বানভাসিদের ঘরবসতি

নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে জলমগ্ন বসতঘর থেকে ছাগল কোলে নিয়ে বেরিয়ে আসছেন বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলার দুর্গম চরের এক নারীছবি: প্রথম আলো

চারদিকে থই থই পানি, দূরে খড়কুটোর মতো ভেসে আছে ঘরের চাল আর গাছপালা।
সুমিতা বাঁধের ওপর বাঁশের খুঁটিতে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে অনেকক্ষণ, চোখেমুখে অনিশ্চয়তা-বিষাদ। ঘরদোর না থাকায় গেরস্থালির কাজেরও কোনো তাড়া নেই। ছোট্ট চট আর পলিথিনের ছাউনির তলায় রোদ-বৃষ্টিতে মাথা গুঁজে বসে থাকা, ঝিমুনি এলে গুটিসুটি মাদুরে গড়িয়ে নেওয়া, এভাবেই কাটছে এক একটা দিন।
ঘোলা স্রোত বাঁধের গায়ে পাক খেয়ে ছুটে যাচ্ছে স্রোতের টানে। সুমিতা জলের দিকে তাকিয়ে নিজের ভাবনায় ডুবে গেল। কালো মেঘে ছেয়ে আছে আকাশ, গর্জে উঠল হঠাৎ, বৃষ্টি আসবে।

সংবিৎ ফেরে সুমিতার, ঝুপড়িতে পানি নেই। চাতকের মতো আকাশে জল খোঁজে তার চোখ। বৃষ্টির পানি ধরে সে তার পরিবারের তেষ্টা মেটাবে। শুকনা খাবার খেয়ে সারা দিন গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে থাকে। বৃষ্টিতে বিড়ম্বনা বাড়বে, তবু পানি চাই...
সুমিতা ভীষণ ক্লান্ত, মানসিকভাবে বিধ্বস্ত। জীবনের এই অনাকাঙ্ক্ষিত বিপর্যয়ের সমাধান মানুষের সাধ্যের বাইরে। মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় নেই। গড্ডলিকাপ্রবাহে গা ভাসিয়ে চলা শুধু।
পনেরো দিন অতিবাহিত হয়ে গেছে, বাঁধে এসে আশ্রয় নিয়েছে সুমিতাদের মতো বন্যায় নিঃস্ব কিছু পরিবার। গ্রামের অন্যরা কে কোথায় আশ্রয় নিয়েছে, মানবেতর জীবন যাপন করছে, কেউ জানে না।

সুমিতার পরিবার বলতে অসুস্থ স্বামী মুনির আর অন্তঃসত্ত্বা মেয়ে পাপিয়া। প্রথম সন্তান প্রসব, তাই মাসখানেক আগে মায়ের কাছে এসেছে। এ মাসেই জন্মাবে শিশু, হঠাৎ এমন বন্যায় তলিয়ে যাবে গাঁ, ভাবেনি কেউ। ধাপে ধাপে বাড়ছে পানি, কমার লক্ষণ নেই। শহর, গ্রাম—সব পানিতে সয়লাব। গ্রামের দিকে তাকালে বিশাল হাওর বা নদীর মতো মনে হয়। নিরুপায় সব মানুষ, যৎসামান্য সম্বল হাতে নিয়ে জীবন বাঁচানোর তাগিদে বাঁধে এসে উঠেছে।
সুমিতা তাকিয়ে রইল দূরে...যেখানে তাদের বাড়ি ছিল! সেখানে পানি ছাড়া কিছু নেই, গাছগাছালি কিছু দেখা যায় ঝুঁকে আছে পানিতে। পাখিদের ক্ষুধার্ত কিচিরমিচির এখান থেকেও শোনা যাচ্ছে, শেষ আশ্রয় ডুবে থাকা গাছের শূন্য ডাল।
প্রতিদিন লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে পানি, আর রোগবালাইয়ের সঙ্গে প্রচুর বৃষ্টি তো আছেই। অন্তঃসত্ত্বা মেয়েকে নিয়ে ভিজে-পুড়ে বাড়িতেই ছিল সুমিতারা। কিন্তু পশ্চিমের গ্রামরক্ষা বাঁধে ফাটল ধরেছে শুনে ভয়ে কলিজা শুকিয়ে গেল। এমনিতেই বাড়ির উঠানে কোমরপানি, বাঁধ ধসে গেলে রক্ষা নেই। প্রয়োজনীয় জিনিস সঙ্গে নিয়ে এই বাঁধে এসে আশ্রয় নিল। পরের দিন মধ্যরাতে বাঁধ ধসে পড়ার শব্দ, বিপুল পানির তোড় ভাসিয়ে নিল মুহূর্তে সব। ভয়ার্ত সেই কলকল শব্দ রাতের আঁধার কাঁপিয়ে দিল। দেখতে দেখতে তলিয়ে গেল সব। সারা রাত সুমিতা ঘুমাতে পারল না। সকালে দেখল বাঁধ ছুঁই ছুঁই পানি, এ যেন পানির রাজ্য, ভাগ্যিস অসুস্থ স্বামী, মেয়ে, গরু আর পোষা বিড়ালটি নিয়ে আগেই বাঁধে এসে উঠেছিল! না হলে কি হতো, ভাবতেই ভয়ে আঁতকে ওঠে সে।

যুগে যুগে সাহসী মানুষ প্রকৃতির বিরূপতার বিরুদ্ধে লড়াই করে টিকে আছে আজও। তুমুল স্রোতে ভেসে গেছে স্বজন, গৃহপালিত পশুপাখি। শোকের পাথর বুকে চেপে বেঁচে থাকার লড়াই যেন থামে না।
পানিবন্দী অধিকাংশ মানুষ ক্ষুধা, তৃষ্ণায় ধুঁকছে। পানীয় জলের অভাব প্রকট। সুপেয় পানির উৎস সব তলিয়ে গেছে। আবর্জনা, মৃত পশুপাখির দেহ ভাসছে বন্যার জমা পানিতে। আশার প্রহর গুনছে অসহায় মানুষ, যদি কোনো উদ্ধারকারী নৌকা বা ট্রলার আসে! তবে নিরাপদ কোনো আশ্রয়ে পৌঁছাতে পারবে।
অনেক আশা করে সুমিতা গরু পালন করেছে। অভাবের সংসার, ইচ্ছা ছিল গরু বিক্রি করে মুনিরের চিকিৎসা করাবে। হঠাৎ দুর্যোগে নাজেহাল অবস্থা, আল্লাহ ভরসা ছাড়া কোনো উপায় নেই। কত কিছু ভাবছে সে।
ঘরে শুকনা চিড়েমুড়ি আর অল্প বিশুদ্ধ পানি ছাড়া কিছু নেই। রিলিফের আশায় হাপিত্যেশ করে সারা দিন অপেক্ষা। পেটে ভাত নেই। মনে হয় কত দিন ভাতের সঙ্গে দেখা নেই। অসুস্থ স্বামী, অন্তঃসত্ত্বা মেয়ের মুখে এক গ্রাস ভাত তুলে দেবে, সে সামর্থ্য কোথায়...কোথায় পাবে ভাত!

শুনেছে আজ রিলিফে রান্না করা ভাত দেবে। এত মানুষের চাপ ঠেলে ভাতের কাছে পৌঁছানো এক যুদ্ধ, তবু একমুঠো ভাত চাই-ই চাই...
গরুটা খিদেয় হাম্বা রবে জোরে চিৎকার করছে। রূঢ় বাস্তবতার পাকে সুমিতা সচকিত হয়ে ওঠে দিশেহারা। কাল জামাই আসবে মেয়েকে নিয়ে যেতে, এই বৈরী পরিবেশে সন্তান প্রসব ঝুঁকিপূর্ণ, তাই অন্যত্র নিরাপদ জায়গায় নিয়ে যাবে। সুমিতাদেরও সঙ্গে যেতে বলছে পাপিয়া। কিন্তু এই দুর্দিনে পশু আর রোগাক্রান্ত স্বামীকে নিয়ে তো যাওয়া যায় না। মেয়েকে এই অবস্থায় একা ছাড়তে মন সায় দেয় না, কোনো উপায়ও নেই।
‘মা, মা এদিকে আয়,’
‘কি রে. . ডাকিস কেন?’
‘আব্বার খিদা লাগছে, আমিও যে আর থাকবার পারি না মা, খুব খিদে লাগিছে...।’
সুমিতা থালায় চারটে শুকনা মুড়িচিড়া স্বামী আর মেয়ের সামনে বাড়িয়ে দিল। মাটির গ্লাসে একটু পানি ঢেলে এগিয়ে দিল। চারদিকে এত থই থই পানি, কিন্তু পিপাসায় গলা শুকিয়ে কাঠ, চিড়েমুড়ি চিবুতে চিবুতে জিব খসখসে ব্যথা হয়ে গেছে। বিরস মুখে মুনির বলে, ‘আর কিছু নাই বউ?’

কোথায় কিছু পাবে সে! শেষে খুঁজে পেতে দুটো বিস্কুট হাতে দিল নরম হয়ে গেছে...
বৃষ্টির পানি ধরে যদিও খাচ্ছে কয় দিন, বৃষ্টি নেই। আজ মেঘের ঘটা, বৃষ্টি হবে হয়তো...
দুই দিন এদিকে ত্রাণ সহায়তা আসেনি, তাই খাবারেরও সংকট! মাঝেমধ্যে স্পিডবোট চালিয়ে সুবেশী লোকজন আসে, কী সব লেখালেখি করে, নানা কথা জিজ্ঞাসা করে, ছবি তোলে। কিছু খাবারের প্যাকেট আর পানির বোতল বিলি করে চলে যায়। এভাবে কাটছে পানিবন্দী মানুষের দিনরাত্রি, কবে যে পরিত্রাণ মিলবে, বলতে পারে না কেউ!
মুনির ভীষণ কাশছে, কাশির দমকে বুক ফেটে যাবে যেন, দীর্ঘদিন শ্বাসকষ্টে ভুগছে, ইদানীং বেড়েছে। হাড্ডিসার শরীর পাংশু মুখে গভীর শূন্যতা বিষণ্ন চোখ আশাহীন। সুমিতা এক ঢোঁক পানি খাইয়ে দেয়। বুভুক্ষর তৃষ্ণা তার বুকে অসাড় জীবন, তবু যেন শ্বাস আগলে রাখার প্রাণান্ত চেষ্টা। মরণকে পাশ কাটিয়ে নিরন্তর বেঁচে থাকার এই যে লড়াই, একদিন পরাস্ত হয়, অসীমের ডাক উপেক্ষা করার সাধ্যি কার। জীবন বুঝি এমনই!

কে যেন বাইর থেকে ডাকে, অচেনা পুরুষ কণ্ঠ, ‘কেউ আছেন, একটু বাইরে আসুন।’
সুমিতা ঝুপড়ির চটের পর্দা সামান্য সরিয়ে উঁকি দিল, দেখল গরুর সামনে দুজন লোক দাঁড়িয়ে খুব ভালো করে নিরিখ করছে। দেখেই বিরক্তিতে ভুরু কুঁচকে গেল, তিক্ত গলায় বলল, ‘কিছু কইবেন?’
প্রতিদিন দেখছে কেউ না কেউ এখানে গরু ছাগল কিনতে আসছে।
এই বাঁধে অনেকেই তাদের গৃহপালিত পশু নিয়ে এসেছে, অনেকেই সর্বস্ব হারিয়ে নিঃস্ব, পোষা প্রাণীগুলোই তাদের সম্বল। অসাধু কিছু মানুষ সুযোগসন্ধানী, চোরছ্যাঁচড়ও ওত পেতে আছে। রাতের আঁধারে নৌকায় গরু–ছাগল তুলে নিয়ে যাচ্ছে। নানা অজুহাতে খুব কম দামে কিনতে চায় অসাধু ব্যবসায়ীরা। অনেকে নিরুপায় হয়ে কম মূল্যে বিক্রি করে দিচ্ছে গরু-ছাগল। মানুষের খাবার নেই, পশুর খাদ্য কোথায় পাবে?
সুমিতা কষ্টেশিষ্টে ভেসে যাওয়া ডালপালা আর কচুরিপানা ভেলায় বয়ে আনে, আধপেটা খাইয়ে গরুটাকে কোনোমতে বাঁচিয়ে রেখেছে। হয়তো তাকেও কম মূল্যে গরু বেচে দিতে হবে, স্বামীর চিকিৎসা করাতে পারছে না। আর পারবে কিনা জানে না, অনিশ্চিত সবকিছু...ভিজে ওঠে তার চোখ।
তাকে দেখে লোক দুজন ক্রুর হাসে।
‘বেচবে নাকি গরু, গায়ে তো একদম মাংস নাই হাড্ডিসার। কত দাম চাও?’
‘সত্তর হাজার হলে বেচব’ জোর দিয়ে বলে সুমিতা। ‘তার এক টাকা কমেও না।’
‘কি কইলা, সত্তর হাজার! বিশ হাজারের বেশি না।’
সুমিতা চেঁচিয়ে উঠল, ‘কইলাম না সত্তর হাজার, কথা কানে যায় নাই। চইলা যান এখান থাইকা, আমি গরু বেচমু না। সরেন গরুর সামনে থাইকা।’
ক্ষীণ কণ্ঠে মুনির বলে, ‘রাগ কর ক্যান, মানুষরে কইতে দাও, বিপদ দেখলে সবাই সুযোগ নিবার চায়।’ লোক দুজন সুবিধা করতে না পেরে চলে গেল।

প্রায় প্রতিদিন চলছে বিপদগ্রস্ত মানুষের খাবার আর পানির জন্য আহাজারি। দূরে দেখা গেল বাঁধের দিকেই আসছে একটা বড় নৌকা। বাঁধের গায়ে ভিড়তেই, ভাত এসেছে ভাত এসেছে...হুড়োহুড়ি পড়ে গেল মানুষের মধ্যে, যে যা হাতে পাচ্ছে নিয়ে ছুটছে। ভিড়ের ভেতর একজন চেঁচিয়ে উঠল,
এই ধর ধর ডুবে গেল বাচ্চাটা। ভিড়ের চাপে মায়ের কোলের শিশু পড়ে গেছে পানিতে, কারও কোনো ভ্রুক্ষেপ নাই, সবার শুধু ভাত চাই ভাত...
ক্ষুধার তাড়না মানুষকে আবেগ, অনুভূতি বিবর্জিত করে তোলে, এটাই যেন পানিবন্দী জীবনের বাস্তবতা। প্রতিনিয়ত শোকের কষাঘাতে জর্জরিত, কে কোথায় মারা গেল! বড় কঠিন সময়। মানুষের ভিন্ন ভিন্ন পরিবেশে ভিন্ন ভিন্ন রূপ। কঠিন এই বাস্তবতা।
মুনিরের শরীর ভেঙে পড়েছে, ঠিকমতো ওষুধ নেই, পানীয় জলের অভাব প্রকট হয়ে উঠেছে।
এক সকালে ছোট ডিঙি ভিড়ল, পাপিয়ার স্বামী এসেছে নিতে। সুমিতা অসুস্থ স্বামীকে রেখে যেতে পারবে না। পাপিয়া কান্না করছে, মা-বাবাকে রেখে যেতে কষ্ট হচ্ছে, কিন্তু উপায় নেই। নতুন জীবনের এই আগমন, একটা নতুন লড়াইয়ের সূচনা। যুগে যুগে মানুষের ভেতরে মানুষের আবাদ সৃষ্টির এই সৃজন চিরন্তন। এই যে মৃত্যু, রোগশোক, জরা, তবু চলে জীবন থেকে জীবন সৃষ্টির অনন্ত ধারা। মেয়েটা চলে গেল যত দূর দেখা যায়, সুমিতা তাকিয়ে রইল। চোখের জল মুছে ফিরে এল। বেশ কিছুদিন পর জামাই খবর পাঠিয়েছে, পাপিয়ার পুত্রসন্তান হয়েছে। মা-ছেলে দুজনই ভালো আছে।
সপ্তাহ দুই পর, পানি নেমে গেছে, কিছু নিচু জায়গায় এখনো পানিকাদা আছে। সবাই ফিরতে শুরু করেছে তাদের কাদামাখা গেরস্থালির আঙিনায়।
সুমিতার কাঁধে ছোট পুঁটলি, খালি পায়ে হেঁটে চলেছে সে। আবার জেগে উঠেছে ধসে যাওয়া মাটির ঘরদোর ভিটেমাটি, যত দূর দেখা যায় থকথকে কাদায় ধূসর চরাচর। প্রখর সূর্যতাপ ক্রমে শুষে নিচ্ছে জলীয় আর্দ্রতা, ভ্যপসা আগাছাশূন্য বিরান পলির রাজ্য...
আজ একাই চলেছে সুমিতা, পাপিয়া শ্বশুরবাড়িতে, স্বামী–সন্তান নিয়ে ভালো আছে।
মুনিরের আর চিকিৎসার প্রয়োজন হয়নি। পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে স্রষ্টার শীতল আশ্রয়ে ঠাঁই নিয়েছে, তাকে শান্তি দিয়ো প্রভু। বিড়বিড় করে প্রার্থনা করে সে।

ঈশ্বরদী, পাবনা