অনুপ্রেরণা
‘এটি ছিল আমার সুন্দর জীবনের শুরু’
রিয়াল মাদ্রিদ ও উরুগুয়ের মিডফিল্ডার ফেদে ভালভার্দে। দ্য প্লেয়ারস ট্রিবিউনে লিখেছেন নিজের জীবনের গল্প। সেটির কিছু অংশ পাঠকদের জন্য অনুবাদ করা হয়েছে।
সাধারণত আমি খুব বেশি কথা বলি না। নিজের মধ্যেই থাকতে পছন্দ করি। তবে মনে হচ্ছে গল্পটা আমার বলা দরকার। কারণ, আমি জানি এই গল্প অনেক মানুষকে সহায়তা করতে পারে, বিশেষ করে আমার মতো যাঁরা কষ্ট লুকিয়ে রাখতে পছন্দ করেন। বিশ্বাস করুন, দক্ষিণ আমেরিকায় আমার মতো এমন অসংখ্য মানুষ রয়েছেন।
উরুগুয়েতে বিষয়গুলো কিছুটা ভিন্ন। কষ্ট আমাদের রক্তে। আমরা গরিব, এটা বলতে পছন্দ করি না। বলব, আমার মা-বাবা ছিলেন উদ্যমী ও কর্মতৎপর। বাবা একটি ক্যাসিনোতে নিরাপত্তারক্ষী হিসেবে কাজ করতেন। অন্যদিকে মা রাস্তায় ঘুরে ঘুরে ভ্যানগাড়িতে পোশাক ও খেলনা বিক্রি করতেন। আমি এখনো সেই ভ্যানগাড়ির শব্দ শুনতে পাই। তখন মনে হতো এমন কাজ কেবল হাল্ক (মার্বেল সুপারহিরো) করতে পারে। কিন্তু এটা ছিল আমার মা। তিনি একজন যোদ্ধা। পোশাকভর্তি ভ্যানগাড়ি নিয়ে তিনি প্রতিদিন মার্কেটে যেতেন; গরম, শীত কিংবা বজ্রপাত—কোনো কিছুই তাঁকে দমিয়ে রাখতে পারত না। মাঝেমধ্যে ওনার সঙ্গে আমিও যেতাম। পোশাকের বক্সে বসে থাকতাম এবং রাস্তায় গাড়ি চলাচল দেখতাম। তখন বুঝতে পারতাম না মায়ের ত্যাগ স্বীকার।
সবচেয়ে বাজে ব্যাপার ছিল দিন শেষে আবারও পোশাকগুলো বক্সে ভরে ভ্যানগাড়ি নিয়ে বাড়ি ফিরে আসা। তারপর রাতের খাবার রান্না করা! আমার ময়লা পোশাক ধুয়ে দেওয়া। আপনি কি বুঝতে পারছেন? শোনেন, আমি বলছি, আমার মা আমার সুপারহিরো।
বাবা একটি ক্যাসিনোতে নিরাপত্তারক্ষী হিসেবে কাজ করতেন। অন্যদিকে মা রাস্তায় ঘুরে ঘুরে ভ্যানগাড়িতে পোশাক ও খেলনা বিক্রি করতেন।
আমার মা সকাল আটটা থেকে সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত বাইরে কাজ করতেন এবং বাবা কাজ করতেন সকাল আটটা থেকে সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত। আমাদের কাছে কেবল এক ঘণ্টা সময় থাকত বসে খোশগল্প করার এবং রাতের খাবার খাওয়ার। সেই দিনগুলোর কথা এখন স্মরণ করতে সবচেয়ে অবিশ্বাস্য কী লাগে জানেন? মা সব সময় আমার জন্য কোকের (কোমলপানীয়) ব্যবস্থা করতেন। এটি কেবল কোক ও প্রায় ফ্রি। কিন্তু তখন এটি আমার কাছে শ্যাম্পেইনের মতো ছিল!
দিনের শেষে ডিনার টেবিলে আমরা যতক্ষণ একসঙ্গে থাকতাম, ওই সময়টাই ছিল মায়ের সবচেয়ে সুখের মুহূর্ত। আমার কাছে সেখানে একসঙ্গে বসবাস করার সময়ের প্রতিটি মুহূর্ত ছিল অসাধারণ। রাতের খাবারের জন্য বসা ওই এক ঘণ্টা আমরা অন্যদের থেকে অনেক বেশি সুখী ছিলাম।
তারপর যখন ফুটবল খেলতে শুরু করলাম; এখনো মনে আছে, চাইতাম না ফুটবল দলের অন্যরা আমার বাড়িতে আসুক। বাড়িতে যে টেলিভিশন ছিল, সেটিতে মাত্র তিনটি চ্যানেল চলত। এর মধ্যে একটি ছিল ফ্রি! রাতে ঘুমাতে গেলে তেলাপোকার অত্যাচার সইতে হতো। ফ্লোরে কেবল একটি পুরোনো ম্যাট্রেস বিছিয়ে ঘুমাতাম।
এখন এগুলো আমার কাছে হাস্যকর মনে হয়। তবে তখন কিছুটা লজ্জা লাগত। ১১ থেকে ১২ বছরের বাচ্চারা কেমন হয়, তা হয়তো আপনারা জানেন। মনে হতো, তারা যদি দেখত আমরা কীভাবে বসবাস করি, তাহলে হয়তো এটা নিয়ে হাসাহাসি করবে। তাই সব সময় নিজের মধ্যে চুপচাপ থাকতাম।
এই আবেগকে ফুটবলে ব্যবহার করতাম। ফুটবলের মাধ্যমেই পরিবারের অবস্থা পরিবর্তন করতে সক্ষম হই। ১৬ বছর বয়সে স্থানীয় পেনারল ক্লাবের হয়ে পেশাদার ফুটবল খেলা শুরু করি। তারপর পরের বছরের একটি কল আমার জীবন সম্পূর্ণ পরিবর্তন করে দেয়।
তখন প্যারাগুয়েতে দক্ষিণ আমেরিকান অনূর্ধ্ব-১৭ চ্যাম্পিয়নশিপ খেলছিলাম। পারফরম্যান্সও দারুণ হচ্ছিল। পরদিন আর্জেন্টিনার সঙ্গে বড় ম্যাচ ছিল। আমি হোটেলের রুমে বসে আছি। মা–বাবা অন্য একটি রুমে ছিল। হঠাৎ মা কল করে বললেন, ‘এখনই আমাদের রুমে আসো। কয়েকজন লোক এসেছে তোমার সঙ্গে কথা বলতে।’
ওই মুহূর্তে আমাদের রুম থেকে বের হওয়ার নিয়ম ছিল না। তাই মাকে বললাম, ‘আমি আসতে পারব না মা।’ বলেই কল কেটে দিই। মুহূর্ত পরই তিনি আবার কল করেন এবং বলেন, ‘ফেড, এখনই আসো। এই লোকগুলো রিয়াল মাদ্রিদ থেকে এসেছেন।’
তাৎক্ষণিকভাবে মনে করেছিলাম মা হয়তো আমার সঙ্গে মজা করছেন। তারপরও সেখানে গেলাম কী হচ্ছে, তা দেখতে। দেখলাম, দুটি লোক বসে আছেন এবং তাঁদেরকে এর আগে কখনো দেখিনি। মায়ের চোখে পানি। কিন্তু তিনি সব সময়ই কান্না করেন। তাই তেমন পাত্তা দিলাম না। বললাম, ‘মা, অসম্মান কোরো না...’। তিনি বললেন, ‘ফেড, চুপ করো। এই লোকদের কথা শোনো। তোমার জন্য তাঁদের কাছে কিছু ভালো খবর রয়েছে।’
মনে করেছিলাম এই লোক দুটি পেনারল ক্লাবের হবে। তাঁরা এসেছে আমার সঙ্গে নতুন চুক্তি করতে। তখন ১৬ বছর বয়সী আমার ব্রেনে প্রথম যে বিষয়টা এল, তা হলো যাক এবার আর্জেন্টিনার বিপক্ষে খেলার জন্য নাইকি থেকে সুন্দর জুতা কিনতে পারব। হয়তে একটা প্লেস্টেশনও (অনলাইন গেমস) কিনতে পারব।
লোকগুলো কথা বলতে শুরু করলেন। তবে দক্ষিণ আমেরিকার স্প্যানিশ ভাষায় নয়। তখনই বুঝতে পারলাম তাঁরা এখানকার নন। মনে মনে বললাম, ‘এটা সত্যি তো!’
লোকগুলো আমাকে বললেন, ‘আমরা রিয়াল মাদ্রিদ থেকে এসেছি। আমরা বিশ্বাস করি, তুমি আমাদের ক্লাবের একজন তারকা হতে পারবে। আমরা চাই, তুমি ও তোমার মা-বাবা মাদ্রিদে শিফট করো।’
মায়ের দিকে তাকালাম। আমার ম্যানেজারের দিকে তাকালাম। বললাম, ‘তোমরা আমার সঙ্গে মজা করছ না তো?’ মা জবাবে বললেন, ‘চুপ করো ফেড। আমরা তোমার সঙ্গে মজা করছি না।’
বিশ্বের প্রায় পাঁচ লাখ ফুটবলার রয়েছেন এবং মাদ্রিদ আমাকে সাইন করতে চাচ্ছে? বিশ্বাস হচ্ছিল না! আনন্দে চিৎকার করতে করতে দৌড় দিয়ে বাইরে বের হয়ে আসি এবং বাবাকে খুঁজতে থাকি। লবিতে চলে যাই। দেখলাম, সেখানে বাবা অন্য খেলোয়াড়দের অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলছেন। বললাম, ‘বাবা, বাবা, মাদ্রিদের তাঁরা এখানে!!!’ তিনি বললেন, ‘কী? তাঁরা এখানে বলে কী বলতে চাচ্ছ? কোথায়?’ আমি বললাম, ‘ওপরে, রুমে। তাঁরা আমার সঙ্গে চুক্তি করতে চাচ্ছে! রিয়াল মাদ্রিদ আমাকে সাইন করতে চাচ্ছে!’
বাবা আমার দিকে এমনভাবে তাকালেন, যেন আমি এই দুনিয়ার সবচেয়ে পাগল মানুষ। বললেন, ‘ওপরের রুমে? ভালো কথা; তুমি এখানে নিচে কী করছ? ওপরে যাও দ্রুত।’
তারপর দৌড়ে রুমে গেলাম এবং দেখলাম লোকগুলো এখনো সেখানে আছেন। এটি মোটেই স্বপ্ন ছিল না।
এটি ছিল আমার জীবনের প্রথম পারফেক্ট দিন। মা–বাবার খুশি দেখতে পেয়েছি। কোনো কিছু হলেই মা কান্না করে ফেলেন। তবে বাবা শক্ত মানুষ। সহজেই উনি অনুভূতি প্রকাশ করেন না। কিন্তু ওই দিন ওনার চোখেও পানি দেখেছি। বলছিলেন, ‘আমার সন্তান রিয়াল মাদ্রিদে খেলবে।’
মনে হচ্ছিল বিশ্বের শীর্ষ চূড়ায় অবস্থান করছিলাম। কয়েক মাস এমন অনুভূতি ছিল। আমার অবস্থা বুঝতে হলে আপনাকে আমার জায়গায় কিছুক্ষণ কল্পনা করতে হবে। ‘আপনি ১৭ বছরের একজন তরুণ। দুই বছর আগে আপনি ফ্লোরে একটা পুরোনো বিছানায় ঘুমাচ্ছিলেন। আর এখন আপনি রিয়াল মাদ্রিদের খেলোয়াড়!’ এবার বলেন, কীভাবে আপনি বিশ্বের শীর্ষ চূড়ায় থাকবেন না?
যখন রিয়াল মাদ্রিদে আসি, মনে হচ্ছিল আমার শরীরে মেসি ও রোনালদো—দুজনই রয়েছেন! পরে নিজেই হেসে দিই। যখন আপনার বয়স ১৭, তখন আপনার কোনো ধারণাই নাই আপনি কতটা বোকা! বিশেষ করে কেউ যদি আপনাকে কিছু অর্থ ও সম্মান দেন।
তবে দ্রুতই বাস্তবতায় ফিরে আসি। রিয়াল মাদ্রিদের প্রথম ট্রেনিং সেশনের জন্য ড্রেসিংরুমে যখন হাঁটছিলাম; মনে হচ্ছিল আকাশের সাদা মেঘের মধ্যে হাঁটছি! অনেক আত্মবিশ্বাসী ছিলাম। এমনকি ট্রেনিংয়ের কথা মনেই ছিল না। সবকিছু কেমন ঝাপসা দেখছিলাম।
ট্রেনিংয়ের পর সবকিছু স্পষ্ট দেখা শুরু করলাম। দেখলাম, সবাই তৈরি হচ্ছে। চারদিকে তাকালাম। খেয়াল করলাম সবার পরনে গুচি বেল্ট, নতুন নাইকি জুতা, লুই ভিতোঁর ওয়ালেট, লুই ভিতোঁর টয়লেট ব্যাগ!
অথচ তাঁদের কেউই কিংবদন্তি ছিলেন না। করিম বেনজেমা, লুকা মদরিচ কিংবা মার্সেলোর কথা বলছি না। যাঁদের কথা বলছি, তাঁরা সবাই তরুণ।
তারপর আমার দিকে তাকালাম। বললাম, ‘ওহ ফেড! তুমি এখনো দুই ইউরো মূল্যের টি-শার্ট পরে আছ!’
আমার কাছে জারা ব্র্যান্ড মনে হতো অনেক মূল্যবান। উরুগুয়েতে যদি আপনি জারা ব্র্যান্ডের কিছু পরেন, তাহলে আপনি বস। দেখলাম, রিয়াল মাদ্রিদের তরুণ সতীর্থরা যেসব ঘড়ি পরে আছেন, সেগুলোর মূল্য আমার মা-বাবা যে বাড়িতে বাস করত, সেটির চেয়েও বেশি। মুহূর্তের জন্য মনে হলো আমি আসলেই কেউ নই।
আমি ময়লা পোশাক পরেই বসে থাকি। এমনকি পায়ের বুট জোড়াও খুলিনি। সবাই গোসল করতে যাচ্ছিল, দেখলাম তারা গুচি আন্ডারওয়্যার পরে আছে। নিজেকে প্রশ্ন করলাম, কবে তারা এটা তৈরি করল? এটার দাম কেমন হবে?
প্রায় ২০ মিনিটের মতো এক জায়গায় বসে থাকি এবং ফোন চেক এমনভাবে করছিলাম যেন কোনো মহাগুরুত্বপূর্ণ কিছু ফোনে রয়েছে। পুরোটাই ছিল সময় নষ্ট করার উপায়। সতীর্থরা আমাকে বলছিল, ‘ব্রাদার, কোনো সমস্যা? তুমি ঠিক আছ?’ নিজেকে এতটা ছোট কখনোই মনে হয়নি। সবার চলে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করি। তারপর আমি পোশাক পরিবর্তন করি।
মাদ্রিদে যে বাসায় আমরা বাস করতে শুরু করি, সেখানে তুলার ম্যাট্রেস। শীতাতপনিয়ন্ত্রিত রুম। টেলিভিশনে ৫০টি চ্যানেল। মনে হচ্ছিল, স্বর্গে বাস করছি!
মা-বাবার কাছ থেকে পাওয়া শিক্ষার কথা মনে হলো। বুঝতে পারি, আমি এখনো কেউই নই। নিজের যা আছে, সেটার জন্য কৃতজ্ঞতা বোধ করলাম। এটি ছিল আমার সুন্দর জীবনের শুরু।