বাল্যকালে যখন কেউ ফুটবল খেলা দেখা শুরু করে, সে সময় সমর্থন করার জন্য দল পছন্দ করার ক্ষেত্রে তার নিজস্ব কোনো স্বাধীনতা থাকে না। সাধারণত মা–বাবা যে দলের সমর্থক, সন্তানকেও একই দলের জার্সি কিনে পরিয়ে দেন। অনেকটা পারিবারিকভাবে পাওয়া অধিকারের মতো। এর বাইরে আরেক শ্রেণির আছে, যারা ট্রফি সংখ্যা দেখে দল সমর্থন করে। যদিও ধীরে ধীরে তারা নির্দিষ্ট ওই দলটির খেলার সৌন্দর্যের প্রেমে পড়ে!
ব্রাজিল সমর্থকদের কথাই বলছি। আমি নিজেও একই শ্রেণির। ২০০২ দক্ষিণ কোরিয়া-জাপান বিশ্বকাপে ব্রাজিল রেকর্ড পঞ্চমবারের মতো শিরোপা জিতলেও সেই দৃশ্য দেখার সৌভাগ্য হয়নি। ২০০৪-০৫ সাল থেকে ফুটবল খেলা দেখা শুরু করি। স্পষ্ট মনে আছে, সে সময় এক বড় ভাইকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, কোন দল কয়টা বিশ্বকাপ জিতেছে? জবাবে তিনি জানান, ব্রাজিল ৫টি, ইতালি ও জার্মানি ৩টি (বর্তমানে ৪টি করে), আর্জেন্টিনা ২টি (বর্তমানে ৩টি), উরুগুয়ে ২টি ও ফ্রান্স একটি (বর্তমানে ২টি)। তা ছাড়া তখন সেলেসাওরা ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন ছিল। তাই দ্বিতীয় কোনো চিন্তা না করে দলটির সমর্থন করা শুরু করি। ধীরে ধীরে রোনালদো নাজারিও, রোনালদিনহো, কাকা, রবার্তো কার্লোস, রিভালদোদের চিনেছি। তাঁদের সাম্বা নাচ ও শৈল্পিক ফুটবলে মুগ্ধ হয়েছি।
এরপর রবিনহো, অস্কার, দানি আলভেজ, থিয়াগো সিলভা, কৌতিনহো, নেইমার থেকে শুরু করে বর্তমান প্রজন্মের রিচার্লিসন, ভিনিসিয়ুস জুনিয়র, রদ্রিগো, রাফিনিয়া, অ্যান্টনিরা ব্রাজিলিয়ান মুগ্ধতা ছড়িয়ে যাচ্ছেন। তবে একটা দুঃখ ঠিকই রয়ে গেছে। এখন পর্যন্ত যে হলুদ জার্সিধারীদের হাতে বিশ্বকাপের সোনালি ট্রফি দেখার সৌভাগ্য আমার হয়নি। সর্বশেষ ট্রফি জয়ের পর দুই দশক পার হয়ে গেছে। এর সঙ্গে আরও চার বছর যোগ করলে সংখ্যাটা হয় ২৪!
আরও একটি শঙ্কা রয়েছে। ২০০৬ সাল থেকে সর্বশেষ ২০২২ কাতার বিশ্বকাপে নকআউট পর্বে ইউরোপিয়ান দলের বাধা কোনোভাবেই পাড়ি দিতে পারছে না ব্রাজিল। ২০০৬-এ ফ্রান্স, ২০১০ সালে নেদারল্যান্ডস, ২০১৪-তে জার্মানি, ২০১৮-তে বেলজিয়াম এবং ২০২২ বিশ্বকাপে ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে হেরে টুর্নামেন্ট থেকে বিদায় নিয়েছে পাঁচবারের চ্যাম্পিয়নরা। হেক্সা জয়ের জন্য সমর্থকদের অপেক্ষা কেবল দীর্ঘ হচ্ছে।
অন্যদিকে আর্জেন্টিনা সমর্থকদের অপেক্ষা আরও দীর্ঘ ছিল। একে তো দলটি মাত্র দুটি বিশ্বকাপ জয় করেছে এবং সর্বশেষটি ১৯৮৬ সালে। তারপর থেকে পেরিয়ে গেছে ৩৬ বছর। তবে সমর্থকেরা হাল ছাড়েননি। ব্রাজিলিয়ান সমর্থকদের নানা দুয়োধ্বনি শুনেও নীরবে সয়ে গেছেন। অবশেষে তারা এখন বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন। জার্সিতে দুটি স্টারের জায়গায় তিনটি বসেছে। মাত্র ১৪ মাসের মধ্যে টানা তিনটি আন্তর্জাতিক শিরোপা জয়।
কাতার বিশ্বকাপ শুরু হওয়ার আগে থেকেই মনে শঙ্কা ছিল, কোয়ার্টার ফাইনালের বাধা হয়তো পার হতে পারবে না ব্রাজিল। কারণটা নকআউট পর্বে ইউরোপিয়ান জুজু। তারপরও এবার তিতের স্কোয়াডের গভীরতা দেখে আশায় বুক বেঁধেছিলাম। কিন্তু হলো না। শেষ পর্যন্ত শঙ্কাটাই সত্যি হলো। ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে নির্ধারিত ৯০ মিনিটেও যখন কোনো গোল হলো না, তখন মনে আরও একটি ভয় ঢোকে। আর্জেন্টিনা সমর্থকদের দুয়োধ্বনি যে শুনতে হবে! তাঁদের সামনে মুখ দেখাব কীভাবে! খেলার অতিরিক্ত ৩০ মিনিটের প্রতিটি সেকেন্ড মনে হয়েছে অনেক দীর্ঘ। অতিরিক্ত সময়ের প্রথমার্ধের ঠিক আগমুহূর্তে নেইমারের অসাধারণ গোলের পর শঙ্কা কিছুটা কমলেও দ্বিতীয়ার্ধে ক্রোয়েটদের সমতায় ফেরানো গোলে ভয়টা সত্যি হয়ে যায়।
৯ ডিসেম্বর রাতটি অনেক দীর্ঘ ছিল। মনে হয়েছে, জীবন থেকে খুবই আপন কাউকে হারিয়ে ফেলেছি! সারা রাত ঘুম হয়নি। কথায় আছে, যাকে একবার কেউ ভালোবেসে ফেলে, তাকে ভুলে থাকা যায় না। আর যদি সেটা একপক্ষীয় হয়, তখন বারবার প্রত্যাখ্যান হওয়ার পরও নতুন করে আশার সঞ্চার করতে হয়, চেষ্টা চালিয়ে যেতে হয়। যদি কখনো সফলতা ধরা দেয়! আপাতত ব্রাজিল ফুটবল দলের সঙ্গে ভালোবাসার সম্পর্কটি একপক্ষীয়। কষ্ট পেয়েছি, কিন্তু আশা হারাইনি। অপেক্ষা আরও চার বছরের!