সুন্দর দুষ্টু–মিষ্টি প্রেমের গল্প ‘কাজের মেয়ে’

‘কাজের মেয়ে’ চলচ্চিত্রের পোস্টারছবি: সংগৃহীত
অমল বোসের অভিনয় যেমন হাসায় আবার দুঃখও দেয়। আমরা সবাই জানি যে অমল বোসের অভিনয় বেশ হৃদয়গ্রাহী। শাবনূরের সঙ্গে শুধু পরিচালক ফিরোজের জুটি নয়, বাংলাদেশের প্রচুর চলচ্চিত্রে শাবনূরের সঙ্গে অমল বোসের জুটিও চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।

চলচ্চিত্রে কেবল নায়ক-নায়িকার জুটি হয় না। একই নায়ক-নায়িকার অভিনয়ে পরপর যেমন সফল চলচ্চিত্র নির্মিত হয়, সেই জুটির অভিনয়ের প্রভাব তেমন দর্শকমনে স্থায়ী হয়, একসময় চিরস্থায়ী ইতিহাসও হয়ে যায়। একইভাবে সব দিক থেকে সুন্দর একটি চলচ্চিত্রের স্রষ্টা অর্থাৎ পরিচালকের সঙ্গেও নায়ক-নায়িকার জুটি তৈরি হয়। বাংলাদেশের সফল চলচ্চিত্র পরিচালক আজাদী হাসনাত ফিরোজের সঙ্গে চিত্রনায়িকা শাবনূরের জুটি বেঁধে নির্মিত হওয়া পরপর অনেকগুলো চলচ্চিত্র সফল হয়েছে। এগুলো বাণিজ্যিক ধারার হলেও নান্দনিক দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ দর্শকের মনোরঞ্জনের খোরাক জুগিয়েছে।

শাবনূরের প্রথম দিকের চলচ্চিত্রে জ্যেষ্ঠ পরিচালক মতিন রহমানের সহকারী হয়ে কাজ করতেন আজাদী হাসনাত ফিরোজ। চিত্রনায়িকার সঙ্গে সেই যে সহকারী পরিচালকের সুন্দর একটা বোঝাপড়া তৈরি হলো, নিজের প্রথম চলচ্চিত্র নির্মাণ করার সময়ও শাবনূরকেই বেছে নিলেন ফিরোজ। সেই যাত্রাপথ শিল্পোত্তীর্ণ, প্রসারিত হলো। বাংলাদেশের অন্য সব বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালকের পাশে নিজের নির্মাণে কত নম্বর পাবেন বা পেতে পারেন ফিরোজ, সে ধরনের কোনো তুলনায় যাচ্ছি না। কিন্তু কেন জানি না, তাঁর মতো দীর্ঘ যাত্রার চলচ্চিত্রযোদ্ধাকে নিয়ে গুগল এনসাইক্লোপিডিয়ায় এখনো একটা পেজ তৈরি হলো না! বিখ্যাত কারও সম্পর্কে একটা প্রাথমিক ধারণা পেতে হলে আমরা যে এখন এই বিশ্বকোষের সাহায্য নিয়ে থাকি। বাংলাদেশের মানুষের প্রাণে প্রাণে ফিরোজ যে আছেন, তাঁর নির্মিত চলচ্চিত্রগুলোর জনপ্রিয়তা তা প্রমাণ করে।

‘কাজের মেয়ে’ চলচ্চিত্রের কাহিনি আর সংলাপ লিখেছেন কামাল ইউসুফ। গল্পটা একটু উল্টোরীতির; সাধারণত আমরা চলচ্চিত্রে দেখে থাকি, ছেলেরাই মেয়েদের প্রেম নিবেদন করার জন্য উঠেপড়ে লাগে। মেয়েদের পেছনে ঘুরঘুর করে। রকের ভাষায় যাকে বলে মেয়ে পটানো। এই চলচ্চিত্রে ‘নদী’ মানে শাবনূরকেও কলেজের ছেলেবন্ধুরা নানাভাবে প্রেম নিবেদন করতে চায়। ধনী কালোবাজারি ব্যবসায়ী এম আলীর কন্যা নদী কাউকে পাত্তা দেয় না। মন থেকে সে শুধু পেতে চায় কলেজপড়ুয়া অন্য এক বন্ধু ‘সাগর’ মানে রিয়াজকে। সমাজের গণ্যমান্য সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, কবি মঈন চৌধুরীর আত্মভোলা পুত্র সাগর আবার এই দুরন্ত, আধুনিকা, বড়লোকের বেটিকে এড়িয়ে চলে।

শাবনূর চোখেমুখে কথা বলা একজন নায়িকা। কখনো কখনো মুখে যত না সংলাপ বলেন, তার অধিক বলেন চোখের ভাষায়। এই গল্পের নায়িকা নদীও মুখের সংলাপে তুখোড়, চোখের ভাষায় স্রোতস্বিনী। সাগরকে পটানোর জন্য সে উঠেপড়ে লাগে। আবার বাংলা চলচ্চিত্রে এত দিন ধরে আমরা দেখে এসেছি যে নায়ক ভিলেনদের ধরে পেটায়। এই চলচ্চিত্রে নায়িকা দুষ্কৃতিকারীদের দমন করেছে। সেই ১৯৯৯ সালে নির্মিত বাংলা সিনেমায় নায়িকা গুন্ডাদের পিটিয়ে দমন করছে, বেশ সাড়া জাগানো অভিনব বিষয় বটে।

চলচ্চিত্রের শুরুতে আমরা প্রাইভেট কার থেকে নামার সময় সুন্দরী নায়িকার চরণযুগল দেখলাম। আমার মনে আছে, ছোটবেলায় চট্টগ্রাম শহরে ভিসিআরে যখন কলকাতার বাংলা সিনেমা দেখতাম, সমবয়সী এক চলচ্চিত্রবিশেষজ্ঞ বন্ধু আমাকে বলেছিল, ‘সিনেমার শুরুতে যখন নায়কের পা দেখাবে, পায়ে পায়ে নায়ক হেঁটে যাচ্ছে দেখাবে, বুঝবি সেটা হলো ভিক্টর বন্দ্যোপাধ্যায়।’

আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের লেখা চলচ্চিত্রে খাঁটি বাংলাদেশি ঘরানার গানগুলোও হৃদয়ছোঁয়া। রিজিয়া পারভীনের কণ্ঠে ‘এ যে দেখি কচি খোকা, কিছু বোঝে না’, কনকচাঁপার কণ্ঠে ‘দরজা বন্ধ, জানালা বন্ধ’ গান দুটি ভালো লাগে।

এখন যেকোনো বড় শহরে বা শহরাঞ্চলে ঘরের কাজের প্রশিক্ষণ দিয়ে বাড়িতে বিশ্বস্ত কাজের লোক পাঠানোর সংস্থা রয়েছে। তবে নির্ধারিত সময় গাড়ি চালানোর জন্য সংস্থা থেকে চালক পাঠানো বা রোগীর দেখাশোনা করার জন্য আয়া পাঠানো—এসব বহুদিন আগে থেকেই চালু ছিল। ১৯৯৯ সালে নির্মিত একটি বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে প্রশিক্ষণ দিয়ে কাজের লোক পাঠানোর বিষয়টিও চলে এসেছে।

তেমনই একটি সংস্থার মাধ্যমে কাজ শিখে নিয়ে বড়লোকের আদুরে কন্যা নদী, কেবল ভালোবাসার টানে সাগরদের বাড়িতে কাজের মেয়ে সেজে চলে যায়। সাগরের মা–বাবার মন জয় করে নেয়। আবার একসময় ধরাও পড়ে যায়।

সাগরের কবি বাবা কিছুতেই একজন কালোবাজারি ব্যবসায়ীর কন্যার সঙ্গে নিজের পুত্রের বিয়ে দেবে না। কিন্তু নদীর প্রেম আর প্রেমের সততার কাছে সাগরকেও একসময় নত হতে হয়। নদীকে কতভাবে সে এড়িয়ে গেছে, প্রত্যাখ্যান করেছে; নদী তবু ভালোবাসার মানুষের মন পাওয়ার জন্য, হৃদয় জয় করার জন্য অটল, অবিচল ছিল। নাটকীয় দ্বন্দ্ব–সংঘাতের মধ্য দিয়ে সেই সাগরও ভালোবেসে ফেলে নদীকে।

নদীর বাবা নত হয়ে মেয়ের ভালোবাসার আশ্রয় খুঁজতে যায় সাগরের বাবার কাছে এবং প্রত্যাখ্যাত হয়ে ফিরে আসে। নদীর বাবা এম আলীর চরিত্রে অমল বোসের অভিনয় যেমন হাসায় আবার দুঃখও দেয়। আমরা সবাই জানি যে অমল বোসের অভিনয় বেশ হৃদয়গ্রাহী। শাবনূরের সঙ্গে শুধু পরিচালক ফিরোজের জুটি নয়, বাংলাদেশের প্রচুর চলচ্চিত্রে শাবনূরের সঙ্গে অমল বোসের জুটিও চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। নায়কের সঙ্গে শুধু নায়িকার জুটি নয়, নায়িকার সঙ্গে পরিচালকের জুটি নয়, নায়িকার সঙ্গে পার্শ্বচরিত্রের জুটিও যে মানুষের মনে দাগ কাটতে পারে, এই দুজন তা প্রমাণ করে দিয়েছেন। সাগরের বাবা মঈন চৌধুরীর চরিত্রে আরিফুল হক অনন্য। সাগরের মায়ের চরিত্রে শর্মিলী আহমেদও মনে দাগ কাটেন।

নদী আর সাগরের প্রেমের পথে আরেক বিপুল ভয়ংকর বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন স্বনামখ্যাত অভিনেতা ডন। নায়ক, নায়িকা আর পরিবার মিলে সেই দুষ্কৃতিকারীদের দলকেও দমন করে। সাগরের বাবা নদীর বাবাকে বুকে টেনে নেয়। কাজের মেয়ে নদী এবার বউ হয়ে ঘর সামলাতে যাবে সাগরদের বাড়িতে। সুন্দর দুষ্টু–মিষ্টি প্রেমের গল্প ‘কাজের মেয়ে’ বেশ মজারও।

আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের লেখা চলচ্চিত্রে খাঁটি বাংলাদেশি ঘরানার গানগুলোও হৃদয়ছোঁয়া। রিজিয়া পারভীনের কণ্ঠে ‘এ যে দেখি কচি খোকা, কিছু বোঝে না’, কনকচাঁপার কণ্ঠে ‘দরজা বন্ধ, জানালা বন্ধ’ গান দুটি ভালো লাগে। এন্ড্রু কিশোর আর কনকচাঁপার যৌথ কণ্ঠে গানগুলো সুন্দর।

চলচ্চিত্রের শুরুতে অভিনেতা রিয়াজের প্রতি বিশেষ কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন পরিচালক। ‘কাজের মেয়ে’ শাবনূরের চোখ আর মুখের ভাষার কাছে আমাদেরও চিরকাল কৃতজ্ঞ থাকতে হবে। কৃতজ্ঞ থাকতে হবে শাবনূরের মেধা ও সৃষ্টিশীলতার কাছে। এই পৃথিবীর বিপুল কর্মযজ্ঞে আমরা সবাই কাজের ছেলে বা কাজের মেয়ে। তাই কাজের মেয়ে বলে কাউকে যেন কখনো নিকৃষ্ট শ্রেণির মানুষ না ভাবি, ছোট করে না দেখি—এই চলচ্চিত্রের শেষে এটাও প্রতিপাদ্য।

হাওড়া, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত