অপরাজেয় কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রণয়ধর্মী জনপ্রিয় উপন্যাস ‘দেবদাস’। উপন্যাসটির কেন্দ্রীয় চরিত্র দেবদাস। তাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয় পার্বতী ও চন্দ্রমুখীর ত্রিভুজধর্মী প্রণয়।
দেবদাস গ্রামের জমিদারপুত্র। দেবদাস ও পার্বতী ছেলেবেলার সাথি। একসঙ্গে খেলাধুলা করা, পাঠশালায় যাওয়া, মান-অভিমান, দুষ্টুমি আর ঝগড়াঝাঁটি করেই কাটে তাদের বাল্যকাল। গড়ে ওঠে বন্ধুত্ব। বন্ধুত্বের বোঝাপড়াটা একপর্যায়ে প্রণয়ে পরিণত হয়।
মা–বাবা দেবদাসকে পড়াশোনার জন্য কলকাতায় পাঠিয়ে দেয়। নিত্যদিনের সঙ্গী পার্বতী গ্রামেই থেকে যায়। দেবদাসের সঙ্গে কাটানো মুহূর্তগুলোকে পুঁজি করে কাটে পার্বতীর দিন আর ভাবে তার দেবদাস হয়তো মিশে গেছে আজ শহরের আলোয়। শিগগিরই বাড়ি না ফেরত পাঠালে সে পালিয়ে আসবে—এমনটাই বলে গিয়েছিল পার্বতীকে। কিন্তু সে কথা দেবদাস রাখতে পারেনি। চিঠির অপেক্ষা আর চিঠি লিখেই পার্বতীর প্রাত্যহিক দিন কাটে।
এমন করে একদিন পার্বতী আবার পাঠশালায় যেতে চাইল, সে–ও পড়াশোনা করতে লাগল। অভ্যাসের পরিবর্তন হলেও স্মৃতিকাতরতা তাকে কখনো ছাড়ে না। গ্রীষ্মের ছুটিতে দেবদাস বাড়ি আসে। দুজনের কথাবার্তাসহ বেশ ভালো সময় কাটে। তবু কোথায় যেন হারিয়ে গেছে তাদের আগেকার দিন! কেউই নেই আগের মতো। দেবদাস বদলে গেছে একটু বেশিই। সবকিছু যেন নতুন রূপে তাদের সামনে ধরা দিয়েছে। আগের সহজতা কেটে গিয়ে এসেছে রহস্যের চেহারা। দুজনের মধ্যেই লজ্জামাখা এক অনুভূতি। একে অপরকে বিস্ময়ের চোখে দূর থেকে দেখে দেবদাস মনে করে, ‘সেই পার্বতী এই পার্বতী হয়েছে!’ পার্বতী মনে করে, ‘সেই দেবদাস এখন দেবদাসবাবু হয়েছে!’
মেয়ে বড় হয়েছে। পার্বতীর বাবা তাকে বিয়ে দেওয়ার জন্য সুপাত্র খুঁজছে। বিয়ের প্রস্তাব অবশ্য প্রথমেই দেবদাসের বাড়িতে দেয়। দেবদাসের মা তাদের চেয়ে নিচু বংশ, বাড়ির কাছে আত্মীয়—ইত্যাদি কারণে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। এদিকে পার্বতী মনেপ্রাণে দেবদাসকে স্বামী হিসেবে গ্রহণ করে ফেলেছে। এমনটাই অভিব্যক্তি জানায় তার বান্ধবী মনোরমার কাছে।
দেবদাস তাকে বিয়ে করবে কি না, এমন প্রশ্নের উত্তর পেতে পার্বতী একদিন দেবদাসের প্রতি তার প্রেমের গাঢ়তা নিয়ে গভীর রাতে সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে ঘরে যায়। দেবদাস চমকে যায়। পার্বতীর বদনাম যাতে না ঘটে, এ জন্যই হয়তো তার এই দুর্ভাবনা। তারপর পার্বতীর উদ্দেশে বলে, ‘পারু, আমাকে ছাড়া কি তোমার উপায় নেই?’ পার্বতীর নীরবতাই বুঝিয়ে দেয় তার উপায়ান্তর।
দেবদাস নিরুপায় হয়ে পার্বতীকে না জানিয়ে কলকাতা চলে যায়। পার্বতীর মুখোমুখি হওয়ার সাহস ছিল না। কলকাতা গিয়ে চিঠিতে জানায়, পারু যেন তাকে ভুলে যায়।
উপন্যাসের এখানেই দেবদাস চরিত্রের দুর্বলতা প্রকাশিত এবং গল্প বিরহের দিকে ধাবিত হয়।
স্বাভাবিকভাবেই চিঠি পেয়ে পার্বতীর হৃদয় ভেঙে যায়। কিন্তু আত্মসম্মান রক্ষার জন্যই তার মধ্যে দেবদাসের জন্য জন্ম নেয় ক্ষোভ। দেবদাস যখন নিজের ভুল বুঝতে পেরে কলকাতা থেকে ফিরে পুকুরপাড়ে পার্বতীর সঙ্গে দেখা করে, তখন সেই ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটে।
পার্বতীর সম্মতিতে হাতীপোতা গ্রামের চল্লিশোর্ধ্ব জমিদার ভুবনমোহন চৌধুরীর সঙ্গে তার বিয়ে সম্পন্ন হয়। আত্মগ্লানি আর বিরহে দেবদাস কলকাতা চলে যায়। আত্মগ্লানি ঘোচাতে বেছে নেয় চুনিলালের সঙ্গ। চুনিলালের সঙ্গে গিয়ে দেখা মেলে চন্দ্রমুখীর।
চন্দ্রমুখী একজন নর্তকী। পুরুষের মনোরঞ্জন করাই তার পেশা। ব্যক্তিত্বে চন্দ্রমুখী ছিল একনিষ্ঠ।
দেবদাস সারা দিন মদ্যপানে ডুবে থাকে। চন্দ্রমুখী বা চুনিলাল তা থেকে বিরত রাখতে পারেনি। দেবদাসের মনে সারাক্ষণ পার্বতী বিরাজ করে। মন থেকে পার্বতীর তীব্রতা ভুলবার জন্য সে মদ্যপায়ী হয়েছে।
এদিকে পার্বতী জমিদারের ঘরসংসার সামলাতে সামলাতে পার করছে নিত্যকার দিন। আস্তে আস্তে তার মধ্যে পরিপক্ব গৃহিণী ভাব আসে।
চন্দ্রমুখীই এখন দেবদাসের নিত্যদিনের সঙ্গী। কিন্তু সজ্ঞানে তার কাছে দেবদাস আসতে পারে না। মাতাল না হলে এখানে সে পা ফেলতে পারে না। দেবদাস দিবারাত্রি মদের নেশায় বুঁদ হয়ে থাকে। একসময় চন্দ্রমুখীকে সহ্য না করলেও আস্তে আস্তে সহ্য করে নেয়। চন্দ্রমুখীও নিঃস্বার্থ বন্ধুর মতো তার সঙ্গ দিয়ে যায়।
চন্দ্রমুখী নিয়তির আবৃতে আস্তে আস্তে দেবদাসের প্রেমে পড়ে। একসময় দেবদাসের মনেও প্রতিনিয়ত পার্বতী ও চন্দ্রমুখীর তুলনা হতে থাকে।
নিয়তি দেবদাসকে এতই উদাসীন করে যে হতাশাগ্রস্ত দেবদাস অত্যধিক মদ্যপান শুরু করলে তার শরীর ক্রমে ভেঙে পড়ে। আসন্ন মৃত্যুর কথা অনুভব করে সে হাতীপোতা গ্রামে পার্বতীকে দেখার জন্য রওনা হয়। শেষরাতে পার্বতীর বাড়ির সামনে পৌঁছায়। শীতের রাত শেষে শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে ভোরের আলোয় দেবদাসের মৃত্যু হয়।
মৃত্যুমুখে কেউ এসে দেবদাসের মাথায় হাত বোলানোর ছিল না। ঔপন্যাসিক সৃষ্ট চরিত্রের মায়ায় জড়িয়ে শেষোক্তিতে লিখেছেন, ‘তোমরা যে-কেহ এ কাহিনী পড়িবে, হয়তো আমাদেরই মতো দুঃখ পাইবে। তবু যদি কখনো দেবদাসের মতো এমন হতভাগ্য, অসংযমী পাপিষ্ঠের সহিত পরিচয় ঘটে, তাহার জন্য একটু প্রার্থনা করিও। প্রার্থনা করিও, আর যাহাই হোক, যেন তাহার মতো এমন করিয়া কাহারও মৃত্যু না ঘটে। মরণে ক্ষতি নাই, কিন্তু সে সময়ে যেন একটি স্নেহ-করস্পর্শ তাহার ললাটে পৌঁছে-যেন একটিও করুণার্দ্র স্নেহময় মুখ দেখিতে দেখিতে এ জীবনের অন্ত হয়। মরিবার সময় যেন কাহারও এক ফোঁটা চোখের জল দেখিয়া সে মরিতে পারে।’
প্রেমের বিচিত্র রহস্য উদ্ঘাটনে শরৎচন্দ্র যথেষ্ট পারদর্শিতা দেখিয়েছেন। দেবদাস-পার্বতীর মধ্য দিয়ে নারী-পুরুষের জীবন ও প্রেমের ভাবরূপ শরৎচন্দ্র যে দক্ষতার সঙ্গে চিত্রিত করেছেন, তা আগেকার কোনো লেখকের মধ্যে হয়তো দেখা যায়নি। এ ধরনের অক্রিয় চরিত্রের প্রতি বাঙালি মনস্তাত্ত্বিক আকর্ষণ চিরকালীন। দেবদাস-পার্বতীর প্রেমের মধ্যে এ কারণেই আমরা নিজ নিজ স্বরূপ প্রত্যক্ষ করি।
একনজরে
বই: দেবদাস
লেখক: শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
ধরন: উপন্যাস
প্রকাশক: নুসরাত প্রকাশনী
প্রকাশকাল: ৩০ জুন ১৯১৭
পৃষ্ঠা: ৬৪
মূল্য: ১০০ টাকা
সহসভাপতি, ময়মনসিংহ বন্ধুসভা