ব্রিটিশ শাসক-শোষকের বিরুদ্ধে অপরেশন পরিচালনা করতে গিয়ে আক্রান্ত ও আহত হওয়া এবং স্বদেশের তরে পটাসিয়াম সায়ানাইড গ্রহণে আত্মাহুতি। খাকি পোশাক পরা মরদেহ রাস্তায় পড়ে রয়েছিল বেশ কিছু সময়। তখন কেউ বুঝতেই পারেনি এটা কোনো নারীদেহ হতে পারে। আর যখন শনাক্ত হলো এ প্রীতিলতা, তখন তাঁর পরিবারের বাকি সদস্যদের ওপর নেমে এসেছিল নির্মম বর্বোরোচিত অত্যাচার। এক মধ্যবিত্ত বাঙালি বৈদ্য ব্রাহ্মণ পরিবারে অতিসাধারণ কেরানির মেয়ে হয়ে জন্মগ্রহণ করে হৃদয়ে প্রবল দেশপ্রেমের বীজ লালন করে বাংলার প্রথম নারী শহীদ হবার বিস্ময়কর যাত্রা গ্রন্থিত হয়েছে পূর্ণেন্দু দস্তিদারের কলমে ‘বীরকন্যা প্রীতিলতা’ শিরোনামে।
৭২ পৃষ্ঠার বইটি মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় পড়ার পর ঘোর যেন কাটছেই না। প্রীতিলতার সঙ্গে লেখক পূর্ণেন্দু দস্তিদারের সরাসরি পারিবারিক সম্পর্ক ছিল। একই ভিটায় তাঁদের বাস। লেখক নিজেও বৃটিশবিরোধী আন্দোলনে সম্পৃক্ত ছিলেন এবং ইংরেজ সরকারের হাতে বন্দী হয়েছিলেন সে সময়। অন্তর্নিহিত বিষয়গুলো জানেন জন্যই হয়তো এত সুন্দর করে তৎকালীন ঘটনাপ্রবাহ এবং প্রীতিলতার জীবনী সুন্দর-সুক্ষ্মভাবে পাঠকের সামনে উপস্থাপন করতে পেরেছেন।
খাস্তগীর স্কুলে পড়াকালীন হেডপণ্ডিতমশায়ের কাছে ‘আমার জীবনের লক্ষ্য’ লিখতে গিয়ে বড় হয়ে মেয়েদের ভালো করে লেখাপড়া শেখাবার ও তাদের উন্নত করার জন্য তাঁর জীবন উৎসর্গ করবার বাসনা ব্যক্ত করেছিলেন। দরদী শিক্ষক সেই গল্প বাবার কাছে বলার সময় লজ্জায় মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে ছিলেন প্রীতি। তখন কি কেউ জানত, এই মেয়ে ভবিষ্যতে শুধু মেয়েদের নয় সব স্বাধীনতাকামীদের এক আদর্শস্থানীয় বীরকন্যা হিসেবে অমর হয়ে থাকবেন!
স্কুলশিক্ষিকা ঊষাদি প্রীতিকে বেশ স্নেহ করতেন। মেয়েদের উৎসাহ দিতেন পাঠ্যবইয়ের বাইরের বই পড়তে এবং ইতিহাস সম্পর্কে জানতে। অষ্টম শ্রেণিতে পড়াকালীন এ শিক্ষিকাই তাঁকে পড়তে দিয়েছিলেন ‘ঝাসীর রানি লক্ষ্মীবাই’ -এর জীবনীগ্রন্থ। রেল ডাকাতির মামলা এবং সমকালীন বিষয়ে নিয়ে আলোচনাও হতো। তবে প্রীতিলতার বিপ্লবী হওয়ার পেছনে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন সম্পর্কে এক বড় ভাই। বিপ্লবীদের সঙ্গে তাঁর যোগসাজশ ছিল বহু আগে থেকেই। ‘বেঙ্গল অর্ডিনান্সে’ বিভিন্ন নেতৃস্থানীয় বিপ্লবীরা ধরা পড়া শুরু করলে প্রীতিলতার সম্পর্কে ওই বড় ভাইটি নিজ দায়িত্বে থাকা কিছু গোপন বই প্রীতির কাছে রাখতে দেয়। বইগুলো যে সরকারি বাজেয়াপ্ত এবং পুলিশের হাতে ধরা পড়লে বিপদ হতে পারে—এসব কথা প্রীতিকে জানায় না। তবে সাবধান করে দেয় বিষয়টা কাউকে না জানাতে। দ্বিধা ও সংকোচ তাঁর গভীর ঔৎসুক্য আর উৎসাহর কাছে পরাজিত হয়। প্রীতি লুকিয়ে একমাসেই পড়ে ফেলেন বই কটি।
ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে ভারতবর্ষের মাতা-কন্যাদের অভূতপূর্ব ত্যাগের জীবন্ত সব ঘটনাবলীও উঠে এসেছে গ্রন্থটিতে।
ভারতবর্ষে তখনো মেয়েরা যে কিছু করতে পারে, সেটা অবিশ্বাস্য ছিল। যদিও ইংরেজ শোষক ও শাসকদের তাড়াবার জন্য ১৭৫৭-তে রাজশাহীর রানি ভবানী আর তাঁর এক শ বছর পরে রানি লক্ষ্মীবাঈ স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করে ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন। এই বিষয়গুলো প্রীতিকে ভীষণ ভাবায়। কথায় কথায় প্রীতি তাঁর দাদাটিকে বলে, ‘তোমরা সবাই তো আমাকে রানি বলে ডাকো। নাটোর আর ঝাঁসির রানি যা পেরেছিল, চাটগাঁর রানি নিশ্চয়ই তা পারবে।’
ইডেনে পড়াকালীন ‘দীপালী সংঘের’ সদস্য হবার আমন্ত্রণ পায় প্রীতি। এরপর সংযোগ ঘটে প্রধান বিপ্লবী নেতা মাস্টারদা সূর্যসেন, অম্বিকা চক্রবর্তী, নির্মল সেন, গণেশ ঘোষ, অনন্ত সিংহ, লোকনাথ বল প্রমুখ নেতাদের বলয়ের সঙ্গে। নিরাপত্তার স্বার্থে কঠোর গোপনীয়তা রক্ষার্থে সরাসরি নেতাদের সঙ্গে কার্যক্রম এবং কে কে আছেন এই বলয়ে সেসব তথ্যাদি খুব বেশি জানা হতো না কারোরই। অন্যান্য সম্মেলনের সঙ্গে চট্টগ্রামে নারী সম্মেলনের কথা উঠে আসে। চরম আত্মদানের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করার পাশাপাশি চলে কঠোর সংযমের অনুশীলন।
রোজনামচায় একদিন প্রীতিলতা লিখেছেন, ‘কোনপথে আমি জীবনকে ভাসিয়ে দিলাম? এই তো আমার টেবিলের সামনে রাধাকৃষ্ণের ছবি। এই প্রেম স্বর্গীয়। এমনভাবেই মাতৃভূমিকে আমাকে ভালোবাসতে হবে। অন্যকোনো প্রেম ভালোবাসা আমার হৃদয়ে স্থান পাবে না। রাধার মতোই আমার দেশপ্রেম আমি উজাড় করে ঢেলে দেব, নিজেকে নিঃশেষে আমি দান করে যাব।’
ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে ভারতবর্ষের মাতা-কন্যাদের অভূতপূর্ব ত্যাগের জীবন্ত সব ঘটনাবলীও উঠে এসেছে গ্রন্থটিতে। এর মধ্যে সাবিত্রী দেবীর সাহসী কর্মকাণ্ড অন্যতম। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন কত সাবিত্রী দেবী যে অজানা থেকে গেছেন। তাঁদের কথা ভেবেই হয়তো কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন—
‘জগতের যত বড় বড় জয়, বড় বড় অভিযান,
মাতা ভগ্নী ও বধূদের ত্যাগে হইয়াছে মহীয়ান।’
বীরকন্যা প্রীতিলতার সাহসী ও রোমাঞ্চকর জীবনযাত্রার কথা জানতে এবং ভারতবর্ষের তৎকালীন ইতিহাস সম্পর্কে সম্যক ধারণা পেতে পূর্ণেন্দু দস্তিদার রচিত এই বইটি বেশ সহায়ক।
বই সমাচার—
বই: বীরকন্যা প্রীতিলতা
লেখক: পূর্ণেন্দু দস্তিদার
প্রকাশক: মিলন নাথ (অনুপম প্রকাশনী)
প্রকাশ কাল: অনুপম সংস্করণ (ফেব্রুয়ারি ২০০৮)
প্রচ্ছদ: বুলবুল চৌধুরী
মূল্য: ১০০.০০টাকা
পৃষ্ঠা: ৭২
বন্ধু, কুড়িগ্রাম বন্ধুসভা