‘মা-বোনের ওপর অত্যাচারের দৃশ্য আজও তাড়িয়ে বেড়ায়’

সাক্ষাৎকার শেষে বীর মুক্তিযোদ্ধা শিবনাথ চক্রবর্তীর সঙ্গে নারায়ণগঞ্জ বন্ধুসভার বন্ধুরাছবি: বন্ধুসভা

একদিকে ওষুধের পরিচিত গন্ধ, অন্যদিকে একাত্তরের জীবন্ত ইতিহাসের অব্যক্ত ব্যথা। নারায়ণগঞ্জ বন্ধুসভার বন্ধুরা গত ২৮ নভেম্বর সন্ধ্যায় শহরের দেশ ফার্মেসিতে হাজির হয়েছিলেন এক ভিন্ন উদ্দেশ্যে। বীর মুক্তিযোদ্ধা শিবনাথ চক্রবর্তীর কাছে স্বাধীনতাযুদ্ধের স্মৃতিচারণা শুনতে। সরাসরি রণাঙ্গনে না থেকেও কীভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এই মানুষ যুদ্ধের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন, সেই অজানা অধ্যায় তুলে ধরতেই বন্ধুসভার এই ব্যতিক্রমী উদ্যোগ।

স্মৃতিচারণার শুরুতে শিবনাথ চক্রবর্তী জানান, তিনি সরাসরি অস্ত্র হাতে যুদ্ধ না করলেও ছিলেন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত একজন মুক্তিযোদ্ধা। যুদ্ধের উত্তাল সময়ে তাঁর দায়িত্ব ছিল মূলত সেবকের। তিনি প্রথমে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পগুলোতে চিকিৎসা ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সেবা দিতেন। পরে কলকাতায় চলে যান এবং সেখানে আশ্রয় নেওয়া অসংখ্য ঘরছাড়া শরণার্থীর পাশে দাঁড়ান।

শিবনাথ চক্রবর্তী বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রতিটি কাজই ছিল একেকটি যুদ্ধের অংশ। ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধাদের সেবাদানের পর কলকাতায় গিয়ে দেখতাম, লক্ষ লক্ষ মানুষ অসহায় অবস্থায় পড়ে আছেন। আমার কাজ ছিল তাঁদের সেবা করা, মনোবল ধরে রাখার জন্য মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তথ্য তাঁদের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া।’ তাঁর কণ্ঠে ছিল সেই দিনগুলোর কঠিন সংগ্রামের ছাপ।

স্মৃতিচারণার এক পর্যায়ে আবেগ ধরে রাখতে পারেননি এই বীর। তিনি যখন শরণার্থীদের ওপর ঘটে যাওয়া পাশবিক নির্যাতনের কথা বলতে শুরু করেন, তখন পরিবেশ ভারী হয়ে ওঠে। চোখের জল মুছতে মুছতে শিবনাথ চক্রবর্তী বলেন, ‘এমনও হয়েছে যে পাকিস্তানি মিলিটারিরা পাশাপাশি মা-মেয়েকে রেখে ধর্ষণ করেছে। লোকলজ্জার ভয়ে তারা বিজয়ের পরও মুখ খুলে পাশবিক অত্যাচারের কথা জানাতে পারেনি। এখন তো খুব সহজেই অ্যাবরশন করানো যায়। কিন্তু তখন বিভিন্ন কারণে এই সুযোগ ছিল না। স্বজন হারানোর যন্ত্রণা, মা-বোনের ওপর অত্যাচারের দৃশ্য আজও আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায়।’

বন্ধুদের মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোনান বীর মুক্তিযোদ্ধা শিবনাথ চক্রবর্তী
ছবি: বন্ধুসভা

মুক্তিযোদ্ধার এমন বুকফাটা বর্ণনা শুনে উপস্থিত বন্ধুদের চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে যায়। পিনপতন নীরবতার মধ্যে সবাই অনুধাবন করেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা শুধু রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ নয়, এটি ছিল মানব ইতিহাসের অন্যতম নিষ্ঠুর এক ট্র্যাজেডি। বন্ধুসভার তরুণেরা জানান, বইয়ের পাতায় পড়া ইতিহাসের চেয়ে এই জীবন্ত অভিজ্ঞতা অনেক বেশি গভীর ও বেদনাদায়ক।

স্মৃতিচারণার গভীরতা ও মনোযোগ দেখে বীর মুক্তিযোদ্ধা শিবনাথ চক্রবর্তী বন্ধুসভার এই উদ্যোগের ভূয়সী প্রশংসা করে বলেন, তরুণ প্রজন্মের মধ্যে ইতিহাস জানার এমন আন্তরিক প্রচেষ্টা সত্যিই আশাব্যঞ্জক। এই ব্যতিক্রমী আয়োজনের মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হয়, বন্ধুসভার সদস্যরা দেশের ঐতিহ্য ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধরে রাখতে নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে।

তবে এই মুক্তিযোদ্ধা হতাশা প্রকাশ করে বলেন, ‘বর্তমানে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে চর্চা হয় না বললেই চলে। বন্ধুসভার উচিত মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক বিভিন্ন কর্মকাণ্ড আরও বেশি হাতে নেওয়া।’

স্মৃতিচারণা শেষে নারায়ণগঞ্জ বন্ধুসভার সভাপতি নয়ন আহমেদ বলেন, ‘শিবনাথ কাকুর এই স্মৃতিচারণা আমাদের শিখিয়ে দিল, শুধু রাইফেল হাতে যুদ্ধ করাই মুক্তি নয়, সাহস করে সেবা দেওয়া বা সঠিক তথ্য প্রচার করাও স্বাধীনতার সংগ্রাম। তাঁর অশ্রুসিক্ত চোখ আমাদের মনে করিয়ে দিল, স্বাধীনতা কত মূল্যবান এবং কত কষ্টের বিনিময়ে অর্জিত।’

ফার্মেসিতে ওষুধের পাশাপাশি ইতিহাস আর আবেগের এমন মিশেল এক নতুন বার্তা দিল—মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে জীবন্ত রাখতে হলে তরুণ প্রজন্মকে অবশ্যই এই বীরদের কাছে পৌঁছাতে হবে। জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের ত্যাগের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে এবং সেই ইতিহাস বুকে ধারণ করার প্রত্যয় নিয়ে এই দিনের সভার সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়।

মুক্তিযুদ্ধ ও গবেষণা সম্পাদক, নারায়ণগঞ্জ বন্ধুসভা