পৃথিবী হোক বন্ধুতার

পৃথিবী হোক বন্ধুতারছবি: সংগৃহীত

নয়ন দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়ে। টিউশনির সূত্রে ওর সঙ্গে আমার পরিচয়। এক মাস হলো নয়নকে কেমিস্ট্রি পড়াচ্ছি। ওর কোনো বন্ধু নেই। কোচিং, টিউশন, কলেজ, কম্পিউটার গেমস, সোশ্যাল মিডিয়া আর মাঝেমধ্যে মা–বাবার সঙ্গে কেনাকাটা করা ও ঘুরতে যাওয়ার মধ্যেই তার জীবন।

বন্ধু দিবস পালনে আমার বেশ আগ্রহ আছে। সংখ্যা নিয়ে ঘাঁটতে গিয়ে জেনেছি সংখ্যার মধ্যেও আছে বন্ধুত্ব। ইংরেজিতে বন্ধু সংখ্যাকে Amicable Numbers বলা হয়। কিংবদন্তি অভিনেতা হুমায়ুন ফরীদি এক টিভি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘বন্ধুরা কখনো ছেড়ে যায় না। পৃথিবীর সবাই চলে যাবে…কিন্তু বন্ধু কখনো হারায় না। বন্ধুত্বের কোনো বয়স নেই।’ জীবনের সঙ্গে আষ্টেপিষ্ঠে থাকা এই মানুষগুলোকে নিয়ে ‘বন্ধু দিবসে’ আনন্দ আয়োজন করাকে কর্তব্য মনে করি। যে কারণে দিবসটি কীভাবে উদ্‌যাপন করব, এ নিয়ে কিছুদিন ধরে ভাবছি। এর মধ্যেই নয়নকে একদিন পড়াতে গেলাম। কথায় কথায় ওকে বললাম, ‘নয়ন, কাকিমা বলছিলেন, তোমার কোনো বন্ধু নেই। তুমি কারও সঙ্গে মেশো না ব্যাপারটা কী! বন্ধুরা কি তোমাকে সঙ্গে নেয় না?’ নয়নের কাছ থেকে এমন কিছু শুনব প্রত্যাশা করিনি।

নয়ন বলল, ‘স্যার, কী যে বলেন, আমার বন্ধু আছে তো। আমরা অনলাইনে একসঙ্গে গেম খেলি। বাইরে কে যায়, গরম-ঘাম-গন্ধ অসহ্য। আর বাড়িতে থাকলে মা-বাবাও খুশি হয়। পড়া নিয়ে বেশি প্যারা সহ্য করা লাগে না।’ ব্যথিত হৃদয়ে সাহিত্যিক বিনয় মুখোপাধ্যায়ের কথা মনে পড়ল। তিনি বলেছিলেন, ‘আধুনিক বিজ্ঞান মানুষকে দিয়েছে বেগ, কিন্তু কেড়ে নিয়েছে আবেগ। তাতে আছে গতির আনন্দ, নেই যতির আয়েশ।’ সত্যিই তো! ফুটবল নিয়ে বন্ধুর সঙ্গে মাঠে দৌড়ানোর যে আরাম, এসিঘরে বসে কি তা পাওয়া সম্ভব? আর কাছাকাছি পাশাপাশি না থাকলে, একসঙ্গে পথ না চললে, গায়ের গন্ধ না মাখলে যে বন্ধুত্ব তৈরি হয়, তার ভারই–বা কতখানি?

বছর দশেক আগেও সম্ভবত নয়নের মতো চিন্তাভাবনা কেউ করেনি। নয়নের দাদা অয়নের কথাই ধরা যাক। অয়ন বয়সে নয়নের চেয়ে ১০ বছরের বড়। এলাকার সবাই ওকে খুব স্নেহ করে। ছেলেবেলার বন্ধুদের নিয়ে গড়ে তোলা একটা গ্রুপ আছে ওর। গ্রুপে মোট ১১ জন সদস্য। স্কুলজীবন থেকেই এলাকার উন্নয়নে নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড করে আসছে। এখনো ছুটিতে বাড়ি এলে মাঠে ক্রিকেট, ফুটবল টুর্নামেন্টের আয়োজন করে। এখন তাদের সবাই প্রতিষ্ঠিত। তবে একজনের অবস্থা শুরুতে একটু নাজুক ছিল। তার নাম শামীম (ছদ্মনাম)।

শামীমের গল্পটা মন খারাপের। বিশ্ববিদ্যালয়ের সবুজ ঘাসে পা বিছিয়ে গান, কবিতায় মেতে ওঠার সুযোগ পায়নি। লেখাপড়ার বয়সেই কাঁধে নিতে হয়েছে পরিবারের ভার। বাবাহীন সংসারের হাল ধরতে কখনো বইয়ের দোকান, কখনো মোবাইল সার্ভিসিং সেন্টারে কাজ করেছে। তবু তাকে বন্ধুবৃত্ত থেকে বাদ দেয়নি বাকিরা। সব সময়ই খোঁজখবর নিয়েছে, সঙ্গে রেখেছে। বিশ্ববিদ্যালয়জীবন থেকে প্রতিষ্ঠিত হওয়া পর্যন্ত অয়নদের জার্নিতে শামীম সব সময়ই ছিল। তাকে দূরে ঠেলে দেয়নি কেউ। শামীমও আড়াল হয়ে যায়নি। বন্ধুত্বকে বুকের ভেতর আঁকড়ে রেখেছে প্রত্যেকে। শুধু কি তাই? গত ঈদের ছুটিতে ১০ বন্ধুর টাকায় বাজারে চালু হয়েছে একটি সুপারশপ। পরিচালনার ভার শামীমের কাঁধে। সে–ও এখন প্রতিষ্ঠিত।

সম্পর্কের সৌন্দর্যের চেয়ে মূল্যবান অলংকার কিছু নেই। এমন নিটোল বন্ধুত্ব চোখে পড়লে আনন্দ অনুভব হয়। আবার আফসোস হয় বর্তমান অবস্থার কথা চিন্তা করলে। চারপাশে অসুস্থ প্রতিযোগিতা, স্বার্থপরতা। কেউ একটু এগিয়ে গেলে পিছিয়ে পড়া বন্ধুর হাত ধরা তো দূরে থাক এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে সব সময়। নয়নের মতো শিক্ষার্থীদের কাছে অনলাইন গেমস, জন্মদিনে মাথায় ডিম ফাটানো আর পরীক্ষার হলে প্রশ্নের উত্তর শেয়ার করার মধ্যেই বন্ধুত্ব সীমাবদ্ধ।

সেই ব্যক্তিই পরিপূর্ণ, চোখ বন্ধ করে সবচেয়ে গোপন কথাটি বলে দেওয়ার মতো এবং বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদার মতো, যার একটি বন্ধু আছে। অমিয় কণ্ঠশিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যায় সুরে সুরে বলেছেন, ‘বন্ধু তোমার পথের সাথিকে চিনে নিয়ো, মনের মাঝেতে চিরদিন ডেকে নিয়ো।’ বর্তমান সময়ে একসঙ্গে পথচলা, মিলেমিশে থাকা ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপনের ঘাটতি দৃশ্যমান।

কথায় আছে, তেল ছাড়া যেমন গাড়ি চলে না, তেমনি আবেগ ছাড়া জীবন চলতে পারে না। আবেগের গুরুত্ব না থাকলে, মানুষে মানুষে হৃদ্যতা, বন্ধুত্ব স্থাপিত হবে না। মানবিক বোধশূন্য, ব্যক্তিকেন্দ্রিক, স্বার্থপর মানুষ বেশি তৈরি হবে। হানাহানি, যুদ্ধ সংঘাত অনির্দিষ্টকালের জন্য চলতে থাকবে। তাই শান্তিপূর্ণ পৃথিবী বিনির্মাণে জোর দিতে হবে বন্ধুত্ব নির্মাণের ওপর। কারণ, বন্ধুত্বই শান্তিপূর্ণ পৃথিবী নির্মাণের একমাত্র হাতিয়ার। বন্ধুত্বই পারে সব ব্যবধান ভেঙে দিতে। বন্ধুত্ব পাখির মতো। এ সম্পর্কের কোনো প্রতিবন্ধক নেই। বন্ধুত্বের কাছে ধনী, গরিব, বড়, ছোট সব ব্যবধান লীন হয়ে যায়। তাই বন্ধুত্বের বিকাশ ঘটাতে দ্রুতই আমাদের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের ওপর জোর দিতে হবে। প্রতিবেশীদের নিয়ে ঘরোয়া আয়োজন করতে হবে, নতুন প্রজন্মের হাতে ইন্টারনেট ডিভাইস তুলে দেওয়ার পরিবর্তে বই তুলে দিতে হবে। সৌন্দর্যবর্ধনের চেয়ে মাঠগুলোতে নিয়মিত খেলার আয়োজনের দিকে গুরুত্বারোপ করতে হবে। এতে বন্ধুত্বের বিকাশ হবে, মানুষে মানুষে হৃদ্যতা বাড়বে, মানুষ একে অপরের পাশে দাঁড়াবে, নির্মিত হবে বন্ধুত্বপূর্ণ মানব বসতি। পৃথিবী হবে বন্ধুতার।

সাংগঠনিক সম্পাদক, যশোর বন্ধুসভা