হরষপুরের সবাই ভাঙাচোরা এই বাড়িকে ‘রাজবাড়ি’ বলেই ডাকে। রাজবাড়ির সামনেই শান্ত একটা নদী। শানবাঁধানো ঘাট। ঘাটে এখন আর কেউ বাসনকোসন মাজে না। রাজবাড়ির সেই রমরমা ভাবটা আর নেই। দেয়াল থেকে খসে পড়ছে ইট, চুনসুরকি ও পলেস্তারা। দারুণ অবহেলায় এই বাড়ির আশপাশে বন-জঙ্গলের রাজত্ব বেড়ে গেছে। গা ছমছমে রহস্যময়তা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বাড়িটি। হরষপুরের সবাই এই বাড়িকে ভূতের বাড়ি বলেই জানে।
বিটুলও এই বাড়িকে ভূতের বাড়ি বলেই এখন জানে। আগে বিশ্বাস করত না। এই বাড়িতে সে এখন নিয়মিত আসা-যাওয়া করে। মামদো ভূতের সঙ্গে তার দারুণ ভাব। অথচ গত বছর এই মামদো ভূতের সঙ্গে কুস্তি হয়েছিল তার। বটতলা থেকে শুরু করে নদীর ঘাটলা পর্যন্ত লড়াই করেছে দুজন। সমানে সমান লড়াই। তারপর থেকেই বিটুলকে মামদো ভূত সমীহ করে চলে।
আজ পৌষসংক্রান্তি। ভূতের বাড়িতে বিশাল আয়োজন। পিঠাপুলি বানানোর ধুম পড়েছে। এপাড়া–ওপাড়া থেকেও ভূতেরা এসেছে। নিজেদের সেরা পোশাক পরে এসেছে সবাই। বিটুলও নতুন পাঞ্জাবি ও পায়জামা পরে এসেছে। বাঁ দিকে সিঁথি কেটেছে। মামদো ভূতের সঙ্গে এক পাশে বসে সে গল্প করছে। ভূতদের গল্প। ভূতের গল্প।
বটতলায় মেছো ভূতটা ঢেঁকিতে চাল ছাঁটছে। ঢেঁকির তালে তালে গান ধরেছে বাঁশঝাড়ের ভূতেরা। শুনতে ভালোই লাগছে। খেয়াঘাটের ভূত বন থেকে শুকনা লাকড়ি নিয়ে এসেছে। মামদো ভূতের পাশে বসতে বসতে খেয়াঘাটের ভূত বলল, ‘পরিবিলের ভূতেরা কাছাকাছি চলে এসেছে, ওস্তাদ। বটতলার ভূতগুলো মোবাইলে জানাল, ঠিক সময়ে তারাও চলে আসবে।’ বিটুল বাঁশঝাড়ের ভূতকে দেখে একটুখানি ভড়কে গেল। কী বিভৎস রে, বাবা! ভয়ংকর রকমের বিশ্রী ভূত! শ্মশানের ভূত চুলায় আগুন দিয়েছে। গমগমে সেই আগুনে তেল ফুটছে। পিঠা হচ্ছে। একে একে সব পিঠা রঙিন হাঁড়িতে রাখা হলো। মামদো ভূতের ডাইনিংয়ে সবাই মিলে একসঙ্গে খাবে। বাকি ভূতেরা চলে আসলেই শুরু হবে হরষপুরের ভূতেদের পিঠা উৎসব।
মামদো ভূত হরষপুরের ভূতদের লিডার। সরাসরি ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত প্রতিনিধি সে। মামদো ভূতের আমন্ত্রণে এই পিঠা উৎসবে বিটুল এসেছে। মামদো ভূতের গেস্ট হিসেবে বিটুলও খুব সমাদর পাচ্ছে। পিঠাপুলির চেয়ে ভূতদের দেখেই সে ভীষণ পুলকিত। ভূতদের সঙ্গে পরিচিত হতে পেরে আরও বেশি আনন্দিত। বুকের পাঁজরগুলো সটান হয়ে গেছে।
সব ভূতের হাজিরা দেখে মামদো ভূত নিজের গোঁফে তা দিচ্ছে। নিশুতি রাতে এই পিঠা উৎসব দারুণ জমে ওঠেছে। বিটুল ও মামদো ভূত এক প্লেটে বসে পিঠাপুলি খাচ্ছে। কী অদ্ভুত স্বাদ! এমন মজার পিঠা বিটুল আগে কখনো খায়নি। চেটেপুটে খাচ্ছে সবাই। বিটুলও আঙুল চাটছে। আচমকা দাদির চিৎকারে ঘরের সবার ঘুম ভেঙে গেল। ‘আহ! আমার আঙুলটা এক্কেবারে শেষ করে দিলি রে! এই জানোয়ার আমার আঙুলে কামড় দিয়ে রক্ত বের কইরা ফেলাইছে।’—বিলাপের সুরে সুরে বিটুলের দাদি বলতে লাগল। বিটুল বুঝতে পারল, ভূতের বাড়ির পিঠার উৎসব নিতান্তই তার একটা স্বপ্ন ছিল!
মাধবপুর, হবিগঞ্জ