বৃষ্টিভেজা মূর্তি

বৃষ্টি শুনলেই বর্ষণমুখর একটি দিনের ছবি ভেসে ওঠেছবি: সাইফুল ইসলাম

টুপটাপ আছড়ে পড়ছে বৃষ্টির ফোঁটা। রাতদুপুরে একপশলা বৃষ্টিতে আধভেজা কংক্রিটের ধূসর শহর ঘুমিয়ে পড়েছে। তুমি রাতজাগা পাখি হয়ে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে জোছনাভাঙা রাতের বৃষ্টির ছোঁয়া স্পর্শ করতে ব্যস্ত। ভালোবাসার শেষ ট্রেন ‘সুবর্ণ এক্সপ্রেসের’ অসমাপ্ত গল্পটি লিখতে বসে ১৪ বছর আগের ২২ জুলাই ফিরে যাওয়া। মনের ক্যানভাসে তোমাদের সৌন্দর্যের রানি শহরের জলছবি আঁকার চেষ্টা করছি। তোমাদের শহরে ফয়’স লেকে আকাশে হেলান দিয়ে পাহাড় ঘুমিয়ে পড়ে। আষাঢ় গগনে পেঁজা তুলো মেঘের ছেঁড়া পালে মেঘবালক-বালিকারা লুকোচুরি খেলে। বর্ষায় পাহাড়ে সবুজ ঘাসে টুপটাপ ঝরে পড়া বৃষ্টির আলিঙ্গনে তোমার শুভ্র পায়ে নূপুরের রিনিঝিনি শব্দ, চাঁদনি পসর রাতে শব্দ কামারের মতো গল্প বুনে যায়। নির্ঘুম রাতে ল্যাম্পপোস্টের আলোতে করমচাগাছের পাতায় বৃষ্টির নাচন মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে উপভোগ করতে করতে তোমার কথা মনে পড়ল। পুরোনো ডায়েরিটা উল্টাতে গিয়ে চোখে পড়ল, কোনো এক বর্ষায় তোমাকে নিয়ে লেখা অণুগল্পটি।

জানো প্রেয়সী, তোমাদের গ্রামে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সারি সারি তালগাছকে ষোড়শী কন্যার মতো লাগছিল। আমরা দুজনে যখন মেঠোপথ ধরে হাঁটছিলাম, দূর্বাঘাসের ওপর রাতে ঝরে পড়া বকুল আর কামিনী ফুলের বিছানা, সদ্য ফোটা কদম ফুলের জমে থাকা বৃষ্টিকণাগুলোকে অপরূপা লাগছিল। তুমি গুনগুন করে আবৃত্তি করলে জীবনানন্দের কবিতা ‘আবার বছর কুড়ি পরে তার সাথে দেখা হয় যদি/ আবার বছর কুড়ি পরে’।

তালগাছের ডালে প্রেমিক বাবুই পাখিরা তাদের সঙ্গিনীর জন্য বাসা বুনতে ব্যস্ত। প্রেমিক বাবুই পাখিটা সন্ধ্যায় টুপ করে জোনাকি পোকা ধরে বাসায় নিয়ে গেল। তুমি বললে, প্রেমিকা বাবুই পাখিকে আকৃষ্ট করার জন্য কত আয়োজন দেখো, এদের কাছ থেকে শিখতে হয় প্রেম! খুব মনে পড়ে মুঠোফোনে তোমাদের বাড়ির পাশে বিলের ধারে জমে থাকা বৃষ্টির পানিতে ব্যাঙ ডাকার শব্দ, নিশিরাতে ঝিঁঝি পোকার গান শোনাতে। কত সন্ধ্যা প্রহর কেটেছে মনে নেই। তোমার গাওয়া সুচরিত চৌধুরীর চাটগাঁইয়া লোকগানটা ‘ঝড় পরেদ্দে লোছা লোছা উজান উডের কৈ, এন বরিষার কালে থাইক্কুম কারে লই আঁই থাইক্কুম কারে লই’ এখনো মনে পড়ে।

বৃষ্টির সময় খালি পায়ে বাড়ির ছাদে ভিজতে তুমি খুব পছন্দ করো। তোমার অধরে জমে থাকা বৃষ্টির ফোঁটাগুলো ছুঁতে ইচ্ছে করে। ইচ্ছে করে তোমার ভেজা চুলের খোঁপায় একগুচ্ছ কদম গুঁজে দিতে। বিকেলে বৃষ্টির পরে আকাশে হঠাৎ রংধনু। তুমি পাশে থাকলে রংধনুর সাত রং দিয়ে তোমায় রাঙিয়ে দিতাম। হোলি উৎসবে যেভাবে তোমায় রাঙিয়ে ছিলাম। বেলি ফুলের মালা তোমার খুব পছন্দ, মনে পড়ে প্রেয়সী? স্কুলবেলায় চুরি করে তোমার ব্যাগে বেলি ফুলের মালা দিয়েছিলাম। ক্লাস ফাঁকি দিয়ে গভীর অরণ্যে বাদলা দিনে ঝুমবৃষ্টিতে ভিজেছিলাম। তোমার পায়ে নূপুর আর কপালে টিপ পরিয়ে দেওয়ার কথা কি মনে আছে? তুমি গুনগুন করে গাইলে ‘আজি ঝরো ঝরো মুখর বাদল দিনে/ জানি নে, জানি নে কিছুতেই কেন যে মন লাগে না।’

স্মৃতির ঝাঁপি থেকে রংধনুর রং দিয়ে লেখা অণুগল্পটি মেঘের খামে তোমাকে পাঠানোর অরণ্যে রোদন করছি। তোমার শহরে কি আজও বৃষ্টি নামে? বড্ড জানতে ইচ্ছে করে। তোমার জানালার পাশে কদমগাছে কি এখনো ফুল ফোটে? তোমার বাড়ির উঠানে পাকুড়গাছে কি ময়না–শালিক–টিয়া পাখিরা কানাকানি করে? ঝুঁটিওয়ালা বুলবুলি প্রেমিক পাখিটা ঠোঁটে ঠোঁট রেখে এখনো কি প্রেম নিবেদন করে? বুলবুলির প্রেম নিবেদনের ডাক আজও আমার কানে ভেসে আসে। পাহাড়ি ঝরনা বেয়ে নিচে পাথরে আছড়ে পড়া শব্দের মতো। তন্দ্রাবিলাসে আধো ঘুম আধো জাগরণ অবস্থায়, হঠাৎ টুংটাং সাইকেলের বেলের শব্দ। হলুদ পোশাক পরিধান করা ডাকহরকরা নারায়ণ এসে বলল, আপনার একটা চিঠি আছে। আষাঢ়স্য ভেজা হলুদ খামের চিঠিটা হাতে নিয়ে তোমার অদৃশ্য ভালোবাসা অনুভব করলাম, ঠিক সে সময় বৃষ্টির ছোঁয়া এসে চুমিয়ে গেল। হঠাৎ লক্ষ করলাম, মেঘের ছেঁড়া পালের তরী থেকে নেমে আসা আবছায়া এক বৃষ্টিভেজা মূর্তি আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল ঝুমবৃষ্টিতে। বৃষ্টিভেজা জীবন্ত মূর্তিটির হাত ধরে গাইতে লাগল, ‘বাদলা দিনে মনে পড়ে ছেলেবেলার গান/ বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর নদে এলো বান/ যদি ডেকে বলি, এসো হাত ধরো/ চলো ভিজি আজ বৃষ্টিতে।’

বন্ধু, চট্টগ্রাম বন্ধুসভা