ফুটবলের সমার্থক শব্দ হিসেবে যদি কোনো দেশের নাম বলতে বলা হয়, তাহলে বেশির ভাগ লোক বলবে ব্রাজিলের নাম। ১৯১৪ সাল থেকে আন্তর্জাতিক ফুটবল খেলা দেশটির ইতিহাসও অনেক সমৃদ্ধ। সর্বাধিক পাঁচটি বিশ্বকাপ শিরোপা জয়ের পাশাপাশি বিশ্বের একমাত্র দেশ হিসেবে রয়েছে সব কটি বিশ্বকাপ খেলার ঐতিহ্য। তারা খেলে একমাত্র জয়ের জন্য। হলুদ জার্সিধারী সমর্থকদের কাছে ‘ড্র’ অসম্মানজনক। সেই দল কিনা কাতার বিশ্বকাপের পর থেকে এক বছর ধরে ছন্নছাড়া।
ছয়টি প্রতিযোগিতামূলক ম্যাচ খেলে জয় পেয়েছে মাত্র দুটিতে। তার আগে প্রীতি ম্যাচে মরক্কো ও সেনেগালের মতো দলের কাছে প্রথমবারের মতো পরাজয়ের স্বাদও নিতে হয়েছে। সর্বশেষ ঐতিহাসিক মারাকানায় আর্জেন্টিনার কাছে হার; যা কিনা বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে ঘরের মাঠে ব্রাজিলের ইতিহাসে প্রথমবার পরাজয়। এ পরাজয়ের ফলে দক্ষিণ আমেরিকা অঞ্চলের ২০২৬ বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের পয়েন্ট তালিকায় ৬ নম্বরে নেমে গেছে তারা।
এতটা ছন্নছাড়া ব্রাজিল দল সর্বশেষ কবে দেখা গেছে, তা গবেষণার বিষয়। এমনকি বর্তমান দলটির মধ্যে চিরচেনা জয়ের মানসিকতাও দেখা যাচ্ছে না। এর কারণ কী?
কোচের পরিবর্তন
একটি ফুটবল দলে অধিনায়কের থেকেও কোচের ভূমিকা বেশি। কোচের নেতৃত্বে একটি দল গড়ে ওঠে। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ব্রাজিলের তৎকালীন কোচ তিতে ঘোষণা দিয়েছিলেন, কাতার বিশ্বকাপের পর এ দায়িত্বে তিনি আর থাকবেন না। কোয়ার্টার ফাইনালে ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে পরাজয়ের পরপরই তিনি তাঁর কথা রেখেছেন। দায়িত্ব থেকে তাৎক্ষণিকভাবে সরে দাঁড়ান।
এরপর অন্তর্বর্তীকালীন কোচের দায়িত্ব দেওয়া হয় অনূর্ধ্ব-২০ দলের কোচ রেমন মেনেজেসকে। তাঁর অধীনে মরক্কো ও সেনেগালের বিপক্ষে প্রীতি ম্যাচে পরাজিত হয় ব্রাজিল। পরে দায়িত্ব দেওয়া হয় ফার্নান্দো দিনিজের হাতে। এই কোচের অধীনে বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে ছয় ম্যাচের মধ্যে এখন পর্যন্ত মাত্র দুটিতে জিতেছে সেলেকাওরা। তবে দিনিজকে কিছুদিনের জন্য দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। আগামী বছর কোপা আমেরিকার আগপর্যন্ত তাঁর দায়িত্বে থাকার কথা। এ সময়ের মধ্যে একটি দল গঠন করাও কঠিন।
ব্রাজিলের ফুটবল ফেডারেশন জানিয়েছে, ২০২৪ সালের জুলাইয়ে কোপা আমেরিকার আগে সেলেকাওদের দায়িত্ব নেবেন কার্লো আনচেলত্তি। যদিও রিয়াল মাদ্রিদ কোচের পক্ষ থেকে এখনো কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
আক্রমণভাগের সামঞ্জস্যহীনতা
বিশ্বের সেরা আক্রমণভাগ নিয়েও যে সব সময় সফল হওয়া যায় না, তার অন্যতম বড় উদাহরণ পিএসজিতে মেসি, নেইমার ও এমবাপ্পে ত্রয়ী। ব্রাজিলের বর্তমান দলটির আক্রমণভাগও বিশ্বের অন্যতম সেরা। রয়েছেন নেইমার, ভিনিসিয়ুস জুনিয়র, গার্বিয়েল মার্টিনেল্লি, গার্বিয়েল জেসুস, রদ্রিগো, রাফিনিয়া, রিচার্লিসন ও অ্যান্টনির মতো তারকারা। কিন্তু কেবল মেধাবী ফরোয়ার্ডদের মাঠে নামিয়ে দিয়ে গোল করতে বললে হবে না। ম্যাচ জিততে হলে ট্যাকটিক্যালিও সেরা হতে হবে। পাঁচবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নরা এই জায়গাতে পিছিয়ে রয়েছে।
এখন পর্যন্ত খেলা বাছাইপর্বের ছয় ম্যাচে গোলের সুযোগ সৃষ্টি করা নিয়ে কোনো সমস্যা হয়নি; গোল করা নিয়ে সমস্যা। মাত্র ৮ গোল করতে সক্ষম হয়েছেন তাঁরা, যা নামের সঙ্গে ঠিক মানানসই নয়।
ইনজুরি সমস্যা
সর্বশেষ কাতার বিশ্বকাপে ব্রাজিলের যে দল খেলেছিল, সেই দলের মাত্র তিনজন খেলোয়াড় ২২ নভেম্বর আর্জেন্টিনা ম্যাচে ছিলেন। বাকি সবাই নতুন। অবশ্য দলটা ব্রাজিল বলে এ যুক্তি তাদের ক্ষেত্রে মানায় না। তারপরও সেরা তারকারা ফিট থাকলে হয়তো ফলাফল অন্য রকম হতে পারত।
নেইমার, রাফিনিয়া, ভিনিসিয়ুস জুনিয়র, গার্বিয়েল জেসুস, রিচার্লিসন, মিলিতাও, এডারসেন ও ক্যাসিমিরো ইনজুরির কারণে বেশ কয়েকটি ম্যাচ মিস দিয়েছেন। তাঁরা প্রত্যেকে দলের সেরা তারকা। একেকজন একেক পজিশনে খেলে থাকেন। তাঁরা ফিট থাকলে হয়তো কোচের এত চিন্তা করতে হতো না।
আরও একটি চিন্তার কারণ রয়েছে। নেইমারের অবর্তমানে আক্রমণভাগে যার নেতৃত্ব দেওয়ার কথা, সেই ভিনিসিয়ুস জুনিয়র ইনজুরিতে। আবার হলুদ জার্সিতে তাঁর পারফরম্যান্স নিয়েও চিন্তার কারণ রয়েছে। দুই বছর ধরে রিয়াল মাদ্রিদের সাফল্যের অন্যতম কারিগর এই ফরোয়ার্ড। কিন্তু জাতীয় দলের হয়ে ২৬ ম্যাচ খেলে গোল পেয়েছেন মাত্র তিনটি। সেলেকাওদের সাফল্য পেতে হলে তাঁকে জ্বলে উঠতেই হবে।