একাকী জীবনের তিনটি সত্তার দ্বন্দ্ব ‘থার্ড পার্সন সিঙ্গুলার নাম্বার’

‘থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার’ ছবিতে তিশাছবি: সংগৃহীত

মোস্তফা সরয়ার ফারুকী এমন একজন পরিচালক, যিনি তাঁর ভাবনা-চিন্তা-চেতনায় বাংলাদেশের চলচ্চিত্রজগৎকে সমৃদ্ধ করেছেন। ব্যক্তিমানুষের মুক্তির বা বৃহত্তর অর্থে মানবমুক্তির স্বাধীন চিন্তাচেতনাকে তিনি নিপুণ মুনশিয়ানায় চলচ্চিত্রে ফুটিয়ে তোলেন। সামাজিক, আর্থসামাজিক বা রাষ্ট্রীয় পরিকাঠামোর সীমাবদ্ধ পরিসরে দাঁড়িয়ে ব্যক্তিজীবনে কতটা কী করতে পারেন বা পারেন না, অধিকাংশ মানুষের মতো সবার সঙ্গে মিলেমিশে থাকার জন্য নিজের মুক্তচিন্তার সঙ্গে নিয়মিত আপস করে চলতে হয়, এই আপস করতে গিয়ে অনেক সময় দেখা যায় নিজের মুক্ত ভাবনা বিন্দুমাত্র তল পাচ্ছে না, চিরাচরিত সমষ্টির শৃঙ্খলিত ভাবনা ব্যক্তিসত্তাকেও গিলে ফেলতে চাইছে; পায়ের তলার মাটি হারানোর সেই অস্তিত্ব রক্ষার সংকট বা যন্ত্রণাও নিপুণ বুননে বারবার উঠে আসে তাঁর চলচ্চিত্রে।

থার্ড পার্সন সিঙ্গুলার নাম্বার চলচ্চিত্রে থার্ড পার্সন সিঙ্গুলার নাম্বার হলো আমি বা তুমি নয়, সে। মানে আমি বা তুমি নিজেদের বাইরে এসে তাকে দেখছি। কিন্তু এই ছবির ভেতরে বিচরণ করতে দেখা যায়, আমি বা তুমিও ‘সে ’ হয়ে গেছি। সে একা, আমি বা তুমিও ব্যক্তিগত পরিসরে মুহূর্তের ধাক্কায় অনেক বেশি একা। কখনো না কখনো সময়ের গোলকধাঁধায়, জটিল মুহূর্তে পথ হারিয়ে আমাদের থেমে যেতে হয়।

আবার আজকের অনুন্নত বিশ্বের গতিশীল জীবনে দাঁড়িয়ে থেমে থাকার মতো অবস্থা বা পরিস্থিতিও কারও নেই। চারপাশের সাজানো নীতিনৈতিকতা, দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা, তার মধ্যে দাঁড়িয়ে একজন একলা মেয়ের লড়াই আরও অধিকতর কঠিন। সামাজিক লিঙ্গবৈষম্য এখানে এতটাই প্রকট, একা থেকে প্রতিনিয়ত তাকে অনেক বেশি একা, বাণবিদ্ধ, প্রশ্নবিদ্ধ, বিধ্বস্ত হয়ে যেতে হয়। এই জটিল বিষয়গুলো যুক্তিতর্কের আকারে উঠে আসে চলচ্চিত্রে।

এই ছবির তাই আলাদা করে কোনো গল্প আছে বলা যায় না। দৈনন্দিন জীবনের অনেক ঘটনা মিলেই একটা দাঁড় করানো প্রবাহ। এই ছবির মূল বিষয়বস্তু হলো দ্বন্দ্ব। জীবনধারার প্রতিটি মুহূর্তের দ্বন্দ্ব এবং শুধু নারী নয়, প্রতিটি মানুষের অনবরত লড়তে লড়তে ক্লান্ত হয়ে পড়া, অন্তর্মুখী দ্বন্দ্বের লড়াই।

কেন্দ্রীয় চরিত্র রুবা নামের নারীটিকে পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতিতে একটু বেশি একলা হয়ে যেতে হয়। ছোটবেলা থেকে বেড়ে ওঠা পারিবারিক পরিস্থিতি, গণ্ডি পেরিয়ে এসে প্রেম, বিবাহবহির্ভূত সংসার যাপন মানে লিভ টুগেদার। দুটি নর–নারীর বিবাহ হলেই যে এসব দ্বন্দ্ব–সংঘাত মিটে যেত, তা কিন্তু নয়। পরাধীন বৃত্তে দাঁড়িয়ে স্বাধীন জগৎ বুঝে ওঠা যেমন কঠিন, আবার স্বাধীন জগতে দাঁড়িয়ে যাকে পরাধীন মনে হচ্ছে, তার জীবনের সততা, মূল্যবোধ, ত্যাগ এসব সহজে অনুধাবন করা যায় না। এখানেও প্রশ্ন জেগে ওঠে, এই সততা বা মূল্যবোধের বিষয়টা সহজাত নাকি তোতাপাখির বুলি শেখানোর মতো চাপিয়ে দেওয়া। আবার মানুষমাত্রই বহুগামী, বারবার প্রেমে পড়াও সহজাত একটা বিষয়। সামাজিক অনুশাসন বাধা হয়ে দাঁড়ায় বলেই তা পরকীয়ার রূপ পায়। শিকলবন্দী রুদ্ধশ্বাস জীবনমাত্রই স্বাধীন উন্মুক্ত আলোর গতিপথ খুঁজে বেড়ায়। এই পরকীয়ায়ও পুরুষের অবস্থান যতটা স্বাধীন, নারীর অবস্থান ততটা কঠিন।

রুবা চরিত্রে খুবই ভালো অভিনয় করেছেন নুসরাত ইমরোজ তিশা। তিশার অভিনয়ে রুবার হতাশ, বিষাদগ্রস্ত এবং উৎফুল্ল দুটি রূপই প্রকট হয়ে ধরা দেয়। পরিচালক রুবার শৈশব, তারুণ্য এবং বর্তমান—তিনটি সময়ের সত্তাকে আয়নার সামনে দাঁড়ানোর মতো করে এনে দাঁড় করান। রুবার মধ্যে দ্বৈত সত্তা কাজ করে। একই সময়ে দাঁড়িয়ে সে জীবনের নানা পরিস্থিতির সংকটকালীন সময়কে নিজের ভেতরে জাগ্রত করে, বর্তমানের সঙ্গে অতীতের বিচার করে। বিবেকের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে নিজেকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।

রুবার জীবনে প্রশ্নচিহ্ন হয়ে দাঁড়ায় মায়ের জীবন। মায়ের জীবনে অন্য পুরুষ এসেছে, যাকে সে বাবা বলে মেনে নিতে পারে না। জীবনভর মাকে ঘৃণা করতে করতে নিজের জীবনে এসে একই রকম পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে উত্তর খুঁজে পায় না। আবার নিজের জীবনযন্ত্রণায় ক্ষতবিক্ষত হতে হতে মাকে যখন বুঝে উঠতে পারে, বুঝে উঠতে চায়  মা তখন পৃথিবী ছেড়ে চলে যায়। অন্যদিকে সামাজিক পরিসরে মেয়েদের জীবন এমনই, একলা থাকতে নেই, একলা বাঁচতে নেই, মায়ের কবরে পর্যন্ত যেতে নেই। মাকে নিবেদন করা ফুল অথই দরিয়ায় ব্যথার জলে ভাসিয়ে দিতে হয়। পরিচালক এই দৃশ্যকে স্মরণীয় করে রাখেন।

রুবা ভালোবেসে প্রেমিক বন্ধু মুন্নার সঙ্গে লিভ টুগেদার করে। প্রেমিক বন্ধু জেলে গেলে তার জন্য অনেক অপমান, লাঞ্ছনা, গঞ্জনা সহ্য করেও অধীর অপেক্ষা করতে জানে। প্রেমিক বন্ধুহীন এই দীর্ঘ বিরতিতে একটুকরো আশ্রয় খুঁজতে খুঁজতে অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে। এই বিষণ্ন সময়ে ঝড়ের মতো ঝটিকা সফরে পাশে এসে দাঁড়ায় পুরোনো প্রেমিক বিখ্যাত শিল্পী বন্ধু তপু। অন্য সব পুরুষ নানা কৌশলে একলা নারী রুবার শরীর চায়। তপু কিন্তু প্রতিদান ছাড়াই রুবার জন্য অনেক কিছু করে দেয়। হারানোর প্রেমকে ফিরে পাওয়ার সুপ্ত বাসনা তপুরও থাকে। আবার যৌবনের সহজাত কামনাবর্জিত মানুষ তপু বা রুবা কেউই নয়। তাদের শারীরিক মিলন হওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি করেও, পরিচালক অবদমিত কামনা–বাসনাকে মানসিক অস্থিরতার পরিস্থিতি দিয়ে ঢেকে দেন। তপুর মতো শিল্পীও যে হাজার হাজার শ্রোতা এবং অনুরাগী থাকা সত্ত্বেও একলা একজন মানুষ, সেও নির্জন সাধক এবং রক্ত–মাংসের ভালোবাসার কাঙাল, সেই বিষয়টি স্পষ্ট হয়। তপুর চরিত্রে অভিনয় করেন রাশেদ উদ্দীন আহমেদ তপু।

রুবার স্বামী মুন্নার চরিত্রে অভিনয় করে মাতিয়ে দেন মোশাররফ করিম। মুন্না একই সঙ্গে স্বাধীনচেতা, শান্ত নির্জন প্রেমিক এবং ভীষণ রাগী একজন মানুষ। নিজের ভেতরে ভাঙতে ভাঙতেও সম্পর্ক শেষ করে দেওয়ার মুহূর্ত তৈরি হলেও আবার সময়ের অপেক্ষায় থাকে। কারণ সে জানে, সময় হলো জীবনের সবচেয়ে বড় শিক্ষক। সময় একমাত্র জানে জীবনের সব ক্ষত ধুয়ে মুছে দিতে। আর পরিচালক পুরোনো প্রেম, নতুন প্রেম কাউকে ফেলে দিতে চান না। সবাইকে একসঙ্গে পাশাপাশি রেখে বন্ধুত্বকে শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদা দেন। এভাবেই প্রতিটি একলা মানুষের সঙ্গে একলা মানুষের জীবন বিনিময় হয়। এক নারী রুবা বা তিশা যেন সেই জীবন বিনিময়ের একটা সাঁকো। যে নিজে ঝড়ের পাখি, অথচ তাঁকে আঁকড়ে ধরে অনেকে জীবনের ঝড় কাটিয়ে উঠতে পারে। সমুদ্রসৈকতে রুবার তিন বয়সের তিনটি সত্তা যেমন অর্থবহ হয়ে ওঠে, প্রতিটি একলা মানুষের প্রেম নিয়ে বেঁচে থাকাও বিশাল জলরাশির মতো উদার হয়।

দ্বন্দ্বমূলক এই চলচ্চিত্রে আরও অভিনয় করেছেন অপর্ণা ঘোষ, আবুল হায়াত, শাহির হুদা রুমি, এষা, রাণী সরকার, শুভেচ্ছা হক, শাহীর হুদা রুমি, কামাল হোসেন বাবর, ছবি, তারেক মাহমুদ, ডা. আশীষ চক্রবর্তী, বাপ্পি আশরাফ, মিলন, ডি এইচ খান এবং ডিকন নূর। গোলাম মাওলা নবীরের চিত্রগ্রহণ এবং খালেদ মাহমুদ রাজনের সম্পাদনা অনবদ্য। জিয়া উদ্দিন স্বাধীনের যোগ্য শিল্পনির্দেশনা ছবির ছন্দকে পরিস্ফুটিত করেছে। এই ছবির সংগীতও বিষাদ, নির্জনতা, একাকিত্ব এবং উৎফুল্ল হয়ে জেগে ওঠা সবকিছুকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায়। সংগীতে ছিলেন হাবিব, প্রিন্স মাহমুদ, ফুয়াদ আল মুক্তাদির, তাহসান ও লিমন। কণ্ঠ দিয়েছেন হাবিব, ন্যান্‌সি, লিমন, আনিলা, তপু, তাহসান, মিথিলা, সুমি এবং সুন্দর গানগুলো লিখেছেন কবির বকুল, মারজুক রাসেল ও আশিক।

হাওড়া, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত