রাত অনেক গভীর। হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে যাওয়ায় ঘুম ভেঙে গেল। রুমের চারদিক ঘুটঘুটে অন্ধকার। গরমে শরীর থেকে অনবরত বৃষ্টির ফোঁটার মতো ঘাম ঝরছে। মশার গুনগুন শব্দে কান দুটো ঝালাপালা হয়ে যাচ্ছে। দেয়ালঘড়ির কাঁটা টিক টিক আওয়াজ করে ঘুরছে। অন্ধকারে দৃষ্টি ফেলে সময় অনুমান করার বৃথা চেষ্টা করে যাচ্ছি।
রাত তখন দুইটা হবে। অন্ধকারে দম বন্ধ হয়ে আসছে। নাহ, এ অন্ধকারে থাকা যাচ্ছে না আর। বিছানা ছেড়ে উঠে দরজা খুলে বাইরে বের হলাম। উঠানে পা রাখতেই বিস্মিত হতে হলো। চাঁদের রূপ আজ অপরূপ। যে কারও দৃষ্টি কেড়ে নিতে বাধ্য। উঠানজুরে জোছনার ছড়াছড়ি। তারকারাজি মেঘের সঙ্গে লুকোচুরি খেলছে। চাঁদটা দেখে মনে হচ্ছে, মেঘের ফাঁক দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসছে। চাঁদ আজ মহাখুশি, অভিমানী নয়। কার সঙ্গে যেন মাঝেমধ্যে খুব অভিমান করে মেঘের আড়ালে লুকিয়ে থাকে। রাতের আঁধারেও দেখা মেলে না। চাঁদের অভিমানে আমার মনের অভিমান বেড়ে যায়।
খানিকটা হেঁটে গিয়ে বড় রাস্তার পাশে সবুজ ঘাসের ওপর বসলাম। চারদিক নিবিড় পর্যবেক্ষণ করতে লাগলাম। নাহ, কোথাও কীটপতঙ্গের ছায়াও নেই। কয়েকটি পাতিশিয়াল ছাড়া আর কোনো জন্তুর সাড়াশব্দ নেই। চারপাশ নিস্তব্ধ। সব প্রাণী গভীর ঘুমে বিভোর। কেবল প্রাণহীন ল্যাম্পপোস্টগুলো দাঁড়িয়ে আলো দিচ্ছে। জোছনার আলোয় চারপাশ আলোকিত। খাল–বিলের পানি চাঁদের মৃদু আলোয় ঝলমল করছে। নীল জোনাকিরা জ্বলে জ্বলে আলো ছড়াচ্ছে। মেঘেরা খুশি মনে উড়ে বেড়াচ্ছে। গাছপালা দমকা হাওয়ায় দুলছে। ফসলের মাঠজুড়ে সবুজের কোলাহল। অবাক নয়নে তাকিয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। পরমুহূর্তে মনটা উদাস হয়ে গেল।
এসব ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ চোখ ভিজে এল। আচমকা কবরস্থানের বাঁশ মড়মড় করে ভাঙার শব্দ শুনে দ্রুত উঠে দাঁড়ালাম। ঘরের টিনের চালের ওপর বিকট শব্দে কয়েকটি শুকনা ডাল ভেঙে পড়ল। ল্যাম্পপোস্টের ওখান দিয়ে কী যেন একটা দৌড়ে গেল। চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে, ‘কে ওখানে?’ কিন্তু চিৎকার করতে পারছি না।
ইচ্ছে করছে পুরো রাত এখানে পার করে দিই। বন্ধুরা থাকলে আরও ভালো হতো। বেশ জমিয়ে গল্প করা যেত। মনের জানালা শৈশবে উঁকি দিচ্ছে। মনে পড়ছে হারানো শৈশব, ফেলে আসা দিনগুলো। উদাস নয়নে আকাশের দিকে তাকিয়ে দাদাকে খুঁজছি। শুনেছি যারা দুনিয়া ছেড়ে চলে যায়, তারা নাকি দূর আকাশের তারা হয়ে যায়। দাদা কোন তারা? আকাশে তো অগণিত তারা। পরিচিত কত আপনজন হারিয়ে গেছে। কাকে খুঁজব। আমারও বড্ড ইচ্ছে করছে নীল আকাশের তারা হয়ে যেতে। কতই-না আনন্দ হবে! খোলা আকাশে ঘুরে বেড়াব। মেঘেদের সঙ্গে দৌড়ের পাল্লা খেলব। চাঁদের সঙ্গে জমিয়ে গল্প করে অভিমান মুছে দেব। তখন চাঁদ হাসিমুখে জোছনা ছড়াবে।
এসব ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ চোখ ভিজে এল। আচমকা কবরস্থানের বাঁশ মড়মড় করে ভাঙার শব্দ শুনে দ্রুত উঠে দাঁড়ালাম। ঘরের টিনের চালের ওপর বিকট শব্দে কয়েকটি শুকনা ডাল ভেঙে পড়ল। ল্যাম্পপোস্টের ওখান দিয়ে কী যেন একটা দৌড়ে গেল। চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে, ‘কে ওখানে?’ কিন্তু চিৎকার করতে পারছি না। গলার স্বর ক্ষীণ হয়ে আসছে। ভয়ে ভেতরটা থরথর করে কাঁপছে। সাদা কাপড় পরে কে যেন হেঁটে যাচ্ছে। কে যেন পেছন থেকে নাম ধরে ডাকছে। ‘এই মুশফিক। এই শোন।’ পরে মনে হলো, এসব নিছক মনের ভয়। পেছনে না তাকিয়ে বড় বড় কয়েক কদম বাড়িয়ে বিছানায় এসে শুয়ে পড়লাম। ভয়ের মেঘে হৃদয়ের আকাশ ছেয়ে যেতে যেতে কখন যে ঘুমের রাজ্যে তলিয়ে গেলাম।
সকালে যখন ঘুম ভাঙল, দেখলাম জানালার ফাঁক দিয়ে এক টুকরা আলো এসে মুখে পড়ছে। চোখ মেলে বিছানার পাশের জানালা খুলে দেখি, নতুন ভোরের আলোয় জমিন প্রাণ ফিরে পেয়েছে। গাছপালার সবুজ পাতায় সূর্যের আলো ঝিলিক দিচ্ছে। নতুন আরেকটি রোদমাখা সকাল পেয়ে আনন্দিত হলাম। রাতের কথা ভুলে গেলাম। কেবল মনে আছে চাঁদের অভিমান ভাঙানোর ইচ্ছার কথা।
নলুয়া, বাকেরগঞ্জ, বরিশাল