‘দাগি’ কেবল অপরাধীর তকমা নয়, আত্মদর্শনের আর্তনাদ

‘দাগি’ সিনেমায় আফরান নিশো। প্রযোজনা সংস্থার সৌজন্যে।

দাগি শব্দটি যে শুধু আসামির আগে ব্যবহার করা যায়, তা কিন্তু নয়। বাংলা ভাষায় আসামির আগে বারবার ব্যবহার করা হয়েছে বলে আমাদের মনে সেটা গেঁথে রয়েছে। ভালো-মন্দ সবকিছু নিয়েই জীবন। পৃথিবীর বুকে নিজের ভালো কাজের মাধ্যমে যে কিছু একটা স্পষ্ট দাগ রেখে যেতে পারে, সে–ও একজন দাগি।

‘ভালোবাসা মোরে ভিখারি করেছে/ তোমারে করেছে রানি...’ জগন্ময় মিত্রের কণ্ঠে বাংলা গানের স্বর্ণযুগের সেই কালজয়ী গান, অল্প বয়সে যখন শুনতাম ‘রানি’ শব্দটা কেমন ‘দাগি’, ‘দাগি’ এসে কানে ঠেকত। মনে হতো, ভালোবেসেও তো মানুষ দাগি হয়। ভালোবেসে কত যুগল অমর হয়ে পৃথিবীর বুকে দাগ রেখে গেছে।

আবার দাগি মানে একজন জীবনপোড়া মানুষও বটে। শত আঘাত, ঘটনা-দুর্ঘটনা যাকে কখনো দমাতে পারে না। জীবনপোড়া দাগ অনবরত সামনে এগিয়ে যাওয়ার পথ দেখায়। নিশান মানেও তেমন একটি চিহ্ন বা দাগ। নিশান মানে পুরোনো জীবনে ধ্বস্ত-বিধ্বস্ত হতে হতেও সামনে এগিয়ে যাওয়ার নবজীবনের কেতন।

নিশান চরিত্রে আফরান নিশো প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত দুর্দান্ত অভিনয় করেছেন। নিশোর প্রেমিকা জারিনের চরিত্রে তমা মির্জা অনন্য। ‘সুড়ঙ্গ’ চলচ্চিত্রের পরে দুজনের সফল জুটির রসায়নের বিক্রিয়া ঘটতে শুরু করেছে।

সুপরিচালক শিহাব শাহীন ‘দাগি’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে তেমনই এক নিশানকে সামনে নিয়ে এলেন। অপরাধজগতের কাঁচা খিস্তি নেই, খোলা পোশাকের আইটেম ড্যান্স নেই, রগরগে যৌনতা নেই, মুম্বাইয়ের ছবির মারপিটের কপি–পেস্ট নেই। সপরিবার উপভোগ করার মতো একটি সম্পূর্ণ দেশীয় বাণিজ্যিক ধারার শৈল্পিক নির্ভেজাল চলচ্চিত্র ‘দাগি’।

আমাদের শিকড়ের মধ্যেই তো আছে—দস্যু, ডাকু রত্নাকর বাল্মীকি হয়েছিলেন। মহাকাব্য রচনা করে মহাকালের কেতন উড়িয়েছিলেন। কিন্তু ‘দাগি’ সিনেমার নিশানকে আমরা দেখলাম, সে অন্ধের মতো একজনকে ভালোবেসেছে। দুজনের মধ্যে মন, হৃদয়, শরীর দেওয়া-নেওয়া পর্যন্ত হয়েছে। তেমন মানুষকে হারিয়ে ক্রোধের বসে অনিচ্ছাকৃত একটি অপরাধ করে বসে, ১৪ বছরের সাজা হয়। জেলবন্দী জীবনে ভালো আচার–আচরণের জন্য আট মাসের সাজা মওকুফ হয়ে মুক্তি লাভ করে। মুক্তির সময় জেলার একটি মন্ত্রের মতো শপথবাক্য নিশানের বুকের মধ্যে জাগিয়ে দেয়, ‘আল্লাহর দুনিয়ায় সব সুন্দর। বৃক্ষ সুন্দর, পাতা সুন্দর, আলো সুন্দর, বাতাস সুন্দর, নদী সুন্দর, সাগর সুন্দর—খোদার এই দুনিয়ায় সবই চমৎকার।’ অন্ধকার জীবনের কালো পোশাক ছেড়ে নতুন আলোকিত জীবনে এই সুন্দরের পথ ধরে সে এগিয়ে যেতে চেয়েছিল। পুরোনো অপরাধের জন্য সে অনুতপ্ত। মনে মনে কামনা করেছে, সবাই যেন তাকে ক্ষমা করে দেয়।

ক্ষমা চাওয়া এবং ক্ষমা করে দেওয়াও মহত্ত্ব, মানবিকতার একটি বড় লক্ষণ। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল, নিশানের জন্য আইনের বিচার শেষ হলেও সমাজের বিচার শেষ হয়নি। অপরাধজগতের দাগ লেগে গেছে বলে পারিবারিক জীবনে, সামাজিক জীবনে প্রতিটি পদে পদে সে এখন দাগি। আজকের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম একদিকে যেমন অনেক ভালো কাজ করে চলেছে, অন্যদিকে অপপ্রচার করে কীভাবে একজন মানুষের স্বাভাবিক জীবন নষ্ট করে দিতে পারে, এই চলচ্চিত্রে তা বেশ ভালোভাবে উঠে এসেছে।

অন্যদিকে সীমান্তবর্তী অঞ্চলের চোরাচালান, ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে গোপনে প্রাণঘাতী নেশাদ্রব্য বিনিময়, অল্প বয়সী ছেলেদের বিপথে চালিত করে ড্রাগ ব্যবসায়ীদের কারবার এখানে বড় দৃশ্যপটে উঠে এসেছে। এই বিষয়গুলোকে একেবারে রূপ দেওয়া বা বানানো কোনো সমস্যা বলে আমরা উড়িয়ে দিতে পারি না। নারী পাচারসহ সীমান্তবর্তী অঞ্চলের অপরাধ চক্র বহু বছর ধরে সক্রিয়। হঠাৎ করে ধনী হয়ে ওঠার নেশায় নিশানও সেই চক্রের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। জেলপরবর্তী জীবনেও সেই অন্ধকার জগৎ, অপরাধ চক্র তার পিছু ছাড়ে না।

নিশান চরিত্রে আফরান নিশো প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত দুর্দান্ত অভিনয় করেছেন। নিশোর প্রেমিকা জারিনের চরিত্রে তমা মির্জা অনন্য। ‘সুড়ঙ্গ’ চলচ্চিত্রের পরে দুজনের সফল জুটির রসায়নের বিক্রিয়া ঘটতে শুরু করেছে। প্রতিক্রিয়াস্বরূপ এখন জনমানসে জয়জয়কার। জারিন নিশানের সঙ্গে সহবাস করেছে, নিশান বলপূর্বকও শরীর ছিনিয়ে নিয়েছে। জারিনের প্রথম বিয়ে হলো। কন্যাসন্তানটি সেই বরের নাকি নিশানের, তা নিয়ে দ্বন্দ্ব তৈরি হলো। জারিনকে পুনরায় অপরাধজগতের কুখ্যাত মাস্তানকে বিয়ে করে সন্তান ধারণ করতে হলো। একই নারীকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে বহুগামী হয়ে উঠতে হয়, একাধিক ব্যক্তির সন্তান ধারণ করতে হয়; পরিচালক সেই দৃষ্টান্তটিও চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন।

জারিনের কন্যাসন্তানের চরিত্রে অভিনয় করা শিশুশিল্পীকে ভালো লাগে। লিখন নামের এক বাক্‌প্রতিবন্ধী চরিত্রকে তুলে নিয়ে এসে একপ্রকার নজির সৃষ্টি করলেন পরিচালক শিহাব। এই চরিত্রে অনবদ্য অভিনয় করেছেন সুনেরাহ বিনতে কামাল। কখনো কখনো তাঁকে দেখে একেবারে জাপানি নারী বা পুতুলের মতো মনে হয়েছে। এ ধরনের প্রতিবন্ধী চরিত্র সমাজের সংবেদনশীলতার জন্য চলচ্চিত্রের দর্পণে বারবার উঠে আসা দরকার। অধিকাংশ চলচ্চিত্রে মোড়লের প্রতিবন্ধী সন্তানকে বোবা বা হাবা বানিয়ে একধরনের হাস্যরস সৃষ্টির চেষ্টা চলে। প্রগতিশীল ধারার পরিচালক শিহাব তা করেননি। প্রতিবন্ধীদের মধ্যেও যে ব্যক্তিত্ব থাকে, সুনেরাহ বিনতে কামাল অসাধারণ মুনশিয়ানায় তা ফুটিয়ে তুলেছেন।

বর্ষিয়ান অভিনেতা শহীদুজ্জামান সেলিম নিজের দিক থেকে চোখ ফেরাতে দেননি। যখন যে চলচ্চিত্রে যে চরিত্রে সামনে আসছেন, একেবারে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলছেন। সেই চরিত্রের ভাষা চাটগাঁইয়া হোক, অর্ধচাটগাঁইয়া হোক অথবা হিন্দি বা হিন্দি বাংলার মিশ্রণ—তিনি রপ্ত করে ফেলছেন। নবীনদের কাছে অবশ্যই শিক্ষণীয় হয়ে থাকবেন এই অভিনেতা। রাশেদ মামুন অপুকেও ভালো লাগে। চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য সুন্দর। সংলাপ ও শায়েরি সুন্দর। শেষটা আরও একটু ভালো হতে পারত। গান ভালো লাগে। দৃশ্যধারণ, ক্যামেরার ভাষা, রংবিন্যাস ভালো লাগে। সামগ্রিক বিচারে ঢালিউডের চলচ্চিত্রে দাগ রেখে যাওয়ার মতো একটা চলচ্চিত্র ‘দাগি’। প্রগাঢ় জীবনদর্শনে, নিগূঢ় ভালোবাসায় ফিদা থুড়ি ‘দাগি’ করে দিতে পারে বাংলাদেশের নিশান ওড়ানো এই চলচ্চিত্র।

হাওড়া, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত