবীর আর কোনো মানুষ আমাকে খাইরুল বলে ডাকলে নানাভাইয়ের মতো শোনায় না ভেবে অবাক হই। ব্যাট-বল ছেড়ে তখন দৌঁড়ে আসতাম মসজিদে আজান দিতে।
আমাকে বলতেন, ‘আগে একবার মসজিদের সামনে থেকে আজান দে। তারপর মাইকে দিস।’ আমিও তাই করতাম৷ খালি গলায় আযান দিলে ভুল হতো না। ভুল হতো ঠিক যখন মাইকে দিতাম। ভুল করে নানাভাইয়ের দিকে তাকাতাম। উনি ইশারা দিয়ে বলতেন, সমস্যা নেই বলতে থাক। আমি আবার গলা ছেড়ে বলতাম।

আজ মাগরিবের নামাজ পড়েছি নানাবাড়ির এলাকায়। দাদুবাড়ির পাশের গ্রামই নানাবাড়ি। মাঝখানে বিস্তৃত ফসলের খেত, একটা গ্রাম আর সবুজের সমারোহ। সম্পূর্ণটুকুজুড়েই আটাশ, উনত্রিশ জাতের ধান। আমি লুঙ্গিটা কিঞ্চিত ওপরে বেঁধে জমিতে নেমে ফসলের গায়ে হাত বুলালাম। কী প্রশান্তি ফসলে! দক্ষিণের ঝিরঝির বাতাস এসে ফসলের গায়ে লাগছে। ওরা হেলেদুলে বলছে, এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি।

জমিতে হাঁটতে হাঁটতে দেখলাম নানাভাইয়ের পুরোনো জমির কিনারায় নানাভাই বসে আছেন। একটা দেশাল গাভি, আরেকটা অস্ট্রেলিয়ান। সদ্য জন্ম নেওয়া বাছুরটা ওর মতো করে লাফালাফি করছে। এ জমি থেকে ও জমিতে দৌঁড়াচ্ছে। চোখ ভিজে এল। চোখ মুছে তাকিয়ে দেখি নানাভাই নেই। শুধু গরুগুলো শক্ত দঁড়িতে বাঁধা।

গরুর দুধে অনীহা ছোটবেলা থেকে। মা জোর করে খাওয়াতে চাইতো। আমি বলতাম, ‘জোর করলে কিন্তু ইচ্ছে করে বমি করে দেব।’ মা বলত, ‘কর বমি। তা–ও খাবি।’ আমাকে খাওয়াত জোর করেই। আমিও খেয়ে গলায় দুটো আঙুল ঢুকিয়ে ইচ্ছে করেই বমি করে দিতাম। সঙ্গে অন্য খাবারও বেরিয়ে যেত। নানিবু জিহ্বায় কামড় দিয়ে বলতেন, ‘আরে আল্লাহ! যা খাওয়াইলি সব বাইর কইরা দিল।’ মাকে তখন নানি শাসন করত। আমি খুশিতে এক দৌঁড়ে পালিয়ে যেতাম।
যে বিকেলে নানাভাই বলতেন, ‘দুধটা খা ভাই। তালিপারে গরু বাঁইধ্যা দিব্যার গেলিপারে তোক লিয়ে যাব।’ বাড়ির গরু-বাছুর আমার খুব পছন্দের ছিল। আমি তখন দুধ খেয়ে নিতাম। সেবার আর বমি করতাম না।

আমার দুটো চুলে পাক ধরেছে। এতদিনে এসে বুঝেছি। বাধ্য হবার জন্য মানুষের জন্ম হয়নি। মানুষের প্রবণতা হলো, এরা বাধ্য করতে চায়। মানুষ পৃথিবীর সবকিছুকেই বাধ্য করতে চায়। সবকিছু বাধ্য হয়ও। শুধু বিপত্তি বাঁধে মানুষ যখন মানুষকে বাধ্য করতে চায়, তখন।

মাগরিবের নামাজ পড়ে জামাতের সামনের সারির মানুষগুলোকে আবার ভালো করে দেখে নিলাম। পরেরবার ফিরে এসে দেখব এদের মধ্যে আরও কয়েকজন নেই। যাঁরা নিয়মিত দ্বিতীয় সারিতে দাঁড়াতেন, তাঁরা সামনের সারিতে গেছেন।

মসজিদে সামনের সারিতে দাঁড়িয়ে নিয়মিত নামাজ পড়া মানুষগুলো নিজেদের অজান্তেই মৃত্যুযাত্রার খুব কাছাকাছি চলে যায়। অবাক হয়ে সামনের সারির মানুষগুলোকে প্রতিবার তাই ভালো করে দেখি।
এরপর মনে মনে বলি, আসি মামা, আসি চাচা, খালুজান আসি। ভালো থাকবেন। আল্লাহ হাফেজ। নানাভাইকেও বলেছিলাম, নানাভাই আসি। নানাভাই বলেছিলেন, আচ্ছা আয়।

বেনজির ভাইয়ার কথা আবার মনে পড়ল। যেকোনো দেখাই শেষ দেখা হতে পারে।

শাহজাদপুর, সিরাজগঞ্জ