ছোটবেলায় বইতে পড়তাম ‘ঐ–তে ঐরাবত’। বইয়ের কোণে ছোট্ট ঐরাবতের ছবি দেখতাম। বাস্তবে তখনই ঐরাবত দেখার বাসনা জাগে খুব। পাশের বাড়ির কেউ একজন হাতি দেখেছিল। আমাকে বলল, একেকটা কান কুলার মতো। আমি আশ্চর্য হই আর স্থলের সবচেয়ে বড় প্রাণীটিকে দেখার বাসনা জাগে। প্রথম শ্রেণিতে বাবা চিড়িয়াখানায় নিয়ে যান। সেদিন প্রথম হাতি দেখি, আমার স্বপ্ন পূরণ হয়। তখন থেকেই হাতির প্রতি আলাদা ভালো লাগা।
প্রাচীনকালে যুদ্ধে হাতির ব্যবহার হতো। মধ্যযুগেও আমরা হস্তীবাহিনীর কথা পড়েছি। যখন যানবাহন ছিল না, তখনো বাহন হিসেবে হাতির ব্যবহার হতো। প্রাপ্তবয়স্ক হাতির দাঁতের ওপর শিল্পকর্ম তৈরি করা হতো। বিভিন্ন রাজা-বাদশাহদের ভোগবিলাসের উপকরণ ছিল এটি। বিশেষ করে তরবারির খাপ, চুড়ি, দাবার ঘুঁটিসহ নানা জিনিস তৈরি হয়। এ কারণে চোরা শিকারিদের বড় লক্ষ্যবস্তু এ প্রাণী।
তারপর হাতি সম্পর্কে যখন পড়ি, তখন দেখি অন্যান্য প্রাণী যেখানে ৮ থেকে ১০ মাসে বাচ্চা জন্ম দেয়, সেখানে হাতির সময় লাগে প্রায় ২ বছর (২২ মাস)। ১২ বছর বয়সে এরা গর্ভধারণের উপযোগী হয়। হাতিরা ১০০ বছর বাঁচে বলা হলেও মূলত ৬০ থেকে ৭০ বছর বাঁচে। হাতি স্রষ্টার অনিন্দ্যসুন্দর সৃষ্টি। প্রকৃতির এক বিস্ময়কর প্রাণী। লম্বা শুঁড় আর দীর্ঘ দেহের হাতি ডায়নোসরের পর স্থলের সবচেয়ে বড় প্রাণী।
২০১৬ সালের শেষ তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে মোট হাতির সংখ্যা ২১০ থেকে ৩১০।
বন বিভাগের তথ্যানুসারে, ১৯৯২ সাল থেকে ২০২২ সালের জুলাই পর্যন্ত ১৪৫টি বন্য হাতির মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে ২০১৫ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে হত্যা করা হয় ৭৭টি বন্য হাতি।
বাংলাদেশে যে হাতি দেখা যায়, তা এশীয় মহাবিপন্ন প্রজাতি। এ হাতির বাস চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের বনভূমিতে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পের কারণে বিপুল পরিমাণ বনভূমি ধ্বংস হয়ে গেছে। জনসংখ্যার চাপে কক্সবাজার অঞ্চলে বনভূমি উজাড় হচ্ছে। সরকারি নানা প্রকল্প করে বনভূমি ধ্বংস করা হচ্ছে। বিশেষ করে চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজারে রেললাইন স্থাপন করতে গিয়ে হাতির চলাচলে বাধা পড়েছে। ২০১৮ সালে এ রেলপথ তৈরির কাজ শুরু হওয়ার পর ৫৫টির বেশি হাতির মৃত্যু হয়েছে।
পার্বত্য জেলাগুলোয় পাহাড়ের বনভূমি উজাড় করে বসতি স্থাপন বা চাষবাসের ফলে হাতির আবাসস্থল খুব সংকুচিত হয়ে পড়েছে। বনে খাবার না পেয়ে লোকালয়ে ঢুকে পড়ছে হাতি। অন্যদিকে, মানুষেরা বৈদ্যুতিক শক দিয়ে ফাঁদ পেতে হাতি হত্যায় মেতে উঠছে।
এভাবে চলতে থাকলে কয়েক বছর পর হয়তো চিড়িয়াখানা ছাড়া আর কোথাও হাতির দেখা পাওয়া যাবে না। পরবর্তী প্রজন্ম কেবল চিড়িয়াখানা আর বইয়ের পাতায় হাতির কথা পড়বে। যে কয়টি হাতি অবশিষ্ট আছে, তাদের বাঁচিয়ে রাখতে হবে। বনভূমিতে হাতির খাদ্য–উপযোগী গাছ লাগাতে হবে। হাতি রক্ষায় দেশের মানুষকে আরও সচেতন করতে হবে। বিশেষ করে হাতি বসবাস করে, এমন অঞ্চলে যাঁরা থাকেন, তাঁদের সচেতন হতে হবে। প্রকৃতির সঙ্গে বৈরিতা নয়, বরং মিলেমিশে বাস করা শিখতে হবে।
কার্যকরী সদস্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধুসভা