বেহুলাবাংলার কবি: তানভীর মোকাম্মেল

তানভীর মোকাম্মেলছবি : সংগৃহীত

রাষ্ট্র ভেঙে রাষ্ট্র গড়ে ওঠে,
দেশ ভেঙে দেশ,
ভেঙে যাওয়া বাস্তুচ্যুত মানুষের জীবন আর গড়ে ওঠে না।
রোগ-শোক, যন্ত্রণা, মৃত্যু, ক্ষুধা আর স্মৃতিকাতরতা—
ভাঙা মন, তিলে তিলে শেষ
হারানো দেশ নামক মৃতদেহটিকে ভেলায় নিয়ে
জনমদুঃখিনী বেহুলা ভেসে চলে, ভেসে চলে শুধু অন্তহীন যাত্রায়।
দুপারে নদীর জল চক্ষু ছলছল,
বাংলার আকাশ, মাটি, মাঠ, গাছ, ঘাস জানে চরণে চরণে কত রক্তচিহ্ন, বিগলিত প্রাণ
আর জানে আপনার মন, তানভীর মোকাম্মেল।

গ্রামের প্রান্তিক মহিলারা আপনাকে ডেকে নিয়ে গিয়ে,
বেহুলা–লখাইয়ের চিরন্তনী আখ্যানপালা শোনায়,
এ যে তাদের নিজেদেরই জীবনের ব্যথা,
লতায়–পাতায় জড়ানো যাপনের কথা,
যে ব্যথা কবিতা হয় কলমে আপনি।

আপনার গড়া স্কুল মানব রতন শিশুকেন্দ্র
যেন লালনেরই মানবজমিন চাষ।
শিশুরা এখানে আসে, হাসে, খেলে, গায়, আঁকে, আবৃত্তি শেখে,
নাটকের মহড়ায় জীবনেরই ছায়া,
দল বেঁধে আপনার সঙ্গে প্রান্তিক কচি ফুলেরা সব চড়ুইভাতিতে মাতে।
পৃথিবীর নাট্যশালা একাঙ্ক নয়।
গুরুতর অসুস্থ বন্ধু সুকান্তের ভেঙে পড়া দেখে—
আপনার মন কাঁদে।
শহরে নিয়ে এসে তাকে চিকিৎসা করান,
যমুনা নদীতে ভাসতে ভাসতে তরী শুটিং বাহিনী নিয়ে তীরে এক গ্রামে—
জীর্ণ, পুরাতন ভাঙা স্কুল দেখে কেঁদে ওঠে মন
ব্ল্যাকবোর্ড, পড়াশোনার আনুষঙ্গিক কিনে দিয়ে আসেন।
বন্দরে ঘুরে ঘুরে ডিম বিক্রি করা নাবালক ছেলেটির সঙ্গে দেখা হয়,
দুঃখী পরিবারের গল্প শোনেন,
একসময় শিশুসুলভ দুটি মন সবকিছু ভুলে ক্রিকেটের গল্পে মেতে ওঠে।
স্কুল–কলেজজীবনে আপনিও যে ক্রিকেট খেলতেন।
ক্রিকেটার হতে হতে হয়ে গেলেন চিত্রপরিচালক।

গ্রামে গ্রামে প্রচারিত হয় আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চিত্রপরিচালক আসছেন,
গ্রামের মানুষের সে কী কৌতূহল! উন্মাদনা!
কখন আসেন, কখন আসেন রুপালি পর্দার সেই বিখ্যাত মানুষ!
দিনের শেষে গোধূলি রাঙিয়ে দেখা গেল
গোটা শরীর–পোশাকে দুর্গম রাস্তার কাদা মেখে সিনেমা দেখানোর সরঞ্জাম নিয়ে ভ্যান ঠেলে ঢুকছেন একজন,
গ্রামের মানুষ ফ্যালফ্যাল করে তাকায় আর অপার বিস্ময়ে ভাবে,
মাটির মানুষ আর কাকে বলে!
সিনেমায় যাঁদের কথা বলেন, আপনি যে তাঁদেরই একজন!

বেহুলাবাংলার কবি,
এপার থেকে ওপারে দেশ ছেড়ে যাওয়া মুসলিমরা আপনাকে
ওপার থেকে ভিটেমাটি ছেড়ে আসা এপারে
হিন্দুরা আপনাকে
যন্ত্রণার কথা শোনায়
আপনি আর ঘটে যাওয়া রাষ্ট্রসংঘাত, ইতিহাস, মানচিত্র
জীবনের দহন কতটা–কীভাবে বদলাবেন?
সেসব কথায় তুলে এনে শুধু বারবার সবাইকে শোনান
শোনান—উদ্বাস্তু বেহুলাবাংলার আখ্যান।

এ মৃত দহনযাত্রার যে শেষ নেই
শরীরে পচন ধরে, মাংস গলে গলে পড়ে,
হাড় খসে যায়,
বেহুলাবাংলা তবু স্মৃতিসত্তা তার তুলে তুলে রাখে
একদিন যদি গিয়ে কূল পাওয়াও যায় ইন্দ্রের সভায়
উলঙ্গ রাজনীতির মারপ্যাঁচে নেচে যেতে হবে তাকে
নির্মম অগ্নিপরীক্ষায় এ জনমদুঃখিনী বাংলাকে কেঁদে যেতে হবে বারবার।
রাষ্ট্র ভেঙে রাষ্ট্র গড়ে ওঠে
দেশ ভেঙে ভিন্ন ভিন্ন জাতীয়তাবাদ
রক্ত–মাংসে এক সে মানবজাতি
বেহুলাবাংলার কবি, আপনিই যে একমাত্র তার তাপ–পরিতাপ
অনুতাপে নিয়ত যারা ভেঙে ভেঙে পড়ে,
চলচ্চিত্রে জনমতে যদি পায় কোনো একদিন কিছু একটা দিশা
সেদিনের পানে মুখ চেয়ে থাকে,
ওই বিশাল আকাশের ডাকে, মুক্তি পাবে মাটির জন্মদিনের কবিতা।