একজন লেখকের লেখা পড়ে আমরা মুগ্ধ হই। কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ ইত্যাদি প্রতিটির সৃষ্টির পেছনে কোনো না কোনো উৎস থাকে, যা থেকে এগুলোর সৃষ্টি হয়। তবে বেশির ভাগেরই মূল উৎসের ব্যাপারে আমরা জানি না। দর্শকদের অবশ্য জানার প্রয়োজন হয় না বা বলা যায়, লেখক প্রকৃতির নানা রহস্যের মতো এগুলো গোপন রাখতে চান। এগুলো বাস্তবতার সঙ্গে কাল্পনিক চিন্তা যোগ করে অনেক কিছুর সমন্বয়ে তৈরি হয়।
লেখক হুমায়ূন আহমেদের ব্যক্তিজীবনের নানা ইতিহাস, বাস্তব চিন্তা, সমগ্র জীবনের চিন্তাভাবনা উঠে এসেছে ‘লীলাবতীর মৃত্যু’ উপন্যাসে। বইটিতে নিজস্ব চিন্তাধারা থেকে বাস্তবজীবন মিলে একেকটি লেখা রূপ পেয়েছে নতুন আঙ্গিকে।
বইটিতে হুমায়ূন আহমেদ একসঙ্গে অনেক কিছু তুলে ধরেছেন। গল্প বলার ছলে উঠে এসেছে নানা অভিজ্ঞতা। নাম উল্লেখিত ১৯টি গল্পের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে লেখকের নানা লেখার আড়ালে লুকিয়ে থাকা বাস্তবজীবনের চিত্র। গল্প, উপন্যাসের অনেক সৃষ্টির উৎসও পাওয়া যায় এই গল্পগুলোতে।
লেখকের দ্বিতীয় স্ত্রীর প্রথম সন্তান লীলাবতীর মৃত্যু, যা যথেষ্ট বেদনাদায়ক ছিল। লীলাবতীর নাম রাখার ইচ্ছা ও ইতিহাস জেনে কষ্টগুলো বেড়ে যায় নদীর ধরার মতো। অমরত্ব লাভের আশায় দুনিয়ায় রাজত্ব করা বিখ্যাত প্রভাবশালী ব্যক্তিদের কার্যকলাপের ইতিহাস মনে করিয়ে দেয় বিজ্ঞানের কাছে পরাজিত হওয়ার লড়াই। আত্মা সম্পর্কে বিভিন্ন ধর্ম ও ব্যক্তির বিচার–বিশ্লেষণ প্রভাবিত করে জীবনের নানা ধাপে। মহেশের মহাযাত্রা থেকে ভিন্ন যাত্রাপথের পথিকের খোঁজ মেলে।
লেখকের জীবনে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের হাসপাতালগুলোর কার্যকর্মের নানা দিক ও অভিজ্ঞতায় রচিত হয় এখানের হাসপাতাল অংশে। চ্যালেঞ্জারের হঠাৎ আগমন, অভিনয় করা, দর্শকের মন জয় করা, ব্যক্তিজীবনের নানা কাহিনি, আবার অসুখে হারিয়ে যাওয়া। মানব ও দানবের মধ্যে পার্থক্য করা। নিজের ছোট ভাই আহসান হাবীব সম্পর্কে উন্মাদ কথার পাশাপাশি বিভিন্ন প্রতিভার কথা উল্লেখ করা। বন্ধু সফিকের জীবনভর পরোপকার করার কথা তুলে ধরা। যে বন্ধু রাস্তার অসুস্থ ব্যক্তির চিকিৎসা করা ও সুস্থ করার মাধ্যমে নিজের জীবনের প্রধান আনন্দের উৎস খুঁজে নেয়, যার সংসার চালাতে স্ত্রী হিমশিম খেয়ে যায়, তবু পরোপকার ঠিক রাখে। হয়তো এতেই অনেকের জীবন সার্থক।
নারিকেল মামার বারবার ফাঁসি নেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ, ফাঁসি নেওয়ার কলাকৌশল, ফাঁসির দড়ির উপকারিতা সম্পর্কে জানা, শেষে মামার ফাঁসিবিহীন বিছানায় পড়ে মৃত্যুর মাধ্যমে রচিত হয় এক অন্য গল্প। নতুন শিকড়ের সন্ধানে পুরোনো শিকড় ছেড়ে চলে যাওয়া ভাড়া বাসার ভাড়াটে ব্যক্তিরাই জানে এই নীরব আর্তনাদের কী করুণ চিত্র ফুটে ওঠে চোখের সামনে। মৃত্যুর অপেক্ষা করা মৃত্যুযাত্রীর চিন্তাগুলো অহংকার, ভোগ ও লালসা ত্যাগের শিক্ষা দেয়। বিজয় দিবসের গল্প লিখতে গিয়ে লেখকের মনে পড়ে যায় এক জোড়া লাল জুতার বদলে নিশ্চিত হওয়া বাবার মৃত্যু সম্পর্কে, যা দীর্ঘ সময় নেয় বিশ্বাস করতে।
হোটেল আহমেদিয়ার সেই অসমাপ্ত ভুনা খিচুড়ি রান্না হয়তো আর খাওয়া হবে না একসঙ্গে হলে থাকা বন্ধুদের। তবু মনে থেকে যাবে বিমর্ষ দুপুরের রক্ত হিম করা ঘটনা।
ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক পরিস্থিতি, ছাত্রাবস্থা, মুক্তিযুদ্ধ, সংসার ইত্যাদি জীবনের নানা দিক উঠে এসেছে এসব গল্পে। কোথাও রবীন্দ্রভাবনা, কোথাও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, আবার কোথাও মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করার নানা রোমহর্ষ কাহিনি—অনেক কিছুতেই গল্প চলেছে আপন রূপে।
গল্পেরা পাখা মেলে লেখকের কলমের ছোঁয়ায়। সে পাখায় ভর করে গল্পের ছলে ইতিহাস রচিত হয়, রচিত হয় জীবনের ঘটে যাওয়া নানা দিক, যা সবাই প্রত্যক্ষ না করলেও প্রকৃতি করে তার নিজের তাগিদে। হয়তো এই নিয়ে প্রকৃতির সঙ্গে মানবজীবনের চলাফেরা। কে কখন একা হয়ে যায়, কে কখন বিনা কারণে দুঃখ-কষ্ট, সুখ পায়, তা খুঁজে বের করা কঠিন হয়। তবু গল্পে চলুক গল্পের নিয়মে। বাস্তবতার সঙ্গে কল্পনার মিশ্রণে রচিত হোক ভবিষ্যৎ গল্পের শক্ত ভীত।
একনজরে
বই: লীলাবতীর মৃত্যু
লেখক: হুমায়ূন আহমেদ
প্রকাশনী: অন্যপ্রকাশ
প্রকাশক: মাজহারুল ইসলাম
প্রচ্ছদ: ধ্রুব এষ
প্রথম প্রকাশ: একুশে বইমেলা, ফেব্রুয়ারি ২০১৪
মূল্য: ২০০.০০ টাকা
হাজীপুর, নরসিংদী