ঈশা খাঁর বাসগৃহ থেকে বলছি

কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে দৃষ্টিনন্দন পানাম ভবন
ছবি: লেখক

শহরের কলকারখানার ক্ষতিকর শব্দ, দূষিত বায়ু, মানুষের গমগম রবে যখন মন ভীষণ ক্লান্ত, কোনো এক গোধূলিবেলায় সুবিশাল দালানের চূড়ায় উঠে শরীরের সব ভর রেলিংয়ে ঠেলে দিয়ে পশ্চিম আকাশে সূর্যের বাড়ি ফেরা দেখতে দেখতে মনের অজান্তেই আত্মা হাহাকার করে ওঠে; তখন মন বলে ওঠে, ইশ্, যদি এমন একটি জায়গায় কিছুটা সময় কাটানো যেত, যেখানে মাছদের খেলা দেখা যাবে, হাজারো ফুলের গাছ থেকে ফুলের ম–ম গন্ধ এসে নাকে ধাক্কা দেবে, যেখানে হরেক রকমের ফুলের মধু খেতে ভ্রমর এসে ভোঁ ভোঁ করবে! আত্মার এমন নিশ্চিত প্রশান্তি মিলবে রাজধানীর অদূরে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে।

নারায়ণগঞ্জ জেলার সোনারগাঁ লোকশিল্প জাদুঘর, যেখানে প্রকৃতি তার রূপ নিয়ে বসন্তের সাজে রঙিন হয়ে ওঠে। রাজধানীতে সবুজ ঘাসের ওপর খোলা পা এলিয়ে দিয়ে বৃক্ষের ছায়ায় ঝিলের পাড়ে বসে ভরদুপুরে বন্ধুমহলে গালগল্পে মেতে ওঠা কিংবা সামান্য খাবার ভাগবাঁটোয়ারা করে হইহুল্লোড় করে খাওয়ার কথা আপনি ভাবতে পারেন না। কিন্তু সেখানে তার সবই হাতের মুঠোয় পুরে দিয়েছে প্রকৃতি। সৌন্দর্যপিপাসুদের জন্য সবুজে ঢাকা ও গাছের ছায়া আচ্ছাদিত সুবিশাল একটি মাঠ রয়েছে, যেখানে চাইলেই পারেন মনের সুখে বাঁশি বাজাতে, দিগন্তে গলা ছেড়ে গাওয়া যায় গান আর পাখিদের সঙ্গে করা যায় খেলা।

এমন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে ঘিরেই গড়ে উঠেছে সোনারগাঁ লোকশিল্প জাদুঘর। বহুকাল আগে আমাদের গ্রামগঞ্জের নারীরা রাতের বেলায় ধান থেকে চাল আহরণ করে সে চাল থেকেই সকালে গুঁড়া বানিয়ে চুলার পাশে শীতলপাটি বিছিয়ে তাতে হরেক রকমের পিঠাপুলি সাজিয়ে অন্য সবার ঘুম ভাঙাত! এখানে দেখা মেলে সেসব প্রাণবন্ত ও গৌরবোজ্জ্বল দিনের সব চিত্রকর্ম ও দৈনন্দিন কাজে ব্যবহার্য হরেক রকম বস্তু।

লোকশিল্প জাদুঘরে আরও রয়েছে তৎকালীন হিন্দু ভূপতি, রাজাদের দৈনন্দিন কাজে ব্যবহৃত কাঠ, লোহা, পিতল, তামা, দস্তা, রুপার জিনিসপত্র। এগুলো আপনাকে নিয়ে যাবে ৪০০-৫০০ বছর আগে! এখানে দেখবেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের বিভিন্ন কিংবদন্তিতুল্য শিল্পকর্ম। রয়েছে তাঁর দেহের ছোঁয়া লেগে থাকা বিভিন্ন বস্তুতে ভরা গ্যালারি।

মৃত্যুর খপ্পরে জীবন্ত থাকার চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া বিপন্ন এক নগরী পানাম নগরী। লোকশিল্প জাদুঘর থেকে পায়ে হেঁটে যেতে সময় লাগবে ১০-১৫ মিনিট। পথে রাস্তার দুই পাশে দেখা যায় সারি সারি কারুশিল্পের দোকান। এখানকার পণ্যগুলোর বিশেষণ আওড়ানো শক্ত একটি কাজ। পানাম নগরীতে ঢুকলেই আপনার ভেতরে অদ্ভুত একটা অনুভূতি কাজ করবে। ভেতরটা বেশ খাঁ খাঁ করে উঠবে! কাদের এত সুন্দর আয়োজন! তারা আজ কোথায়? ৫২টি ইমারত ৪৫০ বছর ধরে ভাস্বর হয়ে আছে! কিন্তু এখানে বর্তমানে কেউই আর বসবাস করে না। কয়েক হাজার দিন পার হয়েছে, সন্ধ্যাবেলায় ভবনগুলোয় আর আলো জ্বলে না। ভয়ংকর ধরনের সুন্দর এই ভবনগুলোর দেয়ালগুলো যেন একেকটি সৌন্দর্যের আকর! এই দেয়ালের বুকেই বয়ে চলছে একটা যুগ তথা সময়ের গল্প। এখানেই স্বপ্নরা বেঁধেছিল বাসা। ভবনগুলোর সামনে রয়েছে সুন্দর প্রশস্ত বারান্দা; যেখানে বসে হয়তো ভবনওয়ালার অতি আদুরে সুন্দরী মেয়েটি তার সুদীর্ঘ কেশগুলো তেলে ডুবিয়ে রোদ পোহাত অহর্নিশ। বিলেত থেকে আমদানি করা বিশেষ এই তেলের ঘ্রাণে পাগলা ঘোড়া দিয়ে ছুটে যাওয়া ছেলেটি সব শক্তি দিয়ে ঘোড়ার গতি রোধ করে একটুখানি ঘ্রাণ নিতে থামত। চাইলে আপনিও সেই বারান্দায় খানিকটা বসে থেকে সেই দিনগুলোর সঙ্গে মিশে একাকার হয়ে যেতে পারবেন।

এখান থেকে আপনি আপনার সৃষ্টিকর্মের রসদ খুঁজে পাবেন, যা আপনাকে সৃষ্টির কাঁচামাল হিসেবে সাহায্য করবে। ২০ বর্গকিলোমিটারের এই নগরীর সিংহভাগই ধ্বংস হয়ে গেছে আর বাকিটা ধ্বংসের পথে।

ঈশা খাঁর আঙ্গিনা তথা তাঁর পুকুরগুলোয় ময়লার ভাগাড় দেখে আপনার একটি কথা মনে হতেই পারে, ‘ভাইয়ের ধন পরে খায়, তাতে আমার কী আসে যায়।’ বিষয়টা হয়তো অনেকের কাছে এমনই ঠেকেছে!

শিক্ষার্থী, সরকারি তিতুমীর কলেজ